রাজকুমার মাহাতো
চেয়ারটা আরও খানিকটা টেনে নিয়ে বসল রুক্মিণী। সামনের জানালার পাল্লা-দুটো সবেমাত্র খুলেছে সে। বিনা অনুমতিতে হেমন্তের শিশির মেশানো হাওয়া এসে ঢুকতে শুরু করেছে ঘরের ভেতরে। পর্দাগুলো সামান্য প্রতিবাদ করছে যদিও তবুও রুক্মিণী জানে ওদেরও ধীরে ধীরে সয়ে যাবে। ল্যাপটপটা অন করতেই সামনে একজন ভদ্রলোকের ছবি ভেসে উঠল। ভদ্রলোকের মাথা-ভর্তি কালো চুল, সরু গোঁফ, চোখদুটোর মধ্যে এক আকাশ নম্রতা, মুখে চওড়া হাসি। পাসওয়ার্ড চাইল ল্যাপটপটি। সরু আঙুলে কি-বোর্ডের উপর চারটে শব্দ টাইপ করল রুক্মিণী। বি-এ-বি-এ, বাবা।
আজকে যে প্লটটা রুক্মিণী মজুমদারের মাথায় এসেছে সেটা একটা বাবা মেয়ের কাহিনী। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুলে লিখতে শুরু করে রুক্মিণী। মাঝে মাঝে তাকায় জানালার বাইরে। ওর এই তেরো তলার ফ্লাটের জানালা দিয়ে গঙ্গানদীকে স্পষ্ট দেখা যায়। দেখা যায় সেই নদীর বুকে আঁচড় কেটে চলা বড় বড় কন্টেইনার বোঝাই জাহাজ অথবা মানুষ বোঝাই ছোট ছোট স্টিমার। জানালার বাইরে একজোড়া শালিক এসে বসেছে। ওরা রোজই আসে। এই জানালাটা খোলা পেলেই একেবারে সোজা ঢুকে পরে বেডরুমে। তারপর রুক্মিণীর লেখার টেবিলে এসে খানিক আওয়াজ দেয়। তখন রুক্মিণী প্রতিদিন ওদের জন্য বরাদ্দ চারটে বিস্কুট ছোট ছোট টুকরো করে ওদের সামনে রাখে। মহানন্দে ওরা সেগুলো খায় তারপর ‘কুঁক’ করে একটা শব্দ করে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই ‘কুঁক’ শব্দটা হয়ত ওদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা। জানেনা রুক্মিণী, কিভাবে ওরা ধন্যবাদ জানায় তবুও ওই শব্দটাই ওকে ধন্যবাদের অনুভূতি দিয়ে যায়।
বেশ খানিকটা লিখে ফেলেছে রুক্মিণী। মাঝে একবার উঠে পাখিগুলোকে বিস্কুট দিয়ে আবার লিখতে শুরু করেছিল। এখন ঘাড়টা বড্ড ব্যথা ব্যথা করছে। ইদানীং ল্যাপটপের সামনে একনাগাড়ে বসে লিখতে পারে না সে। ঘাড়ে বড্ড ব্যথা হয়। মাথা ঝিমঝিম করে। ল্যাপটপ থেকে চোখ সরালেই সামনেটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসে। তাই এখন সে একনাগাড়ে লেখালেখি থেকে বিরত থাকে। কিছুটা লিখে উঠে পরে। কিছুক্ষণ ঘরের ভেতরেই এদিক ওদিক ঘুরে এসে আবার লিখতে বসে।
খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়াল রুক্মিণী। নীচে অবিনাশবাবু তার বছর পাঁচের মেয়েকে নিয়ে খেলছেন। ঠিক এমন করেই বাবাও তাকে নিয়ে খেলত। বিকেলের এই সময়টা বাবা প্রতিদিন তাকে পার্কে নিয়ে যেত। রুক্মিণী তখন সবেমাত্র সাইকেল চালানো শিখছে। বাবা প্রশিক্ষণ-দাতা হিসেবে পিছনের সিটটা ধরে রয়েছে। ‘সামনের দিকে তাকা মা, একদম চাকার দিকে তাকাবি না। সোজা তাকাও রুকু, একদম সোজা।’ বাবার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে হিমেল বাতাসের মধ্যে দিয়ে। রুক্মিণীর বুক দুরুদুরু করছে। সাইলেকের হ্যান্ডেল সামলানো চাট্টিখানি কথা? কিছুটা প্যাডেল মেরে এগিয়ে যেতেই ডিস-ব্যালেন্স হয়ে পড়েই যাচ্ছিল সে। বাবা ধরে নিলো। হাসছেন বাবা। ‘সামনের দিকে তাকাতে হবে মা। সোজা, একদম সোজা তাকাবে।’
রুক্মিণী ভয় পাচ্ছে। না না, সে সাইকেল চালানো শিখতে পারবে না। আচ্ছা, সাইকেল না জানলে ক্ষতিটা কী হবে? কোনও ক্ষতি নেই। পায়ে হেঁটেই তো সব কাজ করা যায় নাকি! তবুও বাবা কেবলই সাইকেল চালানো শেখার তাড়া দিচ্ছেন। ‘আমি পারব না বাবা। কিছুতেই পারব না। হচ্ছে না আমার দ্বারা। পড়ে গেলে লাগবে যে!’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে রুক্মিণী।
‘বেশ, আয় নেমে আয়। তোকে কিছু কথা বলব।’ বাবা শান্ত স্বরে কথাগুলো বলছে।
রুক্মিণী সাইকেল থেকে নেমে এসেছে। বাপ-বেটিতে একটা বেঞ্চিতে বসেছে। বাবা সাইকেলটা স্ট্যান্ড করেছে পাশে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বাবা বলছে, ‘কোন কাজ-কে পারব না বলতে নেই মা। তোমাকে সোজা দেখতে হবে, একদম সোজা। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যত নিচের দিকে তাকাবে ততই পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে। আর পড়ে গেলেই বা কি! আবার উঠবে, আবার এগোবে সামনের দিকে।’
‘আবার পড়ে গেলে? হাত-পা ছড়ে গেলে?’ রুকু ভয় পাচ্ছে? নাকি বাবার কথায় অপমানিত বোধ করছে? বুঝতে পারছে না সে।
বাবা হাসছে। নিজের পাঞ্জাবির হাতাটা অনেকটা গুটিয়ে কনুইটা দেখিয়ে বলছে, ‘এই দেখ। সেই কোন ছোটবেলায় সাইকেল শিখতে গিয়ে পড়ে গিয়ে এই ক্ষতটা তৈরি হয়েছিল। আজও তার দাগ রয়ে গেছে। কিন্তু আমি কি থেমে গেছি? না, থামিনি। পড়েছি, উঠেছি, এগিয়েছি। আবার পড়েছি, আবার উঠেছি, আবার এগিয়েছি… তোমাকেও তাই করতে হবে মা। সবাইকে তাই করতে হয়। পিছন ফিরে দেখতে নেই, একেবারেই না।’
বিকট আওয়াজ করে সামনের গঙ্গার বুক চিরে একটা জাহাজ যাচ্ছে। কেমন যেন আনমনা হয়ে পরেছিল রুক্মিণী। বাবার কথা মনে পড়লে তার ঠোঁটের কোণে যেমন একচিলতে হাসি ফুটে ওঠে, তেমনি আবার চোখের কোণে জলও এসে পরে। বাবা… বাবা… একসময় এই বাবাই ছিল রুক্মিণীর সব। পথপ্রদর্শক। বাবার দেখানো পথেই তো আজ সে চলছে। বাবা তাকে যে পথে চালিত করতে চেয়েছিল, আজ সেই পথই রুক্মিণীর রাজপথ।
আবারও লিখতে বসল সে। বাবা আর মেয়ের গল্প। আচ্ছা, তবে কি সে এই গল্প তার বাবা আর নিজেকে নিয়ে লিখছে? না না, তা কী করে হয়। তার নিজের গল্প কেন সে লিখবে? কেন নিজের ব্যক্তিগত জীবন জনসমক্ষে নিয়ে আসবে? এসব সে কোনদিন করেনা, করবেও না। তার সোশ্যাল মিডিয়ার ফ্যান ফলোয়ার প্রচুর। তবুও সে কোনোদিন নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে সোশ্যাল মিডিয়ায় উন্মুক্ত করেনি। আর করার কোন ইচ্ছেও তার নেই।
বাবারও স্বপ্ন ছিল একদিন সে বড় লেখক হবে। লিখত বাবা, খুব ভালো লিখত। প্রকৃতি আর সমাজের মেলবন্ধনে সৃষ্টি করত এক অদ্ভুত পৃথিবী। সমাজের না-বলা কথাগুলো লিখতে খুব ভালবাসত বাবা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত হতে চাইত। বাবা কতবার যে ঘাটশিলাতে গৌরীকুঞ্জে গিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। একাই সকালের ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরে বেরিয়ে পড়ত। আবার পরদিন ইস্পাতে করেই ফিরে আসত। সঙ্গে করে নিয়ে আসত সুবর্ণরেখার জলে তোড়ে ক্ষয়ে যাওয়া পাথর আর নিয়ে আসত শব্দ। কাঁড়ি কাঁড়ি শব্দ। বাবা বলত, সে নাকি ঘাটশিলা গেলে শব্দ খুঁজে পেত, প্লট খুঁজে পেত। গৌরীকুঞ্জ, সুবর্ণরেখা, ধারাগিরি শব্দ উপহার দিত বাবাকে, প্লট উপহার দিত।
একটা চিৎকারের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না? কে চিৎকার করছে এই সময়? মা? রুক্মিণীর মা? হ্যাঁ, ঠিকই শুনছে রুক্মিণী। মা চিৎকার করছে। সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবা। বাবার মুখটা বড় অসহায় লাগছে। বাবার এই অসহায়তা রুক্মিণীর খুব চেনা। বাবার এই অসহায়তার সঙ্গে অনেকদিন আগেই পরিচয় হয়েছে রুক্মিণীর। মা চিৎকার করে বলেছে, ‘খাওয়াতে পারবে না তো বিয়ে করেছিলে কেন? কেন রুকুকে আনতে বাধ্য করেছিলে?’ মা বাবার দিকে তাকিয়ে কৌতুকের হাসি হাসছে। কী বিচ্ছিরি সে হাসি। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবার চোখের কোণে জল। মা চিৎকার করছে। আরও জোড়ে চিৎকার করছে, ‘লেখক হবে, স্বামী আমার লেখক হবে! শোনো তোমার ওই ছাইপাঁশ লিখে সংসার চলবে না। হাঁড়িতে জল ফুটবে, চাল জুটবে না। আগে নিজের বৌ-বাচ্চার পেটের ভাত জোগাড় করো। তারপর খাতা কলমে মুখ গুঁজে পরে থেকো।’ এই চিৎকার আর সহ্য হয়না রুক্মিণীর। একেবারেই সহ্য হয় না। কী ভীষণ, কী বেদনাদায়ক মায়ের এই চিৎকার।
বাবা এসে বসেছে রুক্মিণীর পাশে। ‘অগ্নিদেবের শয্যা’ পড়ছে রুক্মিণী। সিলেবাসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাবা। বাবার এই মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়াটা রুক্মিণীর ভীষণ কাছের। কত কী যে ভুলিয়ে দেয় এই একটু স্নেহের ছোঁয়া। বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রুক্মিণী। মা গজগজ করতে করতে নিজের কাজে লেগে পরেছে। বাবা মুচকি হেসে বলছে, ‘ওসবে কান দিসনা মা। তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে। সবসময় সামনের দিকে তাকাবে, পিছনে ফিরে দেখবে না। কোনও চিৎকার যেন তোমাকে থামাতে না পারে। কোনও চিৎকারেই তুমি কান দেবে না। প্রতিজ্ঞা কর আমায়, কর…’
স্কুলের অঙ্ক খাতাটা ফুরিয়ে এসেছে। বাবাকে বলতে হবে। কিন্তু কীভাবে বলছে বুঝতে পারছে না রুক্মিণী। আজ প্রায় মাস-ছয়েক হয়ে গেল বাবা বাড়িতে বসে রয়েছে। কী একটা কারণে বাবার চাকরিটা চলে গেছে। নাকি এই লেখালেখির চক্করে বাবা নিজেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে; সেটা জানেনা রুক্মিণী। মা রোজ চিৎকার করছে, বাবাকে যা নয় তাই বলছে। হুমকি দিচ্ছে একটা চাকরি না জোগাড় করতে পারলে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। বাবা রোজ সকালে চাকরির খোঁজে বেরোচ্ছে কিন্তু…
গল্পটা আজকেই শেষ করতে হবে রুক্মিণীকে। আগামীকাল পত্রিকার অফিসে মেইল করতে হবে। যদিও এটা আমন্ত্রিত গল্প। পুজো সংখ্যায় ছাপা হবে। একটা ছোটগল্পের জন্য এখন বেশ ভালোই টাকা চার্জ করে রুক্মিণী। আর উপন্যাস হলে তো কথাই নেই। গত পাঁচটা বইমেলায় তার বই বেস্টসেলার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই সময়ের কয়েকজন নামকরা লেখক লেখিকার মধ্যে তার নামটাই হয়ত প্রথমে আসে। এখন গল্প দেওয়ার আগেই তাকে পেমেন্ট দিতে হয় পাবলিশারদের। চুক্তিটা এইরকমই থাকে— যেদিন পেমেন্ট আসবে তারপর থেকে পাঁচদিনের মাথায় গল্পটি পাবেন পাবলিশাররা। আর উপন্যাসের ক্ষেত্রে নিয়মটা একটু আলাদা। অর্ধেক পেমেন্ট করলে তবে শুরু হয় উপন্যাস লেখার কাজ তারপর রুক্মিণী যেদিন উপন্যাসটা সম্পূর্ণ করে, সেইদিন সে পাবলিশারকে ফোন করে জানালে বাকি অর্ধেক টাকাটা আক্যাউন্টে ক্রেডিট হলে তবেই সেই পাবলিশার পান সেই উপন্যাস।
এইসব নিয়মগুলো একান্তই রুক্মিণীর। বাবাকে দেখে শেখা। সাধা-সিধে লোক পেয়ে কম পাবলিশার ঠকায়নি বাবাকে! রাত-দিন এক করে লিখে জমা দেওয়া লেখা ছাপা হওয়ার পরে পাবলিশারদের দোরগোড়ায় পরে থেকেও সেই লেখার রয়্যালটি পাননি তিনি। কত লেখকও ঠকিয়েছেন তাঁকে। তাঁর লেখা নিজের নামে চালাতেও দ্বিধা করেননি সেইসব লেখকেরা। কিন্তু বাবা কোনদিন প্রতিবাদ করেননি। আসলে লোকটা প্রতিবাদ করতে জানতেন না মনে হয়। প্রতিবাদ শব্দটার সঙ্গে ঠিকমত পরিচয় হয়ত ছিল না বাবার।
পুজো এসেছে। বাবা রুক্মিণীর জন্য একখানা ফ্রক কিনে এনেছেন। মায়ের জন্য একখানা শাড়ি। খুব খুশি আজকে তিনি। বৌ-বাচ্চার জন্য এইটুকু করতে পেরেই অনেকটা খুশি। রুক্মিণীর খুব পছন্দ হয়েছে জামাটা। লালের উপর সাদা রঙের ফুল আঁকা জামা। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে জামাটা। কিন্তু মায়ের মুখ ভার। সারাবছরের শেষে পুজোতে এই একটা ছাপা শাড়ি? তাও এত কম দামী? পছন্দ হয়নি মায়ের। পাশের বাড়ির রতি কাকিমাকে তার বর জামদানী দিয়েছে এবারের পুজোয়, মিন্টুর মাকে তার বাবা ঢাকাই দিয়েছে। আর বাবা কিনা কিনে এনেছে একখানা ছাপা শাড়ি! তাও আবার কম দামী! চিৎকার শুরু করেছে মা। ভীষণ চিৎকার। রুক্মিণী জামাটা বুকে জড়িয়ে কানে হাত চাপা দিয়ে বসে আছে। না না, এ চিৎকার সহ্য হয়না তার। একেবারেই না।
বাবা এতক্ষণ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার শুনছিলেন। এখন ধীরে ধীরে তিনি এসেছেন রুক্মিণীর কাছে। ‘রুকু, মা আমার। তোমার পছন্দ হয়েছে জামাটা?’ বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
আচ্ছা বাবার চোখে কি জল? হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছে রুকু বাবার চোখের কোণে জল। জামাটা বুকে চেপে উঠে দাঁড়িয়েছে রুকু। বাবার চোখের জল মুছে দিচ্ছে সে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘খুব পছন্দ বাবা, খুব পছন্দ।’
বাবা জড়িয়ে ধরেছে তাকে। কঠিন লোকটার বুকের ভেতর কেমন যেন শব্দ হচ্ছে। তবে কি এই শব্দই বাবাকে তাড়া করে বেড়ায়? এই শব্দকেই খাতার পাতায় তুলতে বাবাকে এতকিছু সহ্য করতে হয়?
আবার চিৎকারটা শোনা গেল। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছে রুক্মিণী। ‘লেখক হবে, লেখক। বৌ-বাচ্চাকে খাওয়ানোর মুরোদ নেই সে আবার হবে লেখক!’ দাঁত পিষছে মা। চিৎকার করছে আবারও। রুক্মিণী ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশের ঘরের দরজা খুলে উঁকি দিল। বিছানায় শুয়ে আছেন এক মহিলা। সাদা চুল, পরনে নাইটি। বয়সের ভারে ঝুলে যাওয়া চামড়া আর তীব্র কণ্ঠস্বর নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। রুক্মিণীর মা।
ঘরে ঢুকে তার পাশে বসল রুক্মিণী। ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘চিৎকার করছ কেন মা? তোমার চিৎকার শোনার লোকটা যে আর নেই।’
বৃদ্ধা উঠে বসতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না। শরীরে বল নেই, তবে কণ্ঠস্বরে ঠিক আছে। চিৎকার করে বললেন, ‘কে বলছে নেই। দেখ-না… দেখ… কেমন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শুনছে। ওই… ওই-তো দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে পাচ্ছিস রুকু? তুই দেখতে পাচ্ছিস?’
হ্যাঁ, রুকু দেখতে পাচ্ছে। দশমীর দিন। মা তাকে সিঁদুর খেলতে নিয়ে গিয়েছিলেন পাড়ার মণ্ডপে। রুকু আবির মেখেছে। আজ সে বাবার দেওয়া লালের উপর সাদা ফুল ছাপ ফ্রকটা পরেছে। দৌড়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকেছে সে। কিন্তু বাবা অমন ঝুলছে কেন? বাবার চোখদুটো কেমন ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। জিভটা অনেকটা মুখের অনেকটা বাইরে ঝুলছে। আর ফ্যানের সঙ্গে ওটা কী বাঁধা? মায়ের সেই ছাপা শাড়িটা না, যেটা এবছর বাবা মা-কে দিয়েছিল। মা বাবার পায়ের নীচে বসে আছে। মায়ের সিঁথিতে চওড়া লাল সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে।
রুক্মিণী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়াকে বলল, ‘ঘুমের ওষুধটা না-হয় দিয়ে দাও। নাহলে চেঁচাতেই থাকবে। এ চিৎকার আর সহ্য হয় না আমার।’