তরুণ গোস্বামী
১৮৯৫ সাল। স্বামীজি তখন ইংল্যান্ডে। একদিন দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের পর স্বামীজি ভারতবর্ষ নিয়ে আলোচনাতে মেতে উঠলেন গুরুভাই স্বামী সারদানন্দ ও মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। স্বামীজি আলোচনার মাঝে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, কংগ্রেস কি হাউড়ের মতো কাজ করছে। ওদের সব দেশে স্বাধীন বলে ডিক্লেয়ারেশন পাঠাতে বল। ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালাক, আমার গায়ে গুলি লাগুক আর তখন আমেরিকানরা ক্ষেপে উঠবে। ওরা বুঝতে পারবে কার গায়ে হাত দিয়েছি। মহেন্দ্রনাথ তাঁর গ্রন্থ ‘লন্ডনে বিবেকানন্দ’-তে এ বিষয়ে বিশদে লিখেছেন।
ইংল্যান্ডে ১৮৯৫ সালটি ভারতীয়দের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। ওই বছর আই.সি.এস পরীক্ষাতে প্রথম হল অতুল চ্যাটার্জি; কাউন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান করেন রঞ্জিত সিং এবং আমেরিকার চিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তা বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে আসেন বেদান্ত প্রচার করতে। ইংল্যান্ডের ভারতীয়রা ঠিক করেন এই তিনজনকে সংবর্ধনা দেবেন। স্বামীজি হাজির হন এবং সংক্ষিপ্ত একটি বক্তৃতায় সকলের মন জয় করে নেন। স্বামীজি সেদিন বলেছিলেন, এই দুই বিশিষ্ট ভারতীয়র মধ্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কারণ আমি জাতীয় প্রাণীর প্রতিনিধিত্ব করছি আর তিনি আর কেউ নন শ্রী হস্তি। সকলে হেসে ওঠেন। পাশ্চাত্যে স্বামীজিকে দেখে অনেকেরই চোখে ছিল অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসা। কোথায় এর আধ্যাত্মিক মানুষের মতো চেহারা? ছুঁচলো দাড়ি, শুকনো মুখ, লাল চোখ, এর তো দেখছি এতখানি সহাস্য মেদ। কেউ কেউ স্বামীজিকে প্রশ্ন করতেন এই বিষয়ে। স্বামীজির সোজা উত্তর, আধ্যাত্মিক মানুষেরা আনন্দে মোটা হয়; আমি মোটা মানুষ, সুতরাং আমি আধ্যাত্মিক মানুষ। এই কথা বলার সময় আনন্দে ঝিকিয়ে উঠত স্বামীজির চোখ।
আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে স্বামীজিকে প্রায়ই বিভিন্ন মানুষ মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানাতেন। স্বামীজিকে পেয়ে এই ব্যক্তিরা বিশেষ করে ইংল্যান্ডে জিজ্ঞেস করতেন ভারতবর্ষের নানা কুপ্রথার ওপর মন্তব্য করতে। তাঁরা বলতেন, স্বামীজি আপনার দেশটা কেমন, যেখানে মায়েরা সন্তানকে কুমিরের মুখে ফেলে দিতেন। স্বামীজি হেসে বলতেন ভাগ্যে আমার মা এই কাজটি করেননি, নইলে আপনাদের সঙ্গে আর কথা বলতে পারতাম না। আলাপচারিতায় উঠে আসত মহারানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের কথা। স্বামীজি বলতেন, কীভাবে ইংরেজরা ভারতীয়দের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এই আলোচনার শেষ হত স্বামীজির ইংরেজ শাসনের ওপর তির্যক মন্তব্য দিয়ে। ভারতীয়রা রানীকে খুব সম্মান করে কারণ তিনি বিধবা হয়ে পুনর্বিবাহ করেননি আর শান্তির কথা যদি বলেন সেক্ষেত্রে শ্মশানের মতো শান্তি আর কোথায় আছে বলুন! বলাই বাহুল্য এরপর সেই গৃহস্বামী স্বামীজিকে আর কোনওদিন নিমন্ত্রণ করতেন না এবং চারদিকে তাঁর নামে কুৎসা রটিয়ে বেড়াতেন।
স্বামীজি দেখেছিলেন ইংরেজ আমলে রক্তাক্ত এবং অশ্রুময় ভারতবর্ষের নির্মম ছবি। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে ইংরেজ শাসনে ভারতীয়রা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ছে। সঙ্গে দেখেছিলেন উচ্চবর্ণের নিম্নবর্ণের ওপর অমানুষিক অত্যাচার। যারা সাধারণ মানুষ তাদের দিশেহারা অবস্থা, তাদের না আছ পেটে খাদ্য, না আছে মাথার ওপর ছাদ। পরনের বস্ত্রটিও শতচ্ছিন্ন এবং শিক্ষা শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে সীমিত। এই কারণে কেউ ইংরেজ শাসনের প্রশংসা করলে তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ করতেন বিবেকানন্দ। কারণ তিনি কাউকে রেয়াত করতে শেখেননি।
১৮৩৫ সালে কলকাতায় এলেন লর্ড মেকলে। ঘুরে দেখলেন শহরটা। অবাক হয়ে গেলেন মানুষের সহজ সরল জীবনযাত্রা দেখে। ইংল্যান্ডে তাঁর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে চিঠিতে লিখলেন এমন একটা দেশে এসেছি, যেখানে কোনও চোর খুঁজে পাইনি। এদের শিরদাঁড়া হচ্ছে ধর্ম। আমি প্রস্তাব করছি ইংরেজি শিক্ষা এদেশে চালু করতে হবে এবং আরবি-ফারসি, সংস্কৃত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করে দিতে হবে। এদের মধ্যে নিজের দেশের প্রতি তার মানুষের প্রতি তীব্র ঘৃণাবোধ তৈরি করতে হবে। আমরা একটা নতুন শ্রেণি তৈরি করব, যারা আমাদের সঙ্গে, যাদের ওপর আমরা অত্যাচার চালাই তাদের মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করবে। তারা দেখতে হবে ভারতীয়দের মতো কিন্তু চিন্তায়, চেতনায়, কথাবার্তায় ইংরেজ।
গোটা দেশ ডুবে গেল পরানুকরণে। কালো সাহেবদের নির্মমতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন স্বামীজি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এদের ব্যাপারে তাঁর ‘বিলেতফেরতা’ কবিতায় লিখলেন ‘আমরা বিলিতি ধরনে হাসি, ফরাসি ধরনে কাশি আর পা ফাঁক করিয়া সিগারেট খেতে বড্ডই ভালবাসি।’
স্বামীজি নিজে ইংরেজি মাধ্যমে কলেজে পড়েছেন কিন্তু পরানুকরণ তাঁর ঘোর অপছন্দের ব্যাপার। তিনি বিশ্বাস করেছেন আদানপ্রদানে; অন্ধ অনুকরণে নয়। তিনি মৌলিক চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং বহু চিঠিতে লিখেছেন আমাদের গুরু ছিলেন মৌলিক তাই আমাদের মৌলিক হতে হবে। তিনি গুরুভাইদের তিরস্কার করে লিখেছেন, তোমরা একটা ছেঁড়া নেতাকে নিয়ে টানাটানি করছ, মৌলিক চিন্তা করতে শিখে তবেই জীবনে এগোতে পারবে। স্বামীজির ভারতবর্ষ ঘুরে মনে হয়েছিল তথাকথিত শিক্ষিত মানুষেরা দেশ গঠনে আসবে না। তাদের নেতিবাচক চিন্তা দিয়ে দেশ গড়া যাবে না, তাই লিখেছিলেন, ‘তোমরা লং, লৃট, বিধিলং তোমাদের সঙ্গে কথা বললে মনে হয় ঠানদিদির মুখে গল্প শুনছি। তোমরা শূন্যে লীন হও আর নতুন ভারত বেরুক চাষার কুটির থেকে, ভুনাওয়ালাদের উনোনের পাশ থেকে, ঝোপ জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।’ এটি স্বামীজির মৌলিক চিন্তা। তিনি মনে করেছেন কয়েকটি রাজা এবং কয়েকজন গ্র্যাজুয়েট দিয়ে দেশ চলবে না। স্বামীজি যখন একথা বলছেন এবং লিখছেন তখন মানুষের বিশ্বাস ছিল দেশটা শিক্ষিত মানুষেরা চালাতে পারে।
স্বামীজি বিশ্বাস করেছেন সাধারণ মানুষকে। পরিব্রাজক বিবেকানন্দ দেখেছিলেন সাধারণ মানুষের ভালবাসা, ধৈর্য এবং মুখ বুজে কাজ করার ক্ষমতা। এক টুকরো রুটি পেলে এরা দুনিয়া উল্টে দিতে পরে, ত্রৈলোকে তাদের তেজ ধরবে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রচারকে তিনি জীবনের পরিত্রাণ কাজ বলে মনে করেছেন।
জাপান থেকে আমেরিকা রওনা হবেন ১৮৯৩ সাল। মাদ্রাজি বন্ধুদের চিঠি লিখলেন, ‘ভারতবর্ষ সহস্র যুবকের বলি চায়, যারা মানুষ, পশু নয়। যারা দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে। তাদের অসহায় মুখে অন্নদান করবে, তাদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটাবে; আর আমাদের পূর্বপুরুষের অত্যাচারের ফলে যারা পশু পদবিতে উপনীত হয়েছে তাদের উন্নতির জন্য অসীম চেষ্টা করবে।’ স্বামীজির মতো সাধারণ মানুষের যন্ত্রণায় এভাবে কান্না আর কেউ কাঁদতে পারেনি এর মূল কারণ মানুষ মনে করেছে দরিদ্র হওয়া চরম অপরাধ। তাই দরিদ্র মানুষকে সমাজ অত্যাচারই করেছে। তাদের কথা শোনেনি, তাদের যন্ত্রণা অনুভব করার চেষ্টা করেনি।
স্বামীজি বলেছেন, ‘পড়েছো পিতৃদেবো ভব, মাতৃদেবো ভব; আমি বলি দরিদ্রদেবো ভব, মূর্খদেবো ভব। দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞান, কাতর তোমার দেবতা হোন, এদের সেবাই পরম ধর্ম জানবে।’
১৮৯৪ সালে আমেরিকা থেকে কলকাতার গুরুভাইদের চিঠি লিখেছেন, ‘একটা বড় চালা চাই। তারপর বরানগরে অনেক গরিবগুর্বো আছে তাদের জুটিয়ে আনা চাই। তারপর ম্যাজিক লণ্ঠন দিয়ে গ্লোব দিয়ে তাদের পড়াতে হবে। ওসব পুঁথি পাতড়ার কাজ নয়, মুখে মুখে শিক্ষা দাও। যদি পার তবে বুঝব তোমরা মরদ আমার কাজে আসবে।’ শিকাগো থেকেও মানুষের জন্য কান্না। স্বামীজি তখন শিকাগোতে ছিলেন। ইচ্ছা করলেই নিজের মা এবং ভাইদের আমেরিকায় নিয়ে যেতে পারতেন। খুলে বসতেন একটা আশ্রম এবং নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা পারেননি। ভারতে ফিরে এসেছেন; রক্তাক্ত হয়েছেন। অপমানিত হয়েছেন পদে পদে, তবুও একদিনের জন্য দেশের প্রতি টান তাঁর যায়নি। ভারতবর্ষ তাঁর কাছে তীর্থক্ষেত্র। মনে করেছেন এই দেশকে ওঠাতে হবে; গরিবদের জাগাতে হবে, তাদের মুখে ভাত তুলে দিতে হবে। কলকাতাতে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। প্রত্যুত্তরে স্বামীজি বললেন, পূর্ব বা পশ্চিম, দেশই সর্বশ্রেষ্ঠ।
পাশ্চাত্য থেকে প্রথমবার ফিরে স্বামীজি বললেন, এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ। মানুষের সামনে উপস্থিত করলেন দেশকে জাগানোর মন্ত্র— My plan of campaign-এর মাধ্যমে। জেগে উঠেছিল দেশের, যুবকবৃন্দ, যারা দেশমাতৃকার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করলেন আর তাদের নেতা বিবেকানন্দ। ১৯০১ সালে স্বামীজি ঢাকায় আসেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন কয়েকজন যুবক হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে। হেমচন্দ্র পরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স তৈরি করে এবং বিনয়-বাদল-দীনেশের মহাকরণ অভিযান বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল।
স্বামীজি মধ্যাহ্নভোজ সেরে ধূমপান করছিলেন, এমন সময় যুবকরা হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে গিয়ে স্বামীজিকে ধর্মজীবন নিয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। স্বামীজি প্রথমে যুবকদের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন পরে উত্তেজিত হয়ে তাদের বললেন, পরাধীন জাতের মাতৃশ্রাদ্ধের কোনও অধিকার নেই। যে লুঠেরারা তাদের মাকে অত্যাচার করছে, স্বামীজি তাদের দেশ থেকে তাড়ানোর কথা স্বামীজি বললেন। তারপর বললেন, ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালাক, দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যাক এবং তার প্রথম বুলেটটা যেন তাঁর বুকে লাগে। হেমচন্দ্র জীবনে একবারই স্বামীজিকে দেখেছিলেন কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে সারাজীবন আর কোনও গুরুজনকে কখনও প্রণাম করতে পারেননি। তিনি বলতেন, যে হাত স্বামীজির পা ছুঁয়েছে আমি কোনওদিন চাইনি সে হাত আর কাউকে প্রণাম করে। পরে হেমচন্দ্র বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স প্রতিষ্ঠা করেন।
দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন রাজেন লাহিড়ী। রাজেনের ফাঁসি হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে রাজেন প্রতিদিন উচ্চকণ্ঠে পাঠ করতেন স্বামীজির চিঠিপত্র। একদিন ব্রিটিশ জেলার এসে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, তিনি রোজ কী পাঠ করছেন‘ উত্তরে রাজেন বলেন, তিনি প্রতিদিন স্বামীজির চিঠি পাঠ করেন, তিনি হয়তো থাকবেন না, কিন্তু একদিন ভারতীয়রা ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়াবেই।
প্রীতিলতা ওয়াদেদার যেদিন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যান, সেদিন স্বামীজির মুখের ছবি দেওয়া ব্রোচ পরে নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ এই ঘটনাটিতে খুব খুশি হন। আর প্রীতিলতাকে চিঠি দিয়ে জানান, প্রীতি যেন সবসময় মনে রাখে স্বামীজি হচ্ছে ভারতের আধ্যাত্মিক নেতা এবং যুবনায়ক।
বিপ্লবীরা যখন গ্রেপ্তার হতেন, তাঁদের কাছে থাকত দক্ষিণেশ্বরের মাটি এবং স্বামীজির লেখা গ্রন্থ বর্তমান ভারত। সাহেব গোয়েন্দাদের মনে হয়েছিল স্বামীজিকে ঘিরে আবার দেশে সন্ন্যাস বিদ্রোহ আসছে যে সন্ন্যাস বিদ্রোহের কথা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর আনন্দমঠে লিখেছিলেন। অরবিন্দ ঘোষকে যখন ব্রিটিশ পুলিশ গ্রে স্ট্রিট থেকে গ্রেপ্তার করে, তাঁর কাছে পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণেশ্বরের মাটি। কোনও বোমা তৈরির মশলা তাঁর কাছ থেকে মেলেনি, মেলেনি কোনও বন্দুক।
সুভাষচন্দ্র স্বামীজির বই পড়তে শুরু করেন যখন তিনি ১৭/১৮ বয়সের যুবক। এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে আলমারিতে দেখেন স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা এবং একটি খণ্ড নিয়ে পড়তে শুরু করেন। পরে নেতাজি লিখেছেন কয়েকটি পাতা উল্টিয়ে বুঝতে পারলাম এই গ্রন্থই আমি খুঁজছিলাম। সেই থেকে স্বামীজির বই আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। স্বামীজি বেঁচে থাকলে তিনি আমার গুরু হতেন। মনে রাখতে হবে সুভাষচন্দ্র জন্মেছিলেন ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ আর স্বামীজি প্রথমবার পাশ্চাত্য থেকে ফেরেন ১৮৯৭-এর গোড়াতে। যখন সুভাষচন্দ্র আজাদহিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক প্রায়ই সিঙ্গাপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ঠাকুরের মন্দিরে ধ্যান করতে যেতেন। ব্রিটিশ পুলিশের নজর পড়ল তাঁর ওপর এবং তখন থেকেই মিশনে গিয়ে নিয়মিত ধ্যান করা তিনি বন্ধ করেন মিশনের সাধুদের অযথা হয়রানির হাত থেকে বাঁচাতে। কী সশস্ত্র আন্দোলন, কী নিরস্ত্র আন্দোলন, এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না, যিনি স্বামীজির দ্বারা অনুপ্রাণিত হননি। স্বামীজির কথা ‘আগামী পঞ্চাশ বছর দেশমাতা তেমার একমাত্র আরাধ্যা দেবী হোন’ টেনেছিল যুবকদের। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশমাতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে; হেলায় ফাঁসিকাঠে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
মহাত্মা গান্ধি যেদিন ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে আসেন, সেদিন স্বামীজি মঠে ছিলেন না, কলকাতাতে এসেছিলেন। মহাত্মাজি বলেন, আগামী দিনে বহু মানুষ শান্তির খোঁজে বেলুড় মঠে আসবেন। ব্রিটিশ পুলিশের নজর পড়েছিল মঠের ওপর। স্বামীজি এবং ঠাকুরের তিথিপুজোতে সাদা পোশাকের পুলিশ নজর রাখত মঠের অতিথিদের ওপর।
স্বামীজি বলেছিলেন, গীতাপাঠ থেকে ফুটবল খেললে তুমি আগে স্বর্গের কাছে পৌঁছবে। স্বামীজি জানতেন গীতাপাঠ করে, গঙ্গাস্নান করে যারা সারাদিন নিষ্কাম কর্মে ডুবে থাকেন, গীতা তাঁদের জন্য নয়। গীতা জীবনযুদ্ধের কথা বলে। ফুটবল খেলা শেখায় একটি লাথি মারলে আর একটি লাথি ফিরে আসবে। তাই শরীরকে শক্তপোক্ত করে জীবনযুদ্ধে নামা এবং দেশমাতার সেবা করাই জীবনের একমাত্র ব্রত। বিবেকানন্দ যেমন আন্তরিকভাবে ডাক দিয়েছিলেন তাতে সাড়া দিয়েছিল যুবকরা। তিনি ছিলেন যুবকদের গুরু। যুবগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ যোগ দিয়েছিল সমাজ গঠনে। সেবা হয়ে উঠেছিল তাদের জীবনের ব্রত, ধর্ম।
প্রথমবার পাশ্চাত্য থেকে ফিরে স্বামীজি মাদ্রাজে একটি বক্তৃতা দিলেন, যার বিষয় ছিল আমার সমরনীতি। স্বামী বুঝেছিলেন, একশত শিক্ষার মধ্যে দিয়েই ভারতের সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। তিনি বলেছেন, প্রথমে ধর্ম দান, তারপর বিদ্যা দান, তারপর অন্ন দান এবং প্রাণদান। ধর্মদান বললেই অনেকে ভাবেন ঘণ্টানাড়া, নিরামিষ খাবার খাওয়া। তা একেবারেই নয়। ধর্মদান মানে নীতিবোধ, ব্যক্তিগত স্তরে এবং সামাজিক স্তরে। ব্যক্তিগতভাবে মানুষ সৎ না হলে সে সমাজের উন্নতি প্রায় অসম্ভব। আমাদের দুঃখ লাগে, যখন দেখা যায় ভারতবর্ষে ব্যক্তিগত সততা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বেশির ভাগ মানুষ মন মুখ এক করতে পারছে না। মুখে হাসি কিন্তু মনে মনে তার সর্বনাশের চেষ্টা করছে। স্বামীজির ভাষায় মুখে মধু কিন্তু হৃদয় হলাহল। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ নেই বলে ভারতবর্ষে হিংসে করা জাতীয় পাপে পরিণত হয়েছে। কোনো বড় সরকারি অফিসে একজন বদলি হলেন বা অবসর নিলেন, যিনি এলেন তিনি হিংসা করেন, যিনি ছিলেন তাঁর সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিলেন। অথচ তাঁর কাজের মধ্যে হয়তো সত্যিকারের ভালো কিছু থাকতে পারত। স্বামীজির কথায় পোড়া হিংসেটা খায় না। শুধু সংসারীদের মধ্যেই নয়, বহু সন্ন্যাসী দ্বারা চালিত প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় একজন সাধু আর একজনকে হিংসে করছে এবং তা সংক্রামক ব্যাধির মতো দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলে সেই সংঘের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
দ্বিতীয়ত, স্বামীজি সঠিকভাবেই দেখেছিলেন ভারতবর্ষের সামাজিক স্তরে মূল্যবোধের বড় অভাব। এই ব্যাধিটি ভারতবর্ষকে আক্রমণ করেছে ভয়ংকরভাবে। কারও কোনও সামাজিক দায়িত্ববোধ নেই, এদেশ যেন একটা বেওয়ারিশ দেশ। নিজে খাও দাও ভাল থাকো, কারো দিকে তাকানোর দরকার নেই। দেখা যাচ্ছে যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে তাই মানুষ নিজের সামাজিক দায়িত্বটি ঠিক ঠিক পালন করছে না। সেদিন আর নেই যখন রাস্তায় কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে আশেপাশের মানুষ ছুটে এসে বিপদগ্রস্ত মানুষটির পাশে দাঁড়াবে। দেখা যাচ্ছে খুব কম মানুষ এখন এগিয়ে আসেন এবং যাঁরা আসেন বিপুলভাবে সমালোচিত হন। স্বামীজি একটি চিঠিতে ১৮৯৪ সালে মহীশূরের মহারাজকে লিখেছিলেন, এই জীবন ক’দিনের, জীবনের চাকচিক্য কয়েকদিনের, সেই বেঁচে থাকে যে পরের জন্য বেঁচে থাকে, বাকিরা মৃত, প্রেততুল্য। জীবন মানেই আাদানপ্রদান। প্রসারণ জীবন, সংকোচন মৃত্যু। স্বামীজি বার বার নিঃস্বার্থ ভালবাসার কথা বলেছেন কারণ সমাজের অধিকাংশ মানুষ যদি স্বার্থপর হয়, তবে সমাজ স্তব্ধ হয়ে যায়, তার গতি ছন্দহীন হয়ে যায়। বারবার স্বামীজি মিলেমিশে থাকার কথা বলেছেন। স্বামীজি সরফরাজ হোসেনকে চিঠিতে লিখেছেন, ১৮৯৮ সালে ‘ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বেদান্ত মস্তিষ্ক ও ইসলামীর দেহ লইয়া অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে। ইসলাম সমাজে দেখা যায় নমাজের সময় রাজা এবং প্রজা দু’জনেই একসঙ্গে বসে ঈশ্বরকে ডাকছে, সেখানে কোনও উঁচুনীচুর ভাগ নেই। বেলুড় মঠের মূল মন্দিরের যে নকশা স্বামীজি প্রস্তুত করেছিলেন, তা মহাসমন্বয়ের বার্তা বহন করে। হিন্দু, মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের অপূর্ব মিলন মন্দিরটির মধ্যে আছে। স্বামীজির গুরু ছিলেন সমন্বয়ের সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করার সাধক। যে মানুষ একঘেয়ে, একপাশে যার দৃষ্টি, ঠাকুর তাকে সহ্য করতে পারতেন না। জীবন মানেই সবাইকে নিয়ে চলা, জীবন মানেই একটা নিটোল নিখাদ সমন্বয়।
স্বামীজি বুঝেছিলেন ভারতবর্ষে নারীরা না জাগলে এদেশের সমাজকে কোনোদিন জাগানা যাবে না। নারীদেরকে আধুনিক শিক্ষা দিতে হবে, যা অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে যোগ তৈরি করবে। তিনি দেখেছিলেন ইংল্যান্ডে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল দ্বারা পরিচালিত স্কুল। ১৮৯৭ সালে মার্গারেটকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এদেশে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ইংরেজ গভর্নেসরা যেমন বড়লোকের মেয়েদের শিক্ষা দিত, তেমন স্কুল না; মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মেয়েরা যাতে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে পরে, তেমন একটি বিদ্যালয়। মার্গারেটকে স্বামীজি লিখেছিলেন, এদেশের আবহাওয়া তাঁর অনুকূল নয়। মানুষজন সন্দেহের চোখে দেখবেন তাঁর চামড়ার রঙের জন্য, কিন্তু এসব এড়িয়ে যদি তিনি ভারতে আসেন তবে কাজের সুযোগ আছে। ‘তোমার ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্ত তোমাকে যোগ্য নারী রূপে তৈরী করেছে।’ মার্গারেট সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। তিনি ভারতে আসেন ১৮৯৮ সালের গোড়াতে। স্কুল তৈরি হল বাগবাজার অঞ্চলের বোসপাড়া লেনে ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে কালীপুজোর দিন। প্রতি পদে অপমানিত হতে হয়েছিল নিবেদিতাকে, কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বহু কষ্টে স্কুলটি চালিয়েছিলেন।
স্বামীজি বিশ্বাস করেছেন, ভারতবর্ষকে গড়ে তুলতে চাই পুব-পশ্চিমের মিলন। পাশ্চাত্য থেকে আনতে হবে প্রযুক্তি, বিনিময়ে ভারত দেবে আধ্যাত্মিকতা। স্বামীজির এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৯ সালে ভারতী পত্রিকাতে তিনি লেখেন, ‘ভারতের সাধনাকে পশ্চিমে ও পশ্চিমের সাধনাকে ভারতে দিবার ও লইবার পথ রচনা করিতে গিয়া তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করিয়াছিলেন।’ উদ্বোধন পত্রিকার প্রথম সংখ্যার ভূমিকাতে স্বামীজি লিখেছিলেন, পুব-পশ্চিমের মিলন হবে উদ্বোধনের জীবনের উদ্দেশ্য। স্বামীজি বরাবর বিশ্বাস করেছেন দুই সভ্যতার মিলন ঘটলেই তবে পৃথিবীতে নতুন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শান্তি স্থাপিত হবে।
স্বামীজির নামে অনুষ্ঠান করা আজকাল ফ্যাশানে দাঁড়িয়ে গেছে। স্বামীজির নাম উচ্চারণ করার আগে আমাদের কতগুলো ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। প্রথমত, স্বামীজিকে যাঁরা ভালবাসবেন, তাঁদের একশ শতাংশ অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। অন্য ধর্মের মানুষকে অশ্রদ্ধা, ঘৃণা করা চলবে না। ভারতবর্ষকে ভালবাসতে হবে, দরিদ্র মানুষকে শিবজ্ঞানে সেবা করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যারা মানুষে মানুষে বিভেদে বিশ্বাস করেন, তারা ছুতোনাতায় বিবেকানন্দকে নিয়ে আনছেন এবং নিজের সুবিধার্থে তাঁর কথার একটি অংশকে ব্যবহার করছেন। এদের থেকে সতর্ক হওয়া একান্তভাবে প্রয়োজন। বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘আগামী দিনে সব ধর্মের ওপর শত বাধা সত্ত্বেও লেখা হবে বিবাদ নয় সহায়তা, বিনাশ নয় পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয় ঐকতান ও শান্তি।’ এইমতের বাস্তব রূপায়ণ একথাও সেবার মধ্যে দিয়ে হওয়া সম্ভব। সেবা এবং নিঃস্বার্থ ভালবাসার মধ্যে দিয়ে নতুন সমাজ গড়ে উঠুক ভারতবাসীদের স্বামীজির জন্মদিনে সেই শপথ নেওয়া উচিত।
বিবেকানন্দের মৃত্যু নেই। যেখানেই মানুষ অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত হবেন, সেখানেই স্বামীজি পৌঁছবেন এবং যুবসমাজের মনে আলো জ্বেলে দিয়ে নতুন শ্রেণিহীন, শোষণহীন পৃথিবী তৈরি করবেন।