• facebook
  • twitter
Sunday, 22 December, 2024

সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ চলবে, এটাই কি বিশ্বগুরুর ভবিষ্যৎ?

সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ চলবে, এটাই আইন— ঘোষণা করেছেন উত্তর প্রদেশের ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব।

ফাইল ছবি

সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ চলবে, এটাই আইন— ঘোষণা করেছেন ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি শেখর কুমার যাদব। আদালতে বিচারপতির আসনে বসে নয়, কথাটি তিনি বলেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনুষ্ঠানে। এক জন বিচারপতি কী করে এমন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন বা সেখানে বক্তৃতা করেন, বর্তমান ভারতে সেই সব প্রশ্নের আর কোনও স্থান নেই। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারপতি সরাসরি সংখ্যাগুরুবাদ প্রচার করলে এ দেশে এখনও প্রশ্ন ওঠে। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ শোনা গিয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে, তাঁকে বিচারপতির আসন থেকে অপসারণে উদ্যোগী হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন কেউ কেউ।

বাস্তবিকই, শ্রীযুক্ত যাদবের মন্তব্যটি গভীর ভাবে উদ্বেগজনক। আপন মতের বিশদ ব্যাখ্যা করে তিনি জানিয়েছেন, এই দেশের নাম হিন্দুস্থান, এখানে গরু, গীতা আর গঙ্গার পূজা হয়, এ দেশে প্রতিটি শিশুই রাম। তথ্য হিসাবে উক্তিটি উদ্ভট— হিন্দু নাগরিকদের এক বিপুল অংশের কাছে এই কথাগুলির কোনও অর্থই নেই। কিন্তু গবাদি (গো+আদি) দেবদেবীর উপাসকরা তথ্য বা যুক্তির ধার ধারেন না। হিন্দু কথাটিকে তাঁরা যে অর্থে বুঝতে চান সেটি আগমার্কা হিন্দুত্ববাদী অভিধান থেকে নেওয়া। তাঁদের অবস্থান ষোলো আনা রাজনৈতিক অবস্থান। সেই রাজনীতির নাম সংখ্যাগুরুতন্ত্র। তার বীজমন্ত্র: হিন্দুর দেশ হিন্দুর ইচ্ছা অনুসারেই চলবে।সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা’ কেন বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কেবল তাত্ত্বিক পরিসরেই নয়, রাজনীতির ভুবনেও। স্বাধীন ভারতের প্রথম পর্বে এই বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন নেতানেত্রীর অনেকেই, জওহরলাল নেহরু যাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য।

পরবর্তী কালে, বিশেষত উনিশশো আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সঙ্ঘ পরিবারের আগ্রাসী অভিযান এবং তার পরিণামে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রভূত সাফল্য বুঝিয়ে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন রাজনীতিকদের সেই সতর্কবাণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক দিকে নির্বাচনী গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর শক্তিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে ‘হিন্দু’ সত্তাকে একজোট করা এবং অন্য দিকে সেই সত্তাটিকে উত্তরোত্তর অসহিষ্ণু ও আগ্রাসী করে তোলা— এই দ্বিমুখী কৌশল প্রয়োগে সঙ্ঘ পরিবারের বিরাম নেই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভায় বিচারপতি যাদবের উক্তি তারই অনুসারী।

বলা বাহুল্য, সংখ্যাগুরুতন্ত্রের এই ধারণাটি প্রকৃত গণতন্ত্রের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে। গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর মতামত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন মত এবং জীবনাচরণের বিভিন্ন রূপ ও রীতিকে স্বাধীন অনুশীলনের সুযোগ দেওয়া, সমস্ত ধর্মমতের অনুসারীদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং বিশেষত সমস্ত ধরনের সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করা।
প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে প্রতিবেশী বাংলাদেশে সেই অধিকার নিপীড়িত হওয়ার নানা অভিযোগ প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকেও প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছে। লক্ষণীয় এই যে, সেই প্রতিবাদে বিশেষ উৎসাহ সহকারে শরিক হচ্ছেন সঙ্ঘ পরিবারের অনুগামীরাও। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, বাংলাদেশের হিন্দুস্বার্থের ‘পাশে দাঁড়িয়ে’ তাঁরা ভারতে আপন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর। কিন্তু এই তৎপরতা যে এক বিচিত্র পরিহাসের সৃষ্টি করছে, সেটা কি তাঁরা খেয়াল করেছেন? সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষা যদি গণতন্ত্রের ধর্ম হয়, তবে ‘সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা’ সেই ধর্মের উপরে স্থান পায় কী করে? প্রতিবেশী দেশের জন্য যে নিয়ম, সঙ্ঘ পরিবারের আপন দেশে তার বিপরীত বিধান? মনে পড়ছে মৌসুমী ভৌমিকের গানের কথা “ওখানে তুমি সংখ্যালঘু,এখানে তুমি জমজমাট”।

স্পষ্টতই, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে প্রকৃত গণতন্ত্রকে মেলানোর কোনও উপায় নেই। সংখ্যাগুরুবাদ এবং গণতন্ত্র অনিবার্য ভাবে পরস্পরবিরোধী। শেখর কুমার যাদবের ভাষণ সেই সত্যকেই আরও এক বার উদ্ঘাটিত করেছে। দাবানল যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আপাতত তার বন্দোবস্ত হয়েছে। কম কথা নয়। ধর্মস্থানের চরিত্র বদল নিষিদ্ধ করে ১৯৯১ সালে প্রণীত আইনটি সংবিধানসম্মত কি না, সেই প্রশ্ন সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। প্রধান বিচারপতি-সহ তিন বিচারকের বেঞ্চ জানিয়েছে, এই অবস্থায় কোনও আদালতে ধর্মীয় উপাসনাস্থলের চরিত্র বদল সংক্রান্ত নতুন কোনও মামলা গ্রাহ্য হবে না, যে-সব মামলা চলছে সেগুলির ক্ষেত্রেও কোনও কার্যকর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা যাবে না, বিশেষত ধর্মস্থানের চরিত্র বিচারের জন্য কোনও সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া চলবে না। গত দু’বছরে দেশের নানা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মসজিদ বা দরগার অতীত যাচাইয়ের আবেদন জানিয়ে বিভিন্ন আদালতে মামলা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে প্রত্ন-সমীক্ষার নির্দেশও দিয়েছে আদালত। এই সব মামলা এবং নির্দেশকে কেন্দ্র করে অনিবার্য উদ্বেগ ও অশান্তি বেড়ে চলেছে। গত মাসে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে এমন এক মামলার সঙ্গে সঙ্গে সমীক্ষার নির্দেশ এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রাণঘাতী হিংসার কাহিনি সর্বজনবিদিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তটি আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রশমিত করতে পারে। আপাতত।আশঙ্কা দূর হয়েছে, এমন কথা বলার উপায় নেই।

ধর্মস্থানের ইতিহাস খুঁড়ে দেখার যে প্রবণতা চতুর্দিকে অশান্তি, উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, সেটি ষোলো আনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির ইতিহাস সেই রাজনীতির, আক্ষরিক অর্থেই, যুগান্তকারী অধ্যায়। সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান এবং যুক্তসাধনার ভিত্তিতে গড়ে তোলা গণতন্ত্রের ধারণাকে সরাসরি অস্বীকার করে ধর্মাশ্রিত সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির আগুনে সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির হাতিয়ার তৈরি করার যে পথ প্রায় চার দশক আগে উন্মোচিত হয়েছিল, ভারত সেই পথে বহু দূর অবধি এগিয়ে গিয়েছে। পিছন দিকে এগিয়ে গিয়েছে বলাই যুক্তিযুক্ত। সংখ্যালঘুর উপাসনাস্থল খুঁড়ে খুঁড়ে সংখ্যাগুরুর উপাসনাস্থলের চিহ্ন ‘আবিষ্কার’ করার যে ধুন্ধুমার তৎপরতা এখন দেখা যাচ্ছে, সেই ভয়ঙ্কর অভিযানের মধ্যে কোনও যথার্থ ধার্মিকতা নেই, নেই ইতিহাস-চর্চার কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা, এ কেবল ‘হিন্দু ভোট’ এককাট্টা করার ষড়যন্ত্র।

অযোধ্যা নামক ‘ঝাঁকি’র ফসল গোলাঘরে উঠেছে, এখন কাশী মথুরা-সহ ‘বাকি’ বিষবৃক্ষগুলির ফল আহরণের পালা। ১৯৯১ সালের আইনটি ছিল এই বিষময় সম্ভাবনা প্রতিরোধের একটি প্রকরণ। নতুন করে যেন আর কোনও বাবরি মসজিদ কাহিনির পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই উদ্দেশ্যেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার এই আয়োজন হয়েছিল সে-দিন। সেই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিষয়ে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত শেষ অবধি কোন সিদ্ধান্ত স্থির করবেন, তা অবশ্যই তাঁদের বিচার্য। কিন্তু সেই আইনি প্রশ্নের বাইরে, সুস্থ স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানের জায়গা থেকে, একটি নিতান্ত সহজ প্রশ্ন মনে রাখা আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে, শতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের কথা হাওয়ায় ভাসছে।

এমন একটি দেশের নাগরিকরা সমবেত ভাবে, জাতি ধর্ম বর্ণ ইত্যাদি যাবতীয় সঙ্কীর্ণ পরিচয় নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, না পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি এবং ভাঙচুরের নব নব ধ্বংসকাণ্ডে মাতবেন? বহু কাল ধরে বহু ধর্ম-সংস্কৃতির টানাপড়েনে ভারততীর্থের সৃষ্টি, এ দেশে মাটি খুঁড়ে ‘আদি অতীত’কে উদ্ধার করতে গেলে শেষ অবধি প্রস্তরযুগেই ফিরে যেতে হবে। সেটাই কি বিশ্বগুরুর ভবিষ্যৎ? ১৯৯১ সালের আইনটি সম্পর্কে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদবর্গ তথা তাঁদের পশ্চাদ্বর্তী নাগপুরের চিন্তানায়করা দাবানলের আগুনে ক্ষমতার রুটি সেঁকার তাড়নায় পিছন দিকেই এগিয়ে চলবেন কি না, দেখা যাক।