মুম্বই হামলার ধাঁচে ফের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ সফল করতে নতুন পন্থা অবলম্বন করে আনসার-উল্লাহ বাংলা টিম ওরফে এবিটি। প্ল্যান যাতে নিখুঁতভাবে সাজানো যায়, এবং কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারেন, সেজন্য রাজ্যের কিশোরদের বেছে নিয়েছিল এই জঙ্গি গোষ্ঠী। তাদেরকে সুইসাইড বম্বার হিসেবে কাজে লাগানোই এদের লক্ষ্য ছিল। এজন্য কিশোরদের মগজধোলাই করার কৌশল করে এই টিমের সদস্যরা। এই পরিকল্পনার আঁতুড়ঘর হিসেবে মুর্শিদাবাদকেই প্রধান ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয় তারা।
সম্প্রতি মিনারুল শেখ ও মহম্মদ আব্বাস সহ অসম, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আট সদস্যকে লাগাতার জেরা করে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে বলে দাবি করেছে অসম পুলিশের এসটিএফ। ধৃতদের জেরা করে যা তথ্য উঠে এসেছে, তার রিপোর্ট ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সেই মতো দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিকে আরও সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অসম এসটিএফ দাবি করেছে, ধৃতরা সকলেই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার-উল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য।
অসম পুলিশের স্পেশ্যাল ডিজি হরমিত সিংহ বলেন, ‘সারা ভারত জুড়ে একাধিক জায়গায় বড়সড় নাশকতার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনের সাহায্য নিয়েই সব ছক সাজানো হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে আসতে পারে। সেজন্য ধৃতদের এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া থেকে ধৃত মিনারুল শেখ এবং মহম্মদ আব্বাসের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এলাকার ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সি ছেলেমেয়েকে চিহ্নিত করে তাদের মাদ্রাসায় নিয়ে আসা। কারণ সেখানে নিয়ে এইসব অল্পবয়সী কিশোরদের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে মগজ ধোলাই করা খুবই সহজ হবে। টার্গেট ছিল, কমপক্ষে এইধরনের ৩০ জন কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে সুইসাইড বম্বার স্কোয়াড তৈরি করা। তাদেরকে ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়। এই উদ্দেশ্য সফল করতে নিখুঁতভাবে ছক কষা হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালীন যাতে বিষয়টি কেউ আঁচ করতে না পারে, সেজন্য মুর্শিদাবাদকে মূল ঘাঁটি হিসেবে রেখে এইসব কিশোর-কিশোরীদের বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অসম এসটিএফ রাজ্যকে সতর্ক করে জানিয়েছে, এই টিমের বেশ কয়েকজন জঙ্গি এখনও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেশ কিছু জায়গায় আত্মগোপন করে রয়েছে।
অসম এসটিএফ আরও দাবি করেছে, বিএসএফ-এর আউটপোস্ট ও জেলা পুলিশের দপ্তরে নাশকতা ঘটানোই আনসার-উল্লাহ বাংলা টিমের মূল লক্ষ্য ছিল। এই জঙ্গিদের নজরে ছিল উত্তর দিনাজপুর ও শিলিগুড়ি করিডোরের চারটি গ্রাম। এই গ্রামগুলি চিহ্নিত করে স্থানীয় গরিব মহিলাদের হাত করার চেষ্টা করে। যাদের ঢাল করে বিএসএফ-কে আটকানো সহজ হবে। সেজন্য এইসব গরিব মহিলাদের আর্থিক সাহায্য দিয়ে দলে টানার চেষ্টা করা হয়।
উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে কেরল থেকে শাব আলি নামে আরও এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, এই ব্যক্তিও হরিহরপাড়ার কেদারতলায় থাকত। সেখানে তাঁর কাকা ও পিসির বাড়ি। মুর্শিদাবাদে থাকার সময়ে তার সঙ্গে মিনারুল ও আব্বাসের সখ্য তৈরি হয়। সূত্রের খবর, এলাকার কিশোর-কিশোরীদের প্রশিক্ষণ নিয়ে আনসার-উল্লাহের বাংলা শাখার দুই নেতা আমির এবং জসিমদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকও করে শাব। সেই মতোই ছোট ছোট মাদ্রাসায় এলইডি স্ক্রিন লাগিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এইসব কিশোর-কিশোরীদের জঙ্গি কার্যকলাপে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি নেতাদের বক্তৃতাও শোনানো হত এইসব কেন্দ্রে। মগজধোলাইয়ের পর তাদের কিভাবে অস্ত্রচালনা করতে হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে পাঠানোরও পরিকল্পনা করেছিল মিনারুল ও আব্বাসেরা।
তবে এই বৃহত্তর নাশকতার জন্য রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলাকে জঙ্গিরা যে সেফ জোন মনে করে, তার আরও প্রমাণ পাওয়া গেল সোমবার সোহেল রানা সহ আরও তিন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারের পর। লালগোলা স্টেশন সংলগ্ন এলাকা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে সোহেলকে। সে নকল আধার কার্ড বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করলেও এতদিন ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি পুলিশ-প্রশাসন। এমনকি স্থানীয় বাসিন্দারা জানতে পারলেও তার বসবাস নিয়ে কোনোদিন কোনও অভিযোগ করেনি প্রশাসনের কাছে। এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশ থেকে এসে নাম পরিচয় গোপন করে নকল পরিচয়পত্র তৈরি করে বসবাসের ঘটনা আকচার ঘটে থাকে বলে সূত্রের খবর। তাদের কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করে হয় জন-মজুরের কাজ অথবা ব্যবসা করছে, না হলে কোনও অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।
এই তিনজনের মধ্যে লালগোলার বালিগ্রাম থেকে অলিউল আলম নামে আরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধেও বেআইনিভাবে আধার কার্ডের ঠিকানা পরিবর্তন করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া সাহারুল মোল্লা নামে আরও একজন দালালকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসতে সাহায্য করার অভিযোগ রয়েছে। তাকে জলঙ্গি থানার দয়ারামপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধৃত এই তিন ব্যক্তিকে মঙ্গলবার লালবাগ আদালতে পেশ করা হয়েছে।
সূত্রের খবর, ধৃত সোহেলের বাড়ি বাংলাদেশে। সে আধার কার্ডে তার বাবা ও মায়ের নামের জায়গায় নিজের পিসেমশাই ও পিসির নাম নথিভুক্ত করে। লালগোলা থানার আটরশিয়ার বাসিন্দা পিসেমশাইয়ের নাম আব্দুল রশিদ ও পিসির নাম শেফালি বিবি। অথচ তার নিজের বাবা ও মায়ের নাম সাইফুল ইসলাম ও জুলেখা বিবি। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি এলাকায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সোহেল প্রায় সাত বছর আগে ভারতে এসে চেন্নাই সহ বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকের কাজ করত। এখানে সে তার পিসির মেয়ে সেলিনা খাতুনকে বিয়ে করে দ্বিতীয় সংসার পাতে। ইদানিং সোহেল আধার কার্ডে তার ঠিকানা পরিবর্তন করে। ফলে সার্বিক বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যাচ্ছে, মুর্শিদাবাদ জেলা যে জঙ্গি ও আন্তর্জাতিক অপরাধীদের একটি মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।