বার্ধক্য আমাদের শরীরের গতিশীলতা এবং জয়েন্টের কার্যকারিতাকেও ব্যাহত করে। বর্ধক্য সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে শরীরের জয়েন্টগুলিকে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হল হাঁটু। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতি এতটাই গুরুতর হয় যে, মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম করার ক্ষমতাও ক্রমশ লোপ পেতে থাকে। তখন ডাক্তারের কাছে হাঁটু প্রতিস্থাপন করার জন্য অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া ছাড়া, অন্য কোনও বিকল্প থাকে না। আধুনিক সময়ে রোবটিক সার্জারি হাঁটু প্রতিস্থাপনে অত্যন্ত কার্যকর। জেনে নেওয়া যাক এর খুঁটিনাটি।
রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার কাকে বলে?
রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার (Robotic Knee Replacement Surgery) একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে রোবোটিক কারিগরি, শল্যচিকিৎসককে একটি ক্ষতিগ্রস্ত বা জীর্ণ হাঁটু জয়েন্ট প্রতিস্থাপন করতে সহায়তা করে। রোবটটি সুনির্দিষ্ট পরিমাপ করে, নিশ্চিত করে যেন ইমপ্লান্ট নিখুঁতভাবে ফিট করে। এর ফলে সার্জারির পরে রোগীদের আরও ভালো ফলাফল যেমন হয়, তেমনই কম ব্যথা এবং দ্রুত আরোগ্য লাভও হয়।
কোন পরিস্থিতিতে একজন রোগীকে এই অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়?
একজন রোগীকে রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যদি নিম্নোক্ত বিষয়গুলি থাকে-
১. গ্রেড ৩ বা গ্রেড ৪ অস্টিওআর্থারাইটিস কিংবা আঘাতের কারণে গুরুতর হাঁটু ব্যথা বা স্টিফনেস
২. হাঁটতে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে বা দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে অসুবিধা হলে
৩. ওষুধ, শারীরিক চিকিৎসা বা ফিজিওথেরাপি থেকে সামান্য বা কোনও স্বস্তি পাওয়া না গেলে
৪. হাঁটুর গাঁটের এমন গুরুতর ক্ষতি হয়ে থাকলে, যা জীবনযাত্রার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
এই অস্ত্রোপচার করতে কত সময় লাগে?
রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার হতে সাধারণত প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগে। তবে রোগীর অবস্থা এবং অসুখের জটিলতার উপর নির্ভর করে, সঠিক সময় পরিবর্তিত হতে পারে। এছাড়াও ওটি-র আগে এবং পরে কিছু সময় লাগে।
এই অসুখের পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার কী?
রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপনের জন্য অস্ত্রোপচার-পরবর্তী যত্নের মধ্যে রয়েছে-
বিশ্রাম – যথাযথ বিশ্রাম নিন, ভারী কাজকর্ম এড়িয়ে চলুন, আপনার হাঁটু নিরাময়ের জন্য সময় দিন।
থেরাপি- শক্তি এবং স্বাভাবিক হাঁটাচলার ক্ষমতা ফিরে পেতে নির্দিষ্ট রিহ্যাব এক্সারসাইজগুলি অনুসরণ করুন।
ওষুধ- ব্যথা উপশম এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সময়মতো ওষুধ খান।
ক্ষতের যত্ন- সার্জারির জায়গাটি পরিষ্কার এবং শুকনো রাখুন।
ফলো-আপ ভিজিট- যদিও রোবোটিক হাঁটুর অস্ত্রোপচারের পরে নিরাময়ের সময় খুব কম লাগে, তবে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে শল্যচিকিৎসকের কাছে চেক-আপের জন্য যান।
জীবনযাত্রায় সাবধানতা- ওজন বহন করা, বা বেশি পরিশ্রমের কাজগুলি এড়িয়ে চলুন । দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
এই অস্ত্রোপচার হওয়া একজন রোগীর পরবর্তীকালে কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয় ?
যা যা করবেন
প্রতিদিন হাঁটা এবং নির্ধারিত ব্যায়ামের মতো হালকা ক্রিয়াকলাপ করুন যাতে সচল থাকতে পারেন।
হাঁটুর উপর চাপ কমাতে নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করুন এবং নিয়মিত চেক-আপ করুন। চিকিৎসকের নির্দেশিকা অনুসরণ করুন।
সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হাঁটাচলার অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত, সাপোর্টের জন্য ওয়াকার ব্যবহার করুন।
ভালো পশ্চার মেনটেইন করুন, এটা হাঁটুর গাঁটকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
যা যা করবেন না
ভারী পরিশ্রমের কাজ, বিশেষ করে ওজন তোলা এড়িয়ে চলুন। দৌড়নো, লাফ দেওয়া করবেন না।
ব্যথা উপেক্ষা করবেন না। কোনও অস্বাভাবিক অস্বস্তি বা ফোলাভাব থাকলে ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করুন।
দ্রুততার সঙ্গে হাঁটু বাঁকানোর মতো কার্যকলাপের সময় সতর্ক থাকুন।
একটানা বেশিক্ষণ বসবেন না। হাঁটতে হাঁটতে এবং পা প্রসারিত করার সময় বিরতি নিন।
ধূমপান বা অতিরিক্ত অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন। এগুলি রিকভারির গতি কমিয়ে দিতে পারে এবং অস্থিসন্ধির স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
এই অস্ত্রোপচারের জন্য কোনও বয়সের মাপকাঠি আছে কি?
রোবোটিক হাঁটু প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারের জন্য কোনও বিশেষ বয়সের সীমারেখা নেই। এটি মূলত রোগীর অবস্থার উপর ভিত্তি করে সুপারিশ করা হয়।
কিছু কম বয়সি রোগীরও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে, যদি বাত বা আঘাত তাদের জীবনকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে থাকে। বয়স্ক রোগীদের অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়, যখন তাদের হাঁটুর এক্স-রে, গ্রেড ৩ বা গ্রেড ৪ অস্টিওআর্থারাইটিসের ইঙ্গিত দেয় এবং ওষুধ দিয়ে ব্যথা কমানো যায় না। অস্ত্রোপচারের জন্য বিলম্ব করা উচিত নয় কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বাড়তে থাকে এবং পরে এটি আপনার নিতম্ব এবং গোড়ালির জয়েন্টগুলিতেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ডাক্তাররা রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং হাঁটুর অবস্থাকে গুরুত্ব দেন, বয়সকে নয়।
কীভাবে রোবোটিক অস্ত্রোপচার, সাধারণ অস্ত্রোপচারের পদ্ধতির চেয়ে সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে ?
হাঁটুর ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে রোবোটিক হাঁটু অস্ত্রোপচার, নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের একটি বড় অগ্রগতি। প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় এর বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। যেমন প্রিসিশন, বা নির্ভুলতার ক্ষমতা। রোবট হাড়ের সঠিক পুনর্বিন্যাস এবং ইমপ্লান্ট স্থাপনে সহায়তা করে। রোগীর শরীরের অবস্থা অনুযায়ী সঠিক ফলাফল দেয়।
এছাড়া এই প্রযুক্তিটি রোগীর শারীরবৃত্তির সঙ্গে কার্যত সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনামাফিক অস্ত্রোপচার করার সুযোগ দেয়। এতে কম ব্যথা এবং কম অস্বস্তি হয় কারণ, অস্ত্রোপচারটি স্টিচলেস এবং স্টেপললেস।
রোগীরা অস্ত্রোপচারের পরে একই দিনে হাঁটতে পারেন এবং ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারেন।
দাগ কম হয় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কম। ইমপ্লান্টের পর দীর্ঘদিন আর হাঁটুর সমস্যায় পড়তে হয় না।