• facebook
  • twitter
Monday, 23 December, 2024

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

আমাদের দেশে শতকরা ষাট জন মানুষ নিরক্ষর। তাদের যদি বলা যায়, তারা মুখে যে-কথা বলছে তার নাম গদ্য তাহলে তারাও খুব অবাক হবে। কারণ গদ্য পদ্য ইত্যাদি কথা তারা শোনেনি, জানেও না, চেনেও না।

ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

ঐ ব্যক্তিটি নাটকের একটি কমিক চরিত্র। তাকে হাস্যাস্পদ করবার জন্যই কথাটা তার মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে কথাটা খুব হাস্যকর নয়।

আমাদের দেশে শতকরা ষাট জন মানুষ নিরক্ষর। তাদের যদি বলা যায়, তারা মুখে যে-কথা বলছে তার নাম গদ্য তাহলে তারাও খুব অবাক হবে। কারণ গদ্য পদ্য ইত্যাদি কথা তারা শোনেনি, জানেও না, চেনেও না। তবে বললে বোধ করি ভুল হবে না যে নিত্যদিনের আটপৌরে ভাষাটাকে একটু অবজ্ঞাভরেই নাম দেওয়া হয়েছে গদ্য। ইংরেজি prose কথাটিও বড় সম্মানসূচক নয়, কারণ ইংরেজিতে prosaic উক্তি বা রচনা বলতে বোঝায় শুষ্ক নীরস বস্তু। অবজ্ঞার ভাবটি সুস্পষ্ট।

মুখের ভাষাকে যখন লিখিত আকারে প্রকাশ করা হল তখন শুধু তার আকার নয়, প্রকারেরও বদল হল। ছন্দ মিলের সহযোগে জিনিসটা সকলের কাছে শ্রুতিমধুর মনে হল। ছন্দোবদ্ধ পদকে আদর করে নাম দেওয়া হল পদ্য। ছন্দের নূপুর বাজিয়ে পদ্য দিব্যি নেচে বেড়াতে লাগল; পরে এক সময়ে কেউ যখন তাতে সুর জুড়ে দিল তখন সে সুরের ডানা মেলে উড়তেও শিখে গেল। এই যে ভাষার রূপান্তর ঘটল, এটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা। যুগান্তকারী বলছি এই কারণে যে ভাষার জীবনে এক যুগ গিয়ে নতুন যুগের সূচনা হল, সাহিত্যের জন্ম হল।
ভাষা আর সাহিত্যকে আমরা একসঙ্গে মিলিয়ে দেখি, ভাবি দুটিতে মিলে এক জুটি। দু’এর মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সম্পর্ক খুব বেশি দিনের নয়। ভাব প্রকাশের সংকেত হিসাবে ভাষার জন্ম মানুষের জন্মাবধি— লক্ষ লক্ষ বছর আগে। সে তুলনায় সাহিত্য এই সেদিনের আগন্তুক। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে নানা ভাষায় সাহিত্যের যেসব প্রাচীনতম নিদর্শন মানুষের হাতে এসেছে তার বয়স কয়েক হাজার বছরের বেশি বলে মনে হয় না।

ভাষা আগে, সাহিত্য পরে এবং অ-নে-ক পরে। সাহিত্য জিনিসটা মনে মেজাজে শৌখিন। কিন্তু সেই আদি যুগে শখের কথা ভাববার সময় ছিল কোথায়? আদি মনুষ প্রাণরক্ষার চিন্তাতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত। জীবন ধারণের অত্যাবশ্যক সামগ্রীসমূহ—অন্ন বস্ত্র বাসগৃহসম্পর্কে যখন নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে, বিশেষ করে কৃষিবিদ্যাটি যখন সে আয়ত্ত করেছে তখনই সর্বপ্রথম মানুষের হাতে একটু বাড়তিসময় বা অবসর সময় এল। বাড়তি সময়ে বাড়তি কাজ অর্থাৎ অত্যাবশ্যককে ছাড়িয়ে উদ্বৃত্তের সন্ধান। শুধু খাওয়া-পরার চিন্তা নিয়ে যে জীবন সেটাও নিতান্তই আটপৌরে ব্যাপার। তাই দিয়েই কেটে গিয়েছে কত শত বছর। এতদিনে একটু শখের কথা ভাববার সময় পেল। অবসর সময়ে অনেকে মিলে জটলা পাকিয়ে বসে গান করেছে, গল্প-গুজব করেছে। অবসর বিনোদনের মধ্যেই মানুষের গুণপনার প্রকাশ। নিত্তনৈমিত্তিকের ঊর্ধ্বে যে উদ্বৃত্তটুকু মানুষের মধ্যে লুক্কায়িত থাকে অবসর সময়ে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে।

(ক্রমশ)