• facebook
  • twitter
Saturday, 11 January, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

বিদ্যাসাগরের 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষ- য়ক প্রস্তাব' নামক পুস্তিকা দেশময় এক বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করল।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

বিদ্যাসাগরের ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষ- য়ক প্রস্তাব’ নামক পুস্তিকা দেশময় এক বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করল। বিরোধী পক্ষও নীরব ছিল না। তাঁরা পুস্তিকায় পত্রিকায় প্রতিবাদ জানাতেলাগলেন। বাদ প্রতিবাদ জমে উঠল। বিধবা-বিবাহ আন্দোলনে শুধু বিধবাদেরই লাভ হয়েছে এমন নয়, বাংলা গদ্যেরই লাভ কিছু কম হয়নি। যুক্তি তর্কের ব্যবহারে ভাষা ক্রমেই সজীব এবং সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। রামমোহনের ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক নিবর্তক সংবাদ’ এবং বিদ্যাসাগরের ‘বিধবা বিবাহ বিষয়ক প্রস্তাব’- এই দু-এর মধ্যে কালের ব্যবধান মাত্র পঁয়ত্রিশ বৎসরের।

অতি অল্প কালের মধ্যে বাংলা গদ্যের কতখানি অগ্রগতি হয়েছে তা লক্ষ্য করার মতো। বিদ্যাসাগরের ‘বিধবা-বিবাহ বিষয়ক প্রস্তাব’ থেকে কিয়দংশ উদ্ধৃতি করছি- “দুর্ভাগ্যক্রমে বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে, তাহারা যাবজ্জীবন যে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে, তাহা, যাঁহাদের কন্যা, ভগিনী, পুত্রবধূ অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছেন, তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন। কত শত শত বিধবারা ব্রহ্মচর্য্য নিব্বাহে অসমর্থ হইয়া ব্যাভিচার-দোষে দুষিত ও ভ্রূণ হত্যা কাজে লিপ্ত হইতেছে এবং পতিকূল, পিতৃকূল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে। বিধবা বিবাহের প্রথা প্রচলিত হইলে, অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণার নিবারণ, ব্যাভিচার দোষের ও ভ্রণহত্যা পপের পরিহার ও তিনকূলের কলঙ্ক বিমোচন হইতে পারে।”

এখানে যে বাক্যের গঁধুনি দেখতে পাচ্ছি, এর মধ্যেই বাংলা গদ্যের বাঁধুনি পাকাপাকি ভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছে। এর উপরে ভর করেই বাংলা গদ্য অগ্রসর হয়েছে। সোজা কথায় বাংলা গদ্য এখন সাবালক হয়েছে। যে কোন বিষয়েই সহজবোধ্য ভাষায় সে আলোচনা করতে পারে। যুক্তি তর্ক বিচারে সে কুশলতা অর্জন করেছে। বিধবা বিবাহের সমর্থনে যেমন বহু বিবাহের বিরোধিতায়ও আবার তেমনি শক্তির পরিচয় দিয়েছে বাংলা গদ্য। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও স্বীকার করা কর্তব্য যে বাংলা গদ্যের অগ্রগতিতে অন্যান্য লখক- দেরও কিছু অবদান আছে। ঐ সময়কার পত্র পত্রিকাও এ ব্যাপরে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা ভার বেশ কিছুকাল বিদ্যাসাগর মশায়ের উপরেই ন্যস্ত ছিল।

বিদ্যাসাগরের প্রধান বৈশিষ্টা, বাক্য রচনায় তিনি রীতিমতো শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাক্যের গড়ন এবং শ্রী ছাঁদের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। একটি কৌতুকের কথা মনে পড়ছে। রবীন্দ্র নাথের ‘শেষের কবিতা’ যখন প্রকাশিত হয়, তখন উক্ত গ্রন্থের প্রথম বাক্যটির অমিত রায় ব্যারিস্টার’ উল্লেখ করে আমাদে- রএকজন সাহিত্যিক বলেছিলেন, এতদিনে একটি বাংলা বাক্য পাওয়া গেল যার মধ্যে ক্রিয়াপদ নেই। বলা বাহুল্য সাহিত্যিক বন্ধুটি না ভেবে চিন্তেই কথাটা বলেছিলেন কেন না, গদ্য রচনার প্রারম্ভকালেই বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে- ‘গোপাল বড় সুবোধ বালক’ বাক্যটি ক্রিয়াপদ ছাড়াই রচনা করেছিলেন।

গোড়ার দিকে সকল জিনিসেই একটু জড়তা থাকে। আস্তে আস্তে জট ছাড়িয়ে তাকে সহজ করে নিতে হয়। ক্রমবিকাশের জন্যে যে গুণটি সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজন, সেটি হল সাবলীলতা। ভাষার পক্ষেও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের অনায়াস ক্ষমতা অর্থাৎ বাক্যের বিভিন্ন অংশগুলির সহজ এবং স্বচ্ছন্দ বিন্যাসের কৌশল আয়ত্ত করা একান্ত আবশ্যক। ঐ সুবিন্যস্ত বাক্য রচনার কৌশলটি বিদ্যাসাগরই আমাদের শিখিয়েছেন।

ক্রমশ