(পর্ব-৯)
সুখেন্দু হীরা
রামকিঙ্করের জীবনী-উপন্যাস লিখতে গিয়ে সমরেশ বসুর উপলব্ধি, “সবথেকে বড় কথা রামকিঙ্কর ব্যক্তি হিসেবে একেবারে আগাগোড়া শিল্পী। এবং তাঁর সমস্ত ভাবনাচিন্তা যা কিছু, তাঁর জীবনযাপনও অনেকটাই চালিত হয়েছে তাঁর শিল্পভাবনার দ্বারা।”
এই কারণে রামকিঙ্কর আত্মভোলা হয়ে থাকতেন, জগতের কোনও বিষয়ে তিনি বিচলিত হতেন না। শুধু তাই নয় নিজের নিন্দা বা প্রশংসা দুটোতেই তিনি অবিচল থাকতেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন–
“খ্যাতি বা যশ বা অর্থ– কোনোটা নিয়ে তো কোনোদিন ভাবিনি। ও সব নিয়ে বেশি ভাবলে কাজ করা যায় না। অর্থ তো পরবর্তী সময়ে এসেছে, আবার চলেও গেছে। ধরে রাখতে পারেনি। ধরে রেখে লাভই বা কী হত? কলকাতা শহরের অনেক উঁচুতে একটা ফ্ল্যাট? তাতে আমার মুক্তি কোথায়? এখনো তো স্বচ্ছলতার মুখ দেখা যায়। বেশি আকাঙ্ক্ষা নেই। শান্তিনিকেতনের আগানে-বাগানে যে-সব মূর্তি গড়েছি, তার ব্যয়ভার বহন করেছে কর্তৃপক্ষ। নিজে পয়সা নিইনি। বিক্রি করিনি। আমি মনে করি, আর্ট বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। কোনো সমসাময়িক বা অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পী আমার তুলনায় বেশি পাবলিসিটি পেয়ে যাচ্ছে বা পপুলার হয়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ছবি সংরক্ষণ সম্বন্ধেও কখনও বিশেষ ভাবিনি। ভাবার সময় পাইনি।”
তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র, সবার থেকে আলাদা। আলাপচারির ভূমিকাতে সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন– “যাঁর মৌলিকতা অবিসংবাদিত, যিনি দাগা বুলোননি কখনও, না পূর্বের না পশ্চিমের, যিনি স্বতন্ত্র, স্বপথচারী। কেউ কেউ তাঁকে দেখেন অথবা দেখতে ভালো বাসেন এক ছন্নছাড়া বোহেমিয়ান আর্টিস্ট হিসেবে। বস্তুত তাঁর জীবনযাপনের ঢঙ পশ্চিমী বোহেমিয়ান আর্টিস্টদের থেকে অনেক আলাদা, বরং তাঁকে এদেশের উদাসীন বাউলের কাছের মানুষ বলে মনে হয়।”
এই উদাসীন বাউল চরিত্রের জন্য শান্তিনিকেতনের কলাভবনের অধ্যক্ষের পদ প্রাপ্তি হয়নি। অথচ তিনি কলাভবনে ওয়েল পেইন্টিং, মূর্তি নির্মাণ শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন। আবিষ্কার করেছিলেন থ্রোয়িং পদ্ধতিতে সরাসরি ভাস্কর্য নির্মাণ। ভারতে বিমূর্ত শিল্প (Abstract Art)-এর জনক ছিলেন তিনি।
রামকিঙ্করের আক্ষেপ করে একবার বলেছিলেন, “বাঁকুড়ায় কিছুই করিনি। কলকাতায় কিছু নেই। এখানের এই শান্তিনিকেতনের এগুলো ওই কংক্রিট পর্যন্ত। একটা দুটো ব্রঞ্জ হলে হয়তো থাকত।”
অথচ রামকিঙ্করের মনের ইচ্ছা ছিল শুধু মূর্তি তৈরি করে যাওয়া। তিনি এক সম্বর্ধনা সভায় বলেছিলেন, “ছেলেবেলা থেকে আমার একটাই ইচ্ছে ছিল যেখান দিয়ে যাব রাস্তার ধারে ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো, বর্ষণাতুর আকাশের তলায় বড়ো বড়ো মূর্তি দেখতে ভালো লাগে। তার সূচনা শান্তিনিকেতন থেকে শুরু হয়েছে। সামান্য কাজ হয়েছে। ব্রতটি রয়ে গেল। মৃত্যুবার্ষিকী পর্যন্ত থাকবে আশা করি।”
রামকিঙ্কর এই ব্রত নিয়েই জীবন শেষ করেছিলেন। বাঁকুড়াবাসী একটা কথা ভেবে গর্ববোধ করতে পারেন যদি রামকিঙ্কর বাঁকুড়া ছেড়ে শান্তিনিকেতন না যেতেন, তাহলে বাংলার তথা ভারত এক মহান শিল্পীকে পেত না এবং বিশ্বের দরবারে ভারতীয় শিল্পকলা একটু গরিব থেকে যেতো।
রামকিঙ্করকে নিয়ে বাঁকুড়াবাসী যে যে কারণে গর্ববোধ করতে পারেন, তাঁর একটা তালিকা দেওয়া হল-
১৯৩৫ : ‘শ্যামলী’র মাটির দেওয়ালে করেন হাই- রিলিফের কাজ। এখানে নন্দলাল ও অন্যদের কাজ আছে।
থ্রোয়িং পদ্ধতিতে ডাইরেক্ট কংক্রিটে করেন তাঁর সর্বপ্রথম পরিবেশীয় ভাস্কর্য ‘সুজাতা’।
১৯৩৬: সিনিয়র ছাত্রদের নিয়ে আরম্ভ করেন ব্ল্যাক হাউস বা কালো বাড়ির মাটির দেওয়ালে রিলিফের কাজ।
১৯৩৭: মডেলিং শেখানোর দায়িত্ব নেন। শেষ করেন কালো বাড়ির কাজ।
১৯৩৮: খ্রিষ্টাব্দে রামকিঙ্কর তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত (Abstract) প্রতিকৃতি ভাস্কর্য ‘পোয়েটস হেড’।
এই বছরের শেষের দিকে ডাইরেক্ট কংক্রিটে করেন তাঁর অন্যতম বিখ্যাত পরিবেশীয় ভাস্কর্য ‘সাঁওতাল পরিবার।
১৯৪০: পুরোনো গেস্ট হাউসের সামনে সিমেন্টে করেন বিমূর্ত পরিবেশীয় ভাস্কর্য ‘ল্যাম্পস্ট্যান্ড’ বা ‘বাতিদান’। এই কাজটিকেই ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম বিমূর্ত ভাস্কর্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
১৯৪১: রবীন্দ্রনাথের মূর্ত আবক্ষ প্রতিকৃতি ভাস্কর্য।
১৯৪৫: ‘নেপাল ওয়ার মেমোরিয়াল’-এর জন্য কয়েকটি ভাস্কর্য তৈরির কাজে নেপাল যাওয়া, নেপাল সরকারের আমন্ত্রণে।
১৯৫৬: ৯ অক্টোবর তাঁর করা রবীন্দ্রনাথের মূর্ত আবক্ষ প্রতিকৃতি ভাস্কর্যের ব্রোঞ্জের প্রতিলিপি ভারত সরকার কর্তৃক হাঙ্গেরির বালাতন হ্রদের তীরে স্থাপন।
১৯৬৪: নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ শেষ করেন রিজার্ভ ব্যাংকের জন্য ‘যক্ষ-যক্ষী’।
১৯৬৮: আসাম সরকারের জন্য ডাইরেক্ট কংক্রিটে করেন কলাভবনের মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য ‘মহাত্মা গান্ধী’। পরের বছর এর ব্রোঞ্জের প্রতিলিপি আসাম সরকার কর্তৃক গৃহীত।
১৯৬৯: হরিসাধন দাশগুপ্ত তাঁকে নিয়ে করেন তথ্যচিত্র।
১৯৭০: ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত।
১৯৭৩: জুলাই মাসে দেবব্রত রায়ের পরিচালনায় ভারত সরকারের সিনেমা বিভাগ তাঁকে নিয়ে করে চল্লিশ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘রামকিঙ্কর’।
১৯৭৫: জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত, নৃত্যনাট্য ও চারুকলা অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে তাঁকে চারুকলায় ‘৭৪-‘৭৫ সালের বাৎসরিক পুরস্কার প্রদান।
১৯৭৬: ললিতকলা অ্যাকাডেমির ‘ফেলো’ নির্বাচিত। ৬ আগস্ট ললিতকলা অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে শান্তিনিকেতনে তাঁর সংবর্ধনা।
১৯৭৭: ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত।
১৯৭৯: ২২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত।
[সমাপ্ত]
তথ্য ঋণ:
১) শিল্পী রামকিঙ্কর: আলাপচারি – সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (দে’জ পাবলিশিং)
২) রামকিঙ্কর অন্তরে বাহিরে – সম্পাদনা প্রকাশ দাস (দীপ প্রকাশন)
৩) বাংলার আভাস: রামকিঙ্কর শতবর্ষ সংখ্যা – সম্পাদক আশীষ পাণ্ডে, অতিথি সম্পাদক স্বপন কুমার ঘোষ।