অপ্রকাশ গুপ্ত। এক সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে আধিকারিক ছিলেন। বছর ছ-সাত আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেওয়ার আগে কথা প্রসঙ্গে বলতেন, বই পড়ে আর লেখালেখি নিয়ে সময় কাটাবেন। ইচ্ছে থাকলেও এতোদিন সে সুযোগ হয়নি। বদলির চাকরি। উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের দুর্গম অঞ্চলেই কেটেছে চাকরি জীবনের সিংহভাগ সময়। একেবারে শেষের দিকে কলকাতায়।
রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত আবৃত্তি করতেন। ওই গন্ডি পেরিয়ে জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুভাষ-প্রেমেন্দ্র-বিষ্ণু-শঙ্খ-সুনীল-শক্তির দিকে মন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। স্বনামধন্য ওই কবি-ত্রয়ীর মধ্যেই কেবল ঘুরপাক খেয়েছেন। জয়-মৃদুল- রত- সুবোধ- মল্লিকা- জয়দেব-শ্রীজাত- মন্দাক্রান্তা তো অনেক পরের কথা! কিন্তু কবিতার প্রসঙ্গ উঠলে ‘এখন আর তেমন ভালোকিছু লেখা হচ্ছে না’ বলে আক্ষেপ করেন!
অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রর পর আর কাউকে উপযুক্ত লেখক বলে মনে করেন না তিনি। আশাপূর্ণাদেবী আর সুনীল গাঙ্গুলীকে অতিকষ্টে তালিকায় রাখলেও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, নিমাই ভট্টাচার্য, শঙ্কর, প্রফুল্ল রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, দেবেশ রায়-দের তালিকা থেকে পুরোপুরি বাদ!
তিন বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাৎ তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতিভূষণ-দের কথা নাম-কা-ওয়াস্তে বললেও কমলকুমার মজুমদার কিম্বা সতীনাথ ভাদুড়ীদের কথা বিশেষ বলেন না। হিমানীশ গোস্বামী কিম্বা তারাপদ রায়দের কথা জানেন বলে মনে হয় না। তবে শিবরাম চক্রবর্তী আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়কে হালকা রসের লেখক বলে মনে করেন। কারণ শিবরামের ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা, ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর পড়েননি।
এঁর দৃঢ় বিশ্বাস, এখন আর ভালো কিছু লেখা হচ্ছে না। সুতরাং পড়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, নলিনী বেরা, প্রচেত গুপ্ত, তিলোত্তমা মজুমদার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু, স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আদৌ পড়েন না। এই সময়ের কারও লেখাই ইনি পড়েন না। পড়তে না-ই পারেন, কিন্তু না-পড়ে ‘কিছুই লেখা হচ্ছে না’ বলাটা ঠিক?
উল্লেখ্য, স্কুল পেরিয়ে কলেজজীবনে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাই মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানে স্নাতকস্তরের শেষধাপে পা রাখা সম্ভব হয়নি। একসময় ‘ভুল’ বুঝতে পেরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসেন। কিন্তু স্কুল-কলেজ পর্যায়ে যতটুকু অর্জন করেছিলেন, তাতে কোনও ফাঁক ও ফাঁকি ছিল না। তাৎক্ষণিক বুদ্ধি করে টেকনিক্যাল স্ট্রিমে প্রশিক্ষণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে যোগ পান।
প্রাক-অবসর জীবনের ‘অঙ্গিকার’ ভুলে এখন পাশের পাড়ার ক্লাবে ক্যারাম খেলায় সন্ধ্যে কাটান। বাকি সময়ে নেট দুনিয়ার বিচরণ করেন। যে বাম রাজনীতি তাঁকে সচেতন করেছিল, শাসক আর শাসিতের মধ্যে প্রভেদ শিখিয়েছিল, শ্রম ও পুঁজির সম্পর্ক চিনিয়েছিল-সেই সংসদীয় ‘বাম রাজনীতি’র প্রতিই তাঁর এখন তীব্র ঘৃণা! ওই ঘৃণারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটান সোশ্যাল মিডিয়ায়! যার মধ্যে সুস্থচিন্তা প্রকাশ পায় না।
অনেক সময় পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করেন। দ্বিগুণ উৎসাহে নতুন পোস্ট-এ মগ্ন হয়ে ওঠেন! বই পড়া কিম্বা লেখালেখিতে নাকি উৎসাহ পান না! কেন পান না-তার কোনও কারণ অবশ্য তাঁর জানা নেই। তবে আগের মতোই কারও বিপদ-আপদে দৌড়ে যান সবার আগে। বাড়ির বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে। বয়স যে তাঁর অনেকটাই হয়েছে-একথা অনেক সময়েই দিব্যি ভুলে যান।
এই তো জুলাইয়ের মাঝামাঝি হবে। উত্তর ভারতের মাফিয়া ডন বিকাশ দুবের পুলিশি এনকাউন্টার-এ মৃত্যু নিয়ে সারা দেশ যখন তোলপাড়, তিনি তখন এনকাউন্টার-এর সপক্ষে সরব! পরিচিতজনদের বোঝাচ্ছেন, কেন এনকাউন্টার-এর প্রয়োজন। আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার জন্য অনেকেই তাঁর কথায় সায় দেন। এর আগে হায়দ্রাবাদের এনকাউন্টার-এর ঘটনায়ও অনেকেই সায় দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, তখনও অবশ্য আদালতে অভিযুক্তর অভিযোগ প্রমাণ হয়নি (যদিও সবাই জানেন অভিযুক্ত বিকাশ দুবের কুকীর্তির লম্বা ফিরিস্তির কথা)! জানা গেছে, ধৃত বিকাশ দুবের সংগীসাথীরাও পুলিশি এনকাউন্টার-এ মৃত! যেকোনও অভিযুক্তরই আইনি সুবিধে পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। একে কোনওভাবেই অস্বীকার কিম্বা অগ্রাহ্য করা যায় না। যদি অস্বীকার করার কোনওরকম চেষ্টা করা হয় বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
আজকের শিবিরভুক্ত কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে আমাদের অনেকেরই হয়তো-বা অভিযোগ ও বিতৃষ্ণা আছে এবং তার কারণও যথেষ্ট জোরালো। কিন্তু তাঁরা যদি কোনও ভালো কাজে অংশ নেন তো তাকে কোনওভাবেই অবজ্ঞা করা যায় না। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ভুল করে কোনও দোষী ছাড়া পেলেও অকারণে একজন নির্দোষ ব্যক্তিও যেন কোনও ভাবেই আইনি-প্যাচে শাস্তি না পান।
হায়দ্রাবাদের ঘটনার মতোই মাফিয়া ডন বিকাশ দুবের পুলিশি এনকাউন্টার-এ মৃত্যু নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং তাঁরা তাঁদের মতামত দিয়েছেন। যেখানে অন্যান্যদের পাশাপাশি প্রবীণ কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় স্বভাবতই এনকাউন্টার-এর বিরুদ্ধে তাঁর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ব্যাস! আর যায় কোথা! ওই ভদ্রলোক দারুন ক্ষেপে গেছেন।
তিনি প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে কোনও বড়মাপের সাহিত্যিকই মনে করেন না। কেউ নাকি তাঁকে চেনেনই না; তাঁর বইও পড়েন না। বোঝা গেল, শীর্ষেন্দুবাবুর কোনও লেখাই এই ভদ্রলোকের পড়া নয়। তাই অমন ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারলেন একজন প্রবীণ প্রাজ্ঞ ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে! খুব কষ্ট হচ্ছিল একজন শিক্ষিত ও বয়স্ক মানুষের এমন বাস্তব-বহির্ভূত অসংলগ্ন কথাবার্তায়!
নিজের মতের সঙ্গে অন্যের মত না মিললেই তাঁকে অন্যায়ভাবে নস্যাৎ করার এমন অবাঞ্ছিত মানসিকতা কখনও কোনও ভাবেই কাম্য নয়। কিম্বা কারও সম্বন্ধে না জেনেশুনে অকারণে বিরূপ ও বেঠিক মন্তব্য করাটাও এক ধরনের অপরাধ তো বটেই, অসুস্থ-রুচির পরিচয়ও বহন করে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের একজন প্রাক্তন পদস্থ আধিকারিকের কাছ থেকে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদন! কে শোনে কার কথা!
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘অতি-ভক্ত’ এই ভদ্রলোক মহাত্মা গান্ধী কিম্বা জওহরলাল নেহরুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। গোদা বাংলায় যাকে বলে ‘পাতি নেতা’ ছিলেন এঁরা। তাঁরা কিছু জানতেন না, বুঝতেন না-এমনটাই প্রমাণে সদা ব্যাস্ত! ব্যারিস্টার গান্ধী-নেহরুর কোনওরকম জ্ঞান-গম্যিও ছিল না বলে মনে করেন ইনি! তেমন পড়াশুনাও নাকি ছিল না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এঁদের কোনও ভূমিকাই নেই!
সুভাষচন্দ্র বসুকে বড়ো করার জন্য অন্যকাউকে ছোটো করার কোনও প্রয়োজনই পড়ে না; কারণ তিনি এতোটাই বড়ো মাপের নেতা ছিলেন। স্বাধীন ভারতে তাঁর কোনও মূল্যায়ণই হয়নি একথা যেমন ঠিক, অন্যদিকে তিনি যে প্রায় গোটা ভারতবাসীর ‘হৃদ-মাঝারে’ স্থায়ী আসন দখল করে আছেন, তাঁর ধারেকাছে পৌঁছতে বা ঘেঁষতে পারেন- তেমন উচ্চতায় দাঁড়ানো আর কোনও নেতা ছিলেন না একথা তো অসস্বীকার্য।
কেউ কাউকে পছন্দ না-ই করতে পারেন। সবার ইডিওলজি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে কোনওরকম বিরোধ বা জটিলতার কিছু নেই। কিন্তু সেই অপছন্দের মধ্যে যেন কোনওরকম দীনতা বা নীচতা না থাকে। আর সমালোচনা (নিন্দামন্দ নয়) করার জন্য অন্যের ‘শোনা কথা’র ওপর আস্থা না রেখে নিজেকে পড়াশুনার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা ভীষণভাবেই প্রয়োজন।
বলা বাহুল্য, আমাদের অনেকেরই বোধ-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, বিচার-বিবেচনা, পর্যবেক্ষণ শক্তি সীমাবদ্ধ। ফলে যার মাধ্যমে আমরা চেতনার উত্তরণ ঘটাতে পারি, তা হলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ। যাঁরা দীর্ঘদিন গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশেষ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন- সেসব গ্রন্থ পড়া ও বোঝার মধ্য দিয়েই আমরা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারি। নিজের সীমিত জ্ঞান দিয়ে সবকিছু বোঝা যায়না।
গান্ধীজিকে পুরোপুরি বুঝতে গেলে হিংসা ও অহিংসার প্রকৃত রূপ সম্বন্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এই ধারণায় পৌঁছতে গেলে আমাদেরকে বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ থেকে পুরান ও উপনিষদ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে গভীর অধ্যবসায়ের সঙ্গে অধ্যয়ন করতে হবে। যা আমাদের অনেকের পক্ষেই হয়তো বা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন। কারণ ওই বিষয়গুলি গভীর অধ্যয়নের মধ্য দিয়েই তাঁর কন্ঠস্থ ছিল।
তাই গান্ধীজির কোনও কোনও সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি ভিন্নমত পোষণ করলেও গান্ধীজিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। গান্ধীজিও তাই। ভিন্নমত পোষণ করলেও পারস্পরিক সৌহার্দ্য ছিল। পাশ্চাত্যের নোবেল জয়ী সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোমাঁ রোলাঁও ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শন সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। তাই গান্ধীজি সহ স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের জীবনী নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
অনেকে গান্ধীজিকে অপছন্দ করেন। কিছু ভাসা ভাসা যুক্তি দেখিয়ে। যার সঙ্গে বাস্তবের তেমন কোনও সাযুজ্য নেই। যেমন ভারত ভাগের জন্য অনেকেই তাঁকে দায়ী করেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী- তিনি ভারত ভাগের প্রচন্ড বিরোধি ছিলেন। ওই সময় কংগ্রেস থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়েও পড়েছিলেন। তাঁকে সেভাবে মান্যতা দেওয়া হতো না। স্বাধীনতা হাতের মুঠোয় ভেবে তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস!
মহাশক্তিধর সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট ও দৌরাত্ন্যে প্রকৃত সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিছু অর্ধসত্য ও বিকৃত তথ্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষকে ভুল বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। যাঁরা পড়াশুনা না করে ‘শোনা কথায় বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের কাছে টানতে সোশ্যাল মিডিয়া তৎপর। এরফলে ইউ-টিউবে গালগল্প দিয়ে একটা ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দিলেই বাজিমাৎ। মানুষ সত্যের চেয়ে মিথ্যেকেই গ্রহণ করতে আগ্রহী!
এখন আর পরিশ্রম করে মোটা মোটা বই পড়ার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। চলতে-ফিরতে হাতের স্মার্টফোনের স্ক্রিনে শুধু একবার চোখ রাখলেই হলো। মাত্র ১০-১২ মিনিটের খেল। আপনি সবজান্তা হয়ে যাবেন! মজার বিষয় হলো, যাঁর সঙ্গে আপনি আলোচনা করবেন, তিনিও ওই একই পথের যাত্রী! ফলে ভুল বা বিকৃত ‘তথ্য’-এর আদান-প্রদানে কোনও ব্যাঘাত ঘটে না। এই নষ্ট সময়ের আসল ট্র্যাজেডি এখানেই।