• facebook
  • twitter
Friday, 27 December, 2024

হলদি নদীর কিনারে…

হলদিয়া একটি বহুল পরিচিত জনপদ। হলদি নদীর নাম মিলিয়েই এই বন্দর শহরটির নাম হয়েছে হলদিয়া। হলদি ও হুগলী নদীর সঙ্গমে, সাজানো গোছানো বন্দরনগরীটি ঘুরে এলেন মধুছন্দা মিত্র ঘোষ।

ফাইল চিত্র

শীতের বিকেল ছাপিয়ে নদীকে ছুঁয়ে দিচ্ছে হলদে আঁধার। মনোহর এক নদীর কাছে এনে ফেলেছে আমাকে। প্রকৃতির বুকের ভেতর দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে হলদি নদী। শীতের সময় চড়ুইভাতির আসর বসে, অন্য সময় বেশ নির্জন। কলকাতার দিক থেকে এলে, সবচেয়ে কাছাকাছি ঠিকানাগুলির মধ্যে একটি হল হলদিয়া। শহরের একধার দিয়ে বয়ে যাওয়া হলদি নদী, আজও তার পুরনো রূপ কিছুটা ধরে রাখতে পেরেছে।

এখানকার নদী, নদীপাড়, ঘাট, গাছপালা, আবাসন, দোকান-বাজার, অফিস, নতুন নতুন হোটেল- এইসব নিয়েই আধা শহরের চেনা ছবি। ভিড় কম। যানজট নেই তেমন। যদিও নগরায়ণের কারণে হলদিয়ার পুরনো পরিবেশ আর নেই বললেই চলে। শহরে প্রবেশের মুখে বিশাল বিশাল ডাম্পার, এক্সকাভেটর, স্প্রেডার মেশিন, এবং রোলার মেশিনের যাঁতাকলে ঘিঞ্জি হয়ে আছে কিছুটা এলাকা। এইসব পেরিয়েই ঢুকে গেলাম মূল উপনগরীতে।

দেখি আইভিলতা, বোগেনভিলিয়া, কৃষ্ণচূড়া, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া গাছের ডালগুলো, কোয়ার্টার বাড়িগুলোর গায়ে উপচে উঠেছে। তাদের রেণু মেখে লুটিয়ে রয়েছে ফুলের গুচ্ছ দেওয়ালে-পাঁচিলে। কদমফুলের গন্ধ ঘেরা আলোছায়ার মাঝে আনমনা শীতের বাতাস যেন কথা কয়। ধোঁয়াশার আবডালে জেগে থাকে কোয়ার্টারগুলি। এই আশ্চর্য বন্দর-শহরে সন্ধে নেমে এলে, পর্যটক-মনে কেমন এক পুলক লাগে। ওদিকে বন্দর ছেড়ে যাওয়া জাহাজের ভোঁ, আমাকে আনমনা করে। একনিষ্ঠ প্রেমিকার মতো বার বার ছুটে আসি, যে-কোনও পছন্দের নদী ঘেরা জনপদে, চুর্ণ হব বলে।

বিকেল নিভে আসছে। সন্ধের আবহে হলদিয়া উপনগরী কেমন যেন এক নরম আলোয় মোড়া থাকে। রাস্তায় নরম নিয়ন আলোগুলি চুঁইয়ে তির্যকভাবে পথে পড়েছে। মৃদু রৌণক ছড়াচ্ছে সেই ভেজা ভেজা আলো। তারপর চোখের সামনে সন্ধে নামলেই স্পষ্ট হতে থাকে রাতের আকাশ ও আলো। এই আলো মনখারাপ করাবে নির্ঘাত। বিকেল নিভলেই জলজ ঘ্রাণের মাতাল গন্ধ ঢুকে পড়ে অস্থি মজ্জায়। মিশে যায় প্রশ্বাসে।

হলদি নদীর নাম মিলিয়েই এই বন্দর শহরটির নাম হলদিয়া। ডাইনে তার হুগলী তথা ভাগীরথী নদী। আর পশ্চিম পানে বয়ে চলেছে কাঁসাই বা কংসাবতী নদী ও কেলেঘাই নদীর ভাবসম্মিলনে পুষ্ট হলদি নদী। সে নদী আবছা একটা বাঁক নিয়েই চলে গেছে আরও দূরে। এ নদীর নামটিও কেমন যেন মায়াময়। হলদি।

পশ্চিমবাংলার পর্যটন মানচিত্রে হলদিয়া একটি বহুল পরিচিত জনপদ। ভৌগলিক ও শিল্পনগরী দুই দিক থেকেই জনপদটির গুরুত্ব রয়েছে। এই হলদি ও হুগলী নদীর সঙ্গমে সাজানো গোছানো উপনগরী তথা বন্দরনগরী হলদিয়া। বন্দরের লকগেটের কাছে নদীর কোল ঘেঁষে সুসজ্জিত বিদ্যাসাগর পার্ক, ওদিকে অয়েল জেটির কাছে সেন্টিনারি পার্ক, সাঁঝ-সকালে পায়ে পায়ে হেঁটে দিব্যি বেড়িয়ে নেওয়া যায়।

ইন্ডিয়ান কোস্ট গার্ড-এর হেড কোয়ার্টারও হলদিয়া। এখানে ভাসমান পোতাশ্রয় রয়েছে একটি। স্থানীয় তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, এই বন্দরের লকগেটটি, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লকগেট। যেটির মাপ ১০১০ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৩০ ফুট প্রস্থ, গভীরতা ৪৮ ফুট। পণ্য ওঠানামা ও বহনযোগ্য ব্যবস্থায় সর্বদা ব্যস্ত হলদিয়া বন্দর চত্বর। অতি উৎসাহীরা বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে হলদিয়া বন্দরের ‘জহর টাওয়ার’ থেকে দেখে নিতে পারেন বন্দরটি। তথ্য জানায়, কর্মদক্ষতায় ভারত-সেরা পুরস্কারে ভূষিত এই হলদিয়া বন্দরের বিস্তৃত এলাকাখানি। সারা দিনমান অসংখ্য জাহাজের আনাগোনা দেখতে দেখতেই কেটে যাবে সময়। সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। আর সন্ধ্যের পাট নামলেই নদীর জাহাজের লাল-নীল-সবুজ-হলুদ, নানান বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করে ওঠে পাড়ে নোঙর করা জাহাজের বাতিগুলি।

কলকাতার ভিড়ভাট্টা, শহুরে যাপন থেকে একটু সতেজ হতে, হলদি নদীর পাড় ঘেঁষা সাধাসিধে বন্দরনগরী হলদিয়াকে পরিকল্পনায় রাখি। ‘বিশ্ব বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি উৎসব’-এর আমন্ত্রিত কবি হিসেবে পর পর দুই বৎসর হলদিয়া উপকণ্ঠে বেড়াতে আসা। হলদিয়ার ডক কমপ্লেক্সের, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট টাউনশিপের, বিবি ঘোষ অডিটোরিয়ামের অনুষ্ঠান চলছে।

এই সুবাদে স্থানীয় অটো বুক করে ঘুরে নিচ্ছি হলদিয়ার আনাচকানাচ। আমার লক্ষ্য এখানকার জনজীবনকে দেখা ও তথ্য সংগ্রহ। গল্পে গল্পে জেনে নিই কীভাবে অনবরত পরিবর্তন ও সংযোজনের পথ ধরে গড়ে উঠেছে আজকের হলদিয়া।

আমরা যারা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি, তাদেরও কিছু প্রকারভেদ আছে। কেউ প্রাকৃতিক পরিবেশে মোহিত। কেউ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। কেউ আবার সাধরণ কোনও স্থানে এলেও জায়গাটার নদী ঘাট পথ প্রান্তর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ান, সেই জায়গাটির ইতিহাস খোঁজেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমারও ইচ্ছে থাকে জায়গাটিকে জানার। বন্দর এলাকা ঘুরে বিকেল পাঁচটার একটু আগেই তড়িঘড়ি ফিরে আসি হোটেলে।
এবার মনস্থ করেছি দেড় দিন থাকব। তাই পরদিন চলে যাই হলদি নদীপাড়ে। হলদির পাড়টা সান্ধ্য মজলিসের পক্ষে আদর্শ এক্কেবারে। আড্ডা জমে গেল। খালি গলায় গানও। রবীন্দ্র গান। সঙ্গে নিয়ে আসা চিপসের প্যাকেট আর ঠান্ডা পানীয় নিমেষে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নদীকিনারে ভেজা হিম ভাব।

নদী ও বন্দর শহরের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হলদিয়ার প্রতিটি কোনায়। একদিকে হুগলী নদী, নদীর মাঝে প্রকৃতিদত্ত ছোট্ট একটি দ্বীপ নয়াচর- অন্য পাশে হলদি নদী। ৬৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে হলদিয়ার নব্য আকর্ষণ এই নয়াচর। ১৯৮৮ সালে নয়াচরের নামান্তর হয়েছিল ‘মীন দ্বীপ’। ২০০০ সাল থেকে তো মৎস্যজীবীদের রুজিরুটির একান্ত অঞ্চলরূপে গড়ে উঠেছে মীন দ্বীপ, পর্যটনস্থল রূপেও ইদানিং খুবই প্রাধান্য পাচ্ছে। শীতের মরসুমে পরিযায়ী পাখিদের এন্তার জটলা বসে এখানে। রাজ্য সরকারি বদান্যতায় এখানে গড়ে উঠেছে মৎস্যদপ্তরের চিংড়ি প্রকল্প।

ভারতে হলদিয়াই একমাত্র বন্দর এলাকা, যেখানে আস্ত একটা জাপানি গঞ্জ আছে। এটা কিন্তু আগে আমার জানা ছিল না। এই জাপানি এলাকাটির নাম ‘সাতাকু’। এখানে বেশ কয়েকটি রেস্তরাঁ রয়েছে, যেখানে জাপানি নানান খাদ্য-পানীয় মেলে। স্থানীয় একটি সিনেমা হলও রয়েছে। সেখানে দেখানো হয় জাপানি ফিল্ম। হলদিয়া মিৎসুবিশি কেমিক্যাল কর্পোরেশনের কর্তাব্যাক্তিরা ও কর্মচারীরা এখানকার আবাসিক। পরদিন সকালে সেই অটোওলাকে ফোনে ডেকে নিই, ওদিকটায় এক চক্কর ঘুরে আসব বলে।

আকাশচুম্বী বার্নারটি দেখা যাচ্ছিল দূর থেকেই। ৪৫৫ একর ব্যাপ্ত হলদিয়া অয়েল রিফাইনারির বার্নারটি থেকে গলগল করে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে হলদিয়ার মাথার ওপরের আকাশটা। হলদিয়া ফার্টিলাইজার, এশিয়ার বৃহত্তম পেট্রোকেমিকাল ছাড়াও অন্যান্য নানান শিল্প কারখানাও গড়ে উঠেছে হলদিয়ায়। এখানকার হলদিয়া ভবনে থাকার চমৎকার বন্দোবস্ত আছে। আরও রয়েছে ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার বিশ্রামগৃহ, পি ডবলু ডি ইরিগেশন ইন্সপেকশন বাংলো ও গোনাগুনতি কিছু হোটেল।

আজ বিকেলের আগে আগেই ফেরার পথ ধরতে হবে। কিন্তু মন বলছে আবার আসতে হবে। যে-সাজানো গোছানো পথ ফেলে এসেছি হলদি নদীর তীর বরাবর, সে পথে আবারও কোনও আধ ভেজা বিকেলে হাঁটার জন্য আসতেই হবে। হাতছানি দেয় ভাঁড়ের চা, আরামের চুমুক আর হলদি নদীর তীরের বাঁধানো বসার জায়গাটা।