প্রতিবেশী বাংলাদেশের ডামাডোল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে চিন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে চিন কার্যত নিশ্চুপ হয়ে আছে। ‘দুই দেশের মানুষের মধ্যে আদানপ্রদানের’ নামে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। বিশেষ করে বাংলাদেশের জামায়তে ইসলামি ও অন্যান্য ইসলামিক সংগঠনের সঙ্গে চিনের মিত্রতা ও বিএনপি’র কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার চিন সফরে সতর্ক নজর রাখছে ভারত সরকার।
২০২৫-এ চিন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী। তাই চিন ২০২৫ সালটিকে দু’দেশের মানুষের মধ্যে আদানপ্রদানের বছর বলে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বড়দিনের আগে চিনে বাংলাদ্শের নয়া রাষ্ট্রদূত নাজমুল ইসলাম চিনের বিদেশ মন্ত্রকের এশীয় বিষয়ক বিভাগের প্রধান নিউ জিনসংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
চিনের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ঢাকার সঙ্গে শীর্ষস্তরে আদানপ্রদানে বেজিং তৈরি। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে চিন প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চায়। যা দেখে ভারতের গোয়েন্দা কর্তা ও কূটনীতিকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার পতনের পরে বাংলাদেশে ‘ভারত বিরোধী’ মনোভাব তৈরি হলেও সে দেশের মানুষের মধ্যে ‘চিন বিরোধিতা’ দেখা-শোনা যায়নি। এটাকেই কাজে লাগাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চিন।
ভারতের এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘সাধারণত মনে করা হয়, পাকিস্তান বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ বাড়াচ্ছে। বাস্তবে পাকিস্তানের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই। আড়ালে চিন বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। চিন এখন সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া জগৎ ও তরুণদের মধ্যে আদানপ্রদান বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। বাংলাদেশে চিনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এখন এ বিষয়ে খুবই তৎপর। গত মাসে ঢাকায় চিনের দূতাবাসে এক অনুষ্ঠানে জামায়তে ইসলামি, হেফাজত-ইসইসলাম, খিলাফত মজলিস, নিজাম-ই-ইসলাম পার্টির মতো প্রতিনিধিরা হাজির হয়েছিলেন। জামায়াতের প্রধান শফিকুর রহমান সেখানে হাজির ছিলেন। এই সংগঠনগুলির একটি দল চিন সফরে যাচ্ছে। তার আগে বিএনপি’র চার শীর্ষ নেতা চিন ঘুরে এসেছেন। বিদেশ মন্ত্রকের এক কূটনীতিক বলেন, আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে চিন একেবারে চুপচাপ। তারা নিজেকে নিরপেক্ষ দেখাতে চাইছে। কিন্তু চিন নিঃশব্দে শিকড় ছড়াতে চাইছে বাংলাদেশ জুড়ে। মুহাম্মদ ইউনূস সরকারে বিদেশ মন্ত্রকের উপদেষ্টা বড় দেশগুলির মধ্যে ভারসাম্যের সম্পর্কের কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের উপর চাপ তৈরি করতে চিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল ৬০০ কোটি ডলারের ঋণ। আগস্টে সরকারের পতনের ঠিক আগেই হাসিনা চিন সফরে গিয়েছিলেন। তিনি এই ঋণের একাংশ আর্থিক অনুদান হিসাবে চেয়েছিলেন। চিন প্রাথমিকভাবে মাত্র ১৩ কোটি ডলারের মতো আর্থিক অনুদানে রাজি হয়। কিন্তু হাসিনা সরকার পতনের পর তা আটকে গিয়েছে। দিল্লির কূটনীতিক মহল মনে করছে, এই ঋণের বোঝাকেও চিন হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাবে। ‘সামগ্রিক কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক’ তৈরির পরে বাংলাদেশ চিন থেকে বিপুল যুদ্ধাস্ত্রও আমদানি করেছে। বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে চিনা বিদেশ মন্ত্রকের কর্তার বৈঠকের পর চিন এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, তারা এবার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে সহযোগিতা বাড়াতে চায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই একই কৌশল নিচ্ছে।
একই সঙ্গে ভারতকে সীমান্ত নিয়ে বিব্রত করেই চলেছে চিন। গত মাসেই ভারত এবং চিনের মধ্যে বিশেষ প্রতিনিধি নিঃশ্বাস ফেলেছিল দিল্লি। মাস গড়াতে না গড়াতেই স্পষ্ট হবে সাউথ ব্লককে। অনেক এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার দু’টি নতুন প্রশাসনিক অঞ্চল বা কাউন্টি গঠনের ঘোষণা করেছে চিন। এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত।
তিব্বতের সাংপো নদীতে চিনের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আপত্তি না জানালেও অববাহিকা অঞ্চলে জলের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার দাবি জানিয়েছে ভারত। এছাড়া ত্বিতে ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ তৈরির চিনের পরিকল্পনা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। এই বাঁধ নির্মাণ ভারত ও বাংলাদেশের নদীজল প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ভারত তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সজাগ ও সচেষ্ট রয়েছে।