• facebook
  • twitter
Friday, 10 January, 2025

কালকূটের অমৃত কুম্ভের সন্ধানের মধ্যে সমরেশ বসুর বিচিত্র জীবন ও সাহিত্য সব একাকার হয়ে গেছে

একাধিকবার সমরেশ কালকূটের মাধ্যমে তাঁর দুর্বিষহ জীবনের কথা বলেছেন। কুম্ভমেলায় ঢোকার আগে ধূলাময় রাস্তায় অসহায়তার মধ্যে তাঁর স্বগতোক্তি : 'জীবনযুদ্ধে প্রাণ তিক্ত হলাহলে পূর্ণ। পথে বেরিয়েছি নিতান্ত একান্তে নিজের হৃদয়-একতারায় সুর তুলে। সেখানে একটানা আনন্দ থাকবে কে বলেছে?'

সমরেশ বসু। ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

১৯৪৬-এর শারদীয় ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘আদাব’ গল্পের মাধ্যমে সমরেশ বসু বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় এসেছিলেন। কিন্তু দারিদ্রের কারণে নিয়মিত সাহিত্যচর্চা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। অর্থ সঞ্চয়ের জন্য ডিম বিক্রি থেকে চটকলের কাজ সবই তাঁকে করতে হয়েছিল। কিন্তু কোথাও তিনি স্থির হতে পারেননি। যেখানে পেটের রসদ জোগানোই দায়, সেখানে মনের রসদে টান পড়াটাই স্বাভাবিক। তার উপর শ্রমিক রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতা ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরূপ মানসিকতা তাঁকে অনায়াসেই অস্থির করে তুলেছিল। শুধু তাই নয়, তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে জেলও খাটতে হয়েছে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, জগদ্দলের সত্যভূষণ দাশগুপ্তের (সত্য মাস্টার) প্রভাবে সমরেশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে পাটশিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় তাঁকেও কারাবরণ করতে হয়েছিল। ১৯৪৮-এর ২৬ মার্চ সরকারিভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়। সমরেশ বসু গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯৪৯-এ, কলকাতার এক মেস থেকে। অবশ্য তার পরের বছরে তিনি কারামুক্ত হন। কেননা ১৯৫০-এর ২৭ ফেব্রুদ্যারি কলিকাতা হাইকোর্ট কমিউনিস্ট পার্টিকে আইনসম্মত বলে আদেশ জারি করে। কিন্তু মুক্তি পেয়েও তাঁর মতো আদর্শব্রতীর পক্ষে পার্টিযুক্ত হওয়াও সম্ভব নয়। ফলে মুচলেকা দিয়ে চাকরি করাও আর তাঁর সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে প্রথাগত শিক্ষাতেও তিনি উচ্চশিক্ষা তো দূর অস্ত, স্কুলের গণ্ডিই অতিক্রম করতে পারেননি। সেদিক থেকেও তাঁর জীবিকার্জনের পথ অন্তরায় হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু তাঁর মতো প্রখর সৃজনশীল প্রতিভার পক্ষে প্রতিকূল আবহও যে তাঁকে দমাতে পারেনি, তাও সহজে অনুমেয়। এজন্য তিনি যখন পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ইছাপুর অস্ত্র কারখানায় চাকরি চলে যাবার পরে হন্যে হয়ে ঘুরে অর্থোপার্জনের কোনোরকম বন্দোবস্ত করতে অপারগ হয়ে উঠলেন, তখনও তাঁর পক্ষে লেখার জগৎ ছেড়ে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। বরং এবার তিনি লেখাকেই জীবিকা করে নেন। অবশ্য তাঁর স্ত্রী গৌরী দেবীও গান শিখিয়েও সামান্য কিছু টাকা পেতেন। ফলে তাঁদের দারিদ্র নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সমরেশের সৃষ্টির তীব্র প্রকাশবেদনার কাছে তা ছিল নিতান্তই নগণ্য ব্যাপার। এজন্য দেখা যায়, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’র আগেই তাঁর অসংখ্য গল্প-উপন্যাস বেরিয়েছে। প্রতিকূল আবহের মধ্যে তার ‘উত্তরঙ্গ’ (১৯৫১), ‘বি টি রোডের ধারে’ (১৯৫২), ‘শ্রীমতী কাফে’ (১৯৫৩), ‘সওদাগর’ (১৯৫৫), ‘গঙ্গা’ (১৯৫৭), ‘বাঘিনী’ (১৯৬০) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মনে-প্রাণে সাহিত্যঅন্তপ্রাণ মানুষটিকে সংসার চালনার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার মাসিক তিনশো টাকা আয়ের রিপোর্টারিও করতে হয়েছিল।

গঙ্গার দু’ধারের শহরতলির মানুষের জীবনযাপন নিয়ে লেখা পাক্ষিক ‘শহরতলির কথা’র মধ্যেই সমরেশের ‘কালকূট’ সংগোপনে জেগে ওঠে। তাঁর দুর্বিষহ জীবনে সৃজনশীল লেখনী দিয়েই তাঁকে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। অবশ্য ‘পরিচয়’ পত্রিকায় উপন্যাস লেখার জন্য তিনি কিছু আয় করতেন এবং তা ছিল একান্তই তাঁকে সহযোগিতা করা। কেননা ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লেখকদের সেভাবে কাউকে লেখার জন্য টাকা দেওয়া হত না। সেক্ষেত্রে ‘আনন্দবাজার’-এর টাকাটা তাঁর পক্ষে বাড়তি অক্সিজেন মনে হয়। দারিদ্রপীড়িত সংসারে শ্রেণিগত দরিদ্রের যন্ত্রণা যত বেশি হয়, একজন প্রতিভাধর সচেতন ব্যক্তির যন্ত্রণা তার চেয়ে অনেকবেশি অসহনীয় হয়ে ওঠে। তার উপর নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে প্রত্যাশিত সমাদর না পেয়ে উল্টে তিক্ত অভিজ্ঞতায় তাঁর যন্ত্রণার মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। তাই তাঁর পক্ষে ‘কালকূট’ নামে রাজনীতির দুর্নীতি প্রকাশ করার সদিচ্ছা সহজ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ‘শহরতলির কথা’র মধ্যে সংগুপ্ত কালকূট মানুষের যাপিত অভিজ্ঞতায় ক্রমে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ফলে সমরেশের মধ্যে একটা সদা চঞ্চল কৌতূহলী পরিব্রাজক মনের ক্ষুধা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত। এই চলিষ্ণুতা তাঁর সহজাত বিশেষত্ব। যা তিনি ব্যক্ত করেছেন মানুষ দেখে ফেরা।

এজন্য তাঁর কাছে গ্রামের থেকে গ্রামবাসী, মেলার চেয়ে মেলায় আগন্তুক ও তীর্থের চেয়ে পুণ্যকামী মানুষজনের কথাই উপজীব্য হয়ে ওঠে। কেননা বিচিত্র মানুষের মধ্যে তিনি নিজেকেই খুঁজে ফিরেছেন। আর তাই ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’-এর শেষের দিকে কালকূটের আত্মসমীক্ষায় উঠে আসে অসংখ্য মানুষের সঙ্গমে অবগাহনের প্রতি বিচিত্র বিস্ময়। তাঁর কথায় : ‘সত্য, আমি ভগবান পেতে ছুটে আসিনি। ডুব দিতে এসেছিলাম লক্ষ হৃদি সায়রে। এখন, এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমার সারা বুক বড় ভারী! সে যে কিসের ভারে এমন পাষাণ হয়েছে জানিনে। এত লক্ষ লক্ষ লোক। আমি ডুব দিলাম, কি ডুব দেওয়ার সময় হয়েছে জানিনে। কিন্তু প্রাণভরে একটা নিশ্বাসও নিতে পারছিনে। কিসে ভরে উঠল মন এমনি করে। কি পেলাম।’ প্রথমের এই মানুষের পরশ পাওয়ার সদিচ্ছার সেই সূত্রক্রমে যখন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র পক্ষে রিপোর্টাজ কভার করার জন্য কুম্ভমেলায় যাওয়ার সুযোগ এল, তখন তিনি তা লুফে নিলেন। আর্থিক দৈন্য স্বীকার করেও তিনি কালকূটকে এগিয়ে দিলেন। এজন্য দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় বক্স ক্যামেরায় তোলা ছবিসহ রিপোর্টাজ প্রকাশিত হলেও সমরেশের সংগ্রহে তখনও অনেক ছিল। আর তাই ‘দেশ’-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সম্মতি ও কানাইলাল সরকারের অনুমোদনে সমরেশ তার কালকূটকে হাজির করলেন ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’। অথচ সেই অমৃত কৃম্ভের মধ্যে তিনি তাঁর বিষ কুম্ভটিকেও প্রদর্শন করেছেন।

‘দেশ’-এ ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ সমরেশের প্রথম রচনা নয়। ১৯৫৩-তে তাঁর স্বনামেই গল্প প্রকাশিত হয়। ফলে সেদিক থেকে ‘দেশ’-এ কালকূটের প্রাদুর্ভাব এবং পাঠকের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা সমরেশের কালকূটকেই শুধুমাত্র পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, সেই সঙ্গে তাঁকেও আর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও সাহিত্যচর্চার জন্য ভাবতে হল না। এই কালকূটের সমধিক জনপ্রিয়তায় সমরেশ বসু সবদিক থেকেই নিজেকে নতুন করে মেলে ধরার অবকাশ পেলেন। কিন্তু তাঁর কালকুটের দুর্বিষহ জীবন তাঁকে আমৃত্যু ভুগিয়েছে। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ সমাগত কালকূট তাঁর বিষ কুম্ভকে অনাবৃত করেননি ঠিকই কিন্তু তাঁর অস্তিত্বকেও অকপট করেছেন। শুধু তাই নয়, একাধিকবার সমরেশ কালকূটের মাধ্যমে তাঁর দুর্বিষহ জীবনের কথা বলেছেন। কুম্ভমেলায় ঢোকার আগে ধূলাময় রাস্তায় অসহায়তার মধ্যে তাঁর স্বগতোক্তি : ‘জীবনযুদ্ধে প্রাণ তিক্ত হলাহলে পূর্ণ। পথে বেরিয়েছি নিতান্ত একান্তে নিজের হৃদয়-একতারায় সুর তুলে। সেখানে একটানা আনন্দ থাকবে কে বলেছে?’

আবার মেলার অস্থায়ী তাঁবুতে ঘুমন্ত অবস্থায় অর্ধচেতনে কৃষ্ণের শতনামের গুঞ্জনে কালকূট মায়ের মুখে শোনা সেই শতনামের অমৃতময় স্মৃতিরোমন্থনের পরেই তাঁর বেদনাজর্জর জীবনের কথা স্মরণ করেছেন : ‘তার পর জীবনের স্রোতে আমি ভেসে গিয়েছি একটি বৃন্তহীন ফুলের মত। যৌবন এসেছে অসহ্য বেদনা ও সংগ্রামের ডাক নিয়ে। পায়ের তলার মাটি বাঁচাতে কবে হারিয়ে গিয়েছে সেই সুর। মায়ের রূপ ধরেছে এই কঠিন পৃথিবী।’ আবার এক ভণ্ড সাপুড়ের কপাল ভালো দেখার কথাতেও কালকূট স্বগতোক্তিতে জানিয়েছেন, ‘বাপ মা আত্মীয় বন্ধুস্বজনে যে কপাল কোনদিন ভাল দেখেনি, সে কপাল আজ অকস্মাৎ এই আলখাল্লাধারীর কাছে ভালো হয়ে ওঠা ভাল নয়।’ ফলে যখনই কোনোভাবে ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ এসেছে, তখনই কালকূটরূপী সমরেশ তাঁর পার্থিব অস্তিত্বকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে তিনি তাঁর অমৃতপিয়াসী প্রকৃতিতেও হাজির করেছেন। এজন্য অপরের জীবনের আলোয় তার প্রতিচ্ছবিকেও স্মরণে এনেছেন তিনি। দেখা যায়, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও নবদ্বীপের পার্শ্ববর্তী আমঘাটার যে নুলো বলরাম শুধুমাত্র মনের জোরে ও বিশ্বাসে কুম্ভমেলার উদ্দেশে রওনা হয়ে ট্রেনের মধ্যে অসহায়ভাবে অপরের পীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও মুখে হাসি অন্তরে অচলাভক্তিতে অটল ছিল, তার জীবনদর্শনে অভিভূত কালকূট তাকে বার-বার স্মরণ করেছেন। যেখানে তাঁর এক পয়সাই ‘মা-বাপ’, সেখানে সেই ‘বাপ-মা’কে হারিয়ে অমৃত প্রাপ্তির প্রত্যাশা প্রকট হয়ে উঠেছে। পাঠককে তাই সচেতন করে কালকূট জানাচ্ছেন : ‘তবুও। উপোস দেব একটি বেলা। ভাবছ, আবেগে হয়েছি অচৈতন্য। হবেও বা। কিন্তু মনের খুঁত-খুঁত রাখব কোথায়। হৃদয়জোড়া বিষকুম্ভ। মনে অশান্তি দিয়ে তাকে আরও ভরে দিই কেন। অমৃতকুম্ভের খোঁজ পাই নে এখনো। ছাড়ি কেন আত্মতৃপ্তিটুকু। চোখের উপর ভেসে উঠছে খালি বলরামের মুখটি।’

আসলে বলরামের অমৃত কুম্ভের পুণ্যকামী মুখটি নয়, তার প্রত্যয়পূর্ণ আস্থার প্রতি কালকূটের দৃষ্টিনিবদ্ধ হয়েছিল। সমরেশের মধ্যের এই জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার প্রত্যয়সিদ্ধ আস্থায় কালকূট সজীব হয়েছিলেন। এজন্য তাঁর প্রতিকূল জীবনপ্রবাহের মধ্যে কালকূটের অমৃত প্রত্যাশার প্রতি সুদৃঢ় আস্থাই তাঁকে ‘অচঞ্চল’ রেখেছিল। দেখা যায় ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ নেমে কালকূটের মাধ্যমে সমরেশ বিচিত্র মানুষের জীবনে সেই বিশ্বাসকেই খুঁজে ফিরেছেন। এই বিশ্বাসের আয়নাতেই বিচিত্র মানুষকে তিনি দেখার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সমরেশ তাঁর নিজের জীবনেও এরকমই প্রত্যয়ে স্থিতধী ছিলেন। যে-কারণে প্রথমে ‘বিবর'(১৯৬৫) ও পরে ‘প্রজাপতি'(১৯৬৭) উপন্যাসের জন্য চরম আঘাত পেয়েও ‘অচঞ্চল’ থাকতে পেরেছিলেন।

শুধু তাই নয়, সেইসঙ্গে তাঁর পারিবারিক জীবনেও নেমে এসেছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। গৌরী দেবী জীবিত থাকাকালীনই তাঁর বোন ধরিত্রীর (টুনি) সঙ্গে প্রণয় সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে সমরেশের ব্যক্তিগত জীবন নতুন করে আবার বিষাক্ত হয়ে ওঠে। আর্থিক দৈন্যের চেয়ে আত্মিক দৈন্যের আঘাত চরম হয়ে থাকে। এজন্য তাঁর পারিবারিক অশান্তির চেয়ে তাঁকে বেশি বাইরের বিষাক্ত সমালোচনা আহত করেছিল। একে উপন্যাসদ্বয়ের বিরূপ সমালোচনা, তার ওপর পারিবারিক সংকট সমরেশকে মানসিক ভাবে বিপর্যন্ত করে তোলে। এজন্য তিনি কোথাও সেভাবে সমর্থন পাননি।

উল্টে নিজের দলের কাছে থেকেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। একদা কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য এবং পরবর্তীকালে স্বনামখাত প্রকাশক তথা সমরেশের প্রথম জীবনে জেলে যাওয়ার আগে যাঁর সঙ্গে একসাথে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন সেই প্রসূন বসু তাঁর ‘কৃতীজনের সান্নিধ্যে’ জানিয়েছেন: ‘সমরেশদা যখন টুনি বৌদিকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধলেন তখন আমাকে জড়িয়ে পড়তে হল। আমি তখন থাকি কাঁকুলিয়া রোডে। সমরেশদা টুনি বৌদিকে নিয়ে এসে উঠেছেন ১৮ নম্বর বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের সি পি এম সাংসদ জ্যোতির্ময় বসুর অতিথি নিবাসে। ওখানে উঠবার পরের দিনই শংকর চট্টোপাধ্যায় আমাকে ডেকে জানাল, সমরেশদা তোকে দেখা করতে বলেছেন। শংকর সেই সময় সমরেশদাকে বেশ সাহায্য করেছিল। আমি একতলার একটি ঘরে সমরেশদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে টুনি বৌদিকে প্রথম দেখলাম। সমরেশদাকে বেশ অপরাধী অপরাধী লাগছিল। বুঝতে পেরেছিলেন আমি এ ব্যাপারটা কিছুতেই মানব না। প্রথম দিকে সত্যিই আমি মানতে পারিনি।’ কিন্তু তার পরেও সমরেশের দুশ্চিন্তা থিতিয়ে আসেনি। সময়ান্তরে তা আরও জটিলতা তৈরি করেছিল। কেননা বৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক না থাকায় ধরিত্রীর গর্ভের সন্তান নিয়েও তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।

সবিতেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ‘কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর’ (তৃতীয় পর্ব)-এ তাঁর সেই মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই সন্তানের দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে তিনি পরম প্রশান্তি লাভ করেছিলেন। সবিতেন্দ্রনাথের কথায়: ‘সমরেশবাবু বললেন, আপনি তো জানেন টুনির সঙ্গে আমার বিবাহ (দ্বিতীয় বিবাহ) ঠিক আইন-সিদ্ধ ছিল না। ছেলেকে নিয়ে ভাবনা ছিল। একটা খবর আমি জানতাম না। আমার এক উকিল বন্ধু জানালেন, বাবা-মায়ের বিবাহ আইনসিদ্ধ না হলেও তাদের সন্তানের বৈধ নাগরিকত্ব পেতে অসুবিধা হবে না। আমার উদিতের (সমরেশ-টুনির সন্তান) জন্য কী পাষাণভার চেপেছিল তা কাকেও বোঝাতে পারতাম না। এখন নিশ্চিন্তে মরতে পারব।’ ফলে সমরেশের জীবনে ঘরে-বাইরে সর্বত্র অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, যা তাঁকে ইচ্ছাসুখের লেখায় স্বতঃপ্রবৃত্ত করে তোলে। সেদিক থেকে তাঁকে কালকূটের লেখনীতে আরও বেশি সক্রিয় হতে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তাঁর মানসভ্রমণেরও ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে ওঠে এবং তাঁর ‘শাম্ব’-এর উজ্জ্বল উপস্থিতি নিবিড়তা লাভ করে ।