একে কোন ভাষায় বর্ণনা করব? সাংসদদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব? নাকি সরকার ও বিরোধী পক্ষের সাংসদদের মধ্যে বিদ্বেষ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ? একে অপরকে সহ্য না করার ঘটনা। বৃহস্পতিবার সংসদ চত্বরে নজিরবিহীনভাবে ধাক্কাধাক্কি, একে অপরের দিকে তেড়ে যাওয়া, ধস্তাধস্তির মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন কংগ্রেস ও বিজেপির সাংসদরা। অল্পবিস্তর আহত হলেন অনেকেই। ঘটল রক্তপাতও। শীতকালীন অধিবেশনে এই দুই পক্ষের মধ্যে এই অশালীন, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা সংসদের ইতিহাসে লেখা থাকবে। নিজেদের মধ্যে কার কত শক্তি জাহির করার পর, উভয় পক্ষের তরফেই পার্লামেন্ট স্ট্রিট থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করা হল। সংসদ চত্বর যে এভাবে সাংসদদের রণক্ষেত্র হয়ে উঠবে, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন? ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে দু’জন বিজেপি সাংসদের। পরে তাঁদের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। অন্যরা যাঁরা অল্পবিস্তর চোট পেয়েছিলেন তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। পায়ে চোট লাগে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের।
অভাবনীয় এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেলিফোনকরে ঘটনার খোঁজ নেন। লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা আহত দুই সাংসদকে দেখতে যান। বিজেপি বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধির বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেছেন। তাতে ১০৯ ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এই ধারায় দোষী সাব্যক্ত হলে তাঁর ১০ বছর কারাদণ্ড হতে পরে। পরে পুলিশ এই ধারাটি বাদ দিয়ে দেয়। ঘটনার সূত্রপাত বাবাসাহেব আম্বেদকরকে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অশোভন মন্তব্য। এইদিন আম্বেদকরের মূর্তির সামনে কংগ্রেসের ধর্না— দাবি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অশালীন মন্তব্যের জন্য তাঁকে ক্ষমতা চাইতে হবে।এই ধর্নায় যোগ দেন তৃণমূল বাদে, অন্যান্য বিরোধী দলের সাংসদরা। বিজেপির সাংসদরা সেখানে জড়ো হন। একটা সময় রাহুল গান্ধি সংসদে প্রবেশ করতে গেলে দুই পক্ষের সাংসদদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। পরে তা ধস্তাধস্তিতে পরিণত হয়। কংগ্রেস পরে স্থানীয় থানায় গিয়ে মারমুখী বিজেপি সাংসদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।
সংসদের উভয় কক্ষে এই অধিবেশনে যা ঘটল তাকে বর্ণনা বা সমালোচনা করার ভাষা নেই। বিজেপি ও কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে এই বিবাদ ছাড়া, অন্য একটি কারণে এই অধিবেশন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রাজ্যসভার ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম সবার চেয়ারম্যান, যিনি উপরাষ্ট্রপতি, ধনকড়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ, পরে তা খারিজ হয়ে যায়। কংগ্রেস সংসদের অভিযোগ, যেখানে সদস্যরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশি কথা বলবেন, সেখানে চেয়ারম্যান নিজেই বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করেছেন। বিজেপি সাংসদদের অভিযোগ, রাহুল গান্ধিই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তাঁদের আক্রমণ করেন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তাঁর এই মনোভাব কোনও মতেই সমর্থন করা যায় না।
সংসদ চত্বরে বিজেপি ও কংগ্রেস সাংসদদের মধ্যে যা ঘটল, তা শুনে ও কাগজে পড়ে দেশবাসী স্তম্ভিত। এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা তো নীচুতলার দলীয় কর্মীদের মধ্যে ঘটে। দেশের মানুষ ভোট দিয়ে জয়ী করে সাংসদদের সংসদের অধিবেশনে পাঠান তাঁদের অভাব, অভিযোগ, নানা অনুন্নয়নের বিষয় সংসদে তুলে ধরতে। তাঁরা কমবেশি সবাই শিক্ষিত। তাঁরাই দেশের উন্নয়ন সংক্রান্ত এবং সরকারের কাজকর্মে কোনও ত্রুটি থাকলে তা নিয়ে সরব হন। সরকার যেসব বিল সংসদে পেশ করবে, তার ওপর বিতর্ক হবে—বিরোধী সাংসদরা তাতে কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে তা নিয়ে সমালোচনা করবেন।
কিন্তু তাঁদের তো নিজেদের মধ্যে কোনও বিষয় নিয়ে সরাসরি ধস্তাধস্তি করার জন্য সংসদে পাঠাননি দেশবাসী। বিরোধীরা এবং সরকার পক্ষের সাংসদদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হবে ঠিকই, কিন্তু তাতে অশালীনতা স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু সংসদের বাইরে এসে যদি গোলমাল করেন, তা অত্যন্ত নিন্দার ও গর্হিত। সাংসদদের এই আচরণ কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। দেশবাসী ভাবতেই পারেন না যাঁদের তাঁরা ভোটে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠান, তাঁরা এই আচরণ করবেন। একজন সাংসদের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছুই থাকে। তাঁদের আচরণ এমন হবে, যা দেখে বর্তমান প্রজন্ম শিখবে। তাঁরা মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হবেন। দেশের উন্নয়নে অথবা যেসব কেন্দ্র থেকে তাঁরা জীয় হয়েছেন, সেখানকার কোনও সমস্যা থাকলে তা সরকারের কাছে তুলে ধরবেন।
একজন সাংসদের কেন্দ্রে সাধারণত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র থাকে। প্রতিট কেন্দ্রেই সংশ্লিষ্ট সাংসদের মাঝে মাঝে যাওয়া উচিত সেই কেন্দ্রগুলির সমস্যাদি সরেজমিনে জানতে। তাঁদের তা সরকারের কাছ তুলে ধরে সেসব সমস্যার সমাধান করতে। একজন সাংসদের দায়দায়িত্ব অপরিসীম। সেই দায়িত্ব পালন করা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
সংসদের প্রতিটি অধিবেশনে সাংসদদের অসহযোগিতার জন্য কাজ বেশি হয় না। সংসদের মধ্যে প্রবল বাকবিতণ্ডার কারণে বার বার অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করতে হয় অধ্যক্ষকে। অথচ একটি অধিবেশনে সরকারের খরচ হয় লক্ষাধিক টাকা। এই বিষয়টি সাংসদদের মাথায় রাখা উচিত। দেশবাসী তাঁদের মারামারি করতে সংসদে পাঠাননি।