• facebook
  • twitter
Saturday, 11 January, 2025

সিস্টার নীরজা কথা

সিস্টার নীরজার কথা শুনে সকল মায়ের মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়। তাঁরা সিস্টার নীরজাকে বলেন— ‘দিদি আমরা সকলে কথা দিলাম আজ থেকে আমরা কখনো ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ করবো না।

অঙ্কিত চিত্র

মিঠুন মুখোপাধ্যায়

নীরজা নামের একজন সিস্টার সেদিন সারারাত হাসপাতালে ছিলেন। একই ঘরে সাত সাতটি রোগী। সকলেই সবে মা হয়েছেন। অসুস্থ রোগীদের সকলেই তিন দিন আগে সিজারে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। কারো ছেলে আশা করে মেয়ে হয়েছে, আবার কারো মেয়ে আশা করে ছেলের পর ছেলে হয়েছে। কারোরই আশা পূর্ণ হয়নি। তাই কারো মনে সন্তুষ্টি নেই। সন্তানকে কোলে নিচ্ছেন না। সন্তান খুব না কাঁদলে বুকের দুধটা পর্যন্ত মুখে ধরছেন না। কারো শাশুড়ি বলে দিয়েছেন, এবার ছেলে না হলে বাপের বাড়ি বিদায় করে দেব। কারো স্বামী বলেছিলেন, ছেলের পর একটা মেয়েই চাই। আবার কোনো মা আশা করেছিলেন দুই মেয়ের পর এবার একটা ছেলে হোক। সবাই সিজারের অসুস্থতা ও মনে ঈশ্বরের প্রতি একরাশ অভিমান নিয়ে শুয়েছিলেন। কেউ আবার ঘুমাচ্ছিলেন। সেদিন সমস্ত বাচ্চাদের ও তাদের মায়েদের দেখাশোনা করেছিলেন এই সিস্টার নীরজা। এই নীরজারা চিরকাল অন্যের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে থাকেন। নিজের জীবনকে অন্যের সেবায় সর্বদা ব্যস্ত রাখেন।

সকালবেলা নিজের ডিউটি শেষ করে সিস্টার নীরজা যখন বাড়ি যাচ্ছিলেন, তখন একটু থেমে তাঁর ওয়ার্ডের সকল মায়েদের উদ্দেশে বলেন— ‘তোমরা কেউই তোমাদের সন্তান ও পরিবারকে নিয়ে খুশি নও। আমরা প্রত্যেকে যা ঈশ্বরের কাছে চাই, তা পাই না। আর তার জন্য মনটা দুঃখে ভরে যায়। কিন্তু একবারও কি তোমরা ভেবে দেখেছো, এই পৃথিবীতে এমন কত নারী আছেন যাঁরা কখনো সন্তানের মুখ দেখেননি! কোনোদিন মা হতে পারেননি! তাঁদের মনের কষ্ট একবারও চিন্তা করেছ তোমরা! সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়ে, সে মূল্যহীন হয়ে যায় না। একজন পিতা-মাতার কাছে সন্তানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। যাদের যা চাহিদা ঈশ্বর তা তাকে না-ই দিতে পারেন, তবে মেয়েদের লড়াই দিতে হয়। অন্যদের কথা শুনে চলতে গেলে দুর্বল হয়ে যাবে। আমি চল্লিশ বছর বয়সেও মা হতে পারিনি। হাজার হাজার নারীকে মা হতে সাহায্য করেছি কিন্তু নিজে কোনোদিন মা ডাক শুনিনি। আমার মনের ভিতর গভীর যন্ত্রণা আছে। তাই বলি ভগবানের দান কখনো অবজ্ঞা করতে নেই।’ সিস্টার নীরজার কথা শুনে কয়েকজন মায়ের চোখে জল দেখা যায়। আবার কারো কারো মন গলে না। তাঁরা মনে করেন— ‘এক একজনের সংসারে এক একরকম সমস্যা। ফলে বাইরে থেকে অনেকে অনেক কথাই বলতে পারেন। তিনি এই সকল সমস্যার সম্মুখীন হলে বুঝবেন বলা বা জ্ঞানদেওয়া কতটা সহজ ও কাজে কতটা কঠিন।’

বিকেলবেলা নীরজা পুনরায় তাঁর ডিউটিতে আসেন। তখনও তিনি দেখেন মায়েদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শিশুরা সকলে নিজেদের মতো ঘুমচ্ছে। তিনি অনুভব করেন সন্তানের গুরুত্ব মায়েরা তখনি বুঝতে পারবেন যখন তাঁদের কাছে সন্তান থাকবে না। তিনি ঠিক করেন মায়েরা যখন ঘুমোবে, তখন তাঁদের কাছ থেকে বাচ্চাদের আলাদা করে দেবেন। তাঁদের ঘুম ভাঙলে তিনি দেখতে চান মায়েরা আগের মতো একই রকম চুপচাপ থাকতে পারেন কিনা। সিস্টার নীরজা সারা সন্ধ্যা একাই বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন। প্রতিটি বাচ্চাকে কোলে নিতেই সিস্টার নীরজা মাতৃসুখ অনুভব করেন। তাঁর দুচোখে জল দেখা যায়। তিনি মনে মনে ভাবেন— ‘ভগবান আমাকে মাতৃসুখ থেকে বঞ্চিত করলেও আজ আমি কিছু সময়ের জন্য সাত সাতটি শিশুর পালক মাতা হতে পেরেছি। জন্ম না দিয়েও মাতৃসুখ অনুভব করছি আমি। এই দিনগুলো আমি কখনো ভুলব না। এর আগে আমি অনেক শিশুর দেখাশোনা করলেও আজকের মতো এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। হে ঈশ্বর, এদের মায়েদের এদের মূল্যটা বুঝতে সহায়তা করুন।’

এরপর একে একে সবকটি বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন তিনি। রাত দশটার মধ্যে মায়েরাও সকলে রাতের হালকা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত বারোটার সময় সিস্টার নীরজা একে একে সকল বাচ্চাদের আলাদা একটা ঘরে নিয়ে যান। রাত একটার সময় একজন মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি দেখেন, সিস্টার নীরজা ঘুমে ঢুলছেন। তিনি তাঁর বাচ্চাকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। তাঁর চিৎকারে সকলের ঘুম ভেঙে যায়। সকল মায়েরা তাঁদের সন্তানদের না দেখে কান্না করেন। সিস্টার নীরজা ঘুমের ভান করে বসে থাকেন। সমস্ত ব্যাপারটা তিনি চোখ বন্ধ করে অনুভব করেন। মাঝে মাঝে হালকা চোখ খুলে দেখেন সন্তানদের না দেখে মায়েরা পাগলের মতো আচরণ করেন। একজন আস্তে আস্তে বেড থেকে নেমে সিস্টার নীরজার গায়ে হাত দিয়ে ডাকেন। তৎক্ষণাৎ তিনি ঘুম ভাঙার ভান করেন। তাঁকে মায়েরা জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের বাচ্চারা কোথায় গেল। তিনি জানান ঘুমিয়ে পড়ার কারণে কিছুই তিনি দেখেননি। তাঁর কথা শুনে সকলের কান্না বেড়ে যায়।

সিস্টার নীরজা মায়েদের বলেন— ‘আপনারা কেউ কাঁদবেন না। আপনাদের বাচ্চার কিছুই হয়নি। ওরা সুরক্ষিত ভাবে ঘুমোচ্ছে একটা ঘরে। সন্তানের প্রতি আপনাদের বিমুখভাব কাটানোর জন্য আমি এটা করতে বাধ্য হয়েছি।’ এরপর পাশের ঘর থেকে একে একে সাতটি বাচ্চা এনে সিস্টার নীরজা তাঁদের মায়েদের কোলে তুলে দেন। বাচ্চাকে ফিরে পেয়ে তাঁদের কান্না থামে। প্রত্যেকে সন্তানকে বুকের মধ্যে আগলে রাখেন এবং মাতৃসুধা পান করান। সিস্টার নীরজা তাঁর উদ্দেশ্যে সফল হন। তিনি সাতজন মায়ের উদ্দেশে বলেন— ‘সন্তানের চেয়ে মূল্যবান মায়ের কাছে এই পৃথিবীতে আর নেই। একটা সন্তানের দায়ে কত মা যে প্রাণ হারায়। ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য না করে সবাইকে যোগ্য তৈরি করার দায়িত্ব বাবা-মার নিতে হবে। যাঁরা খুশি নন তাঁদের বোঝাতে হবে, ছেলে-মেয়ের ভেদ করতে বারণ করতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে ছেলে-মেয়ের সমস্যা সমাজ থেকে অবশ্যই দূর হবে।’

সিস্টার নীরজার কথা শুনে সকল মায়ের মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়। তাঁরা সিস্টার নীরজাকে বলেন— ‘দিদি আমরা সকলে কথা দিলাম আজ থেকে আমরা কখনো ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ করবো না। যাঁরা এই ভেদাভেদ করবেন তাঁদের বোঝাব যে, নিজেরা মেয়ে হয়ে মেয়েদের কেন অবজ্ঞা করেন।’ মায়েদের এই পরিবর্তন দেখে সিস্টার নীরজা খুব খুশি হন। সন্তান ও মায়েদের সম্পর্ককে একই সুতোয় বেঁধে দেন তিনি। তাঁর সিস্টার জীবন এভাবেই অন্যকে সহযোগিতা করে সফল হয়ে ওঠে।