• facebook
  • twitter
Friday, 27 December, 2024

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

যখন ইস্কুলে পড়ি, ফোর্থ্ ক্লাস কি থার্ড্ ক্লাসে, তখন স্কটের আইভানহো-খানি পড়িয়া ও তাহার ছবি দেখিয়া ইউরোপের মধ্যযুগে যে বর্ম ব্যবহর হইত তৎসম্বন্ধে প্রথম জ্ঞান পাই, এবং এই সম্বন্ধে কৌতূহলও খুব হয়; সঙ্গে সঙ্গে ইহাও জানিবার ইচ্ছা হয় আমাদের দেশে বর্ম ছিল কিনা, এবং কি-রকম ছিল।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর

প্রাচীন কালের ঘর-বাড়ী তৈজস-পত্র গহনা-কাপড় সম্বন্ধে সত্য অবস্থাটির সঙ্গে পরিচয় লাভ করা, এক হিসাবে ইতিহাসের জ্ঞান-অর্জন করাও বটে। রাজা-রাজড়াদের সন-তারিখ, যুদ্ধবিগ্রহ বা বড় বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের কথা—কেবল ইহা লইয়া ইতিহাস নহে; ইহা ইতিহাসের কঙ্কাল মাত্র। জাতির মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতি, ইহা আলোচিত না হইলে ইতিহাসের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় না। কিন্তু ইতিহাসের রক্তমাংস যোজন করিতে হইলে, ইহাকে চাক্ষুষ করিবার উপায় করা চাই। একমাত্র প্রাচীন বা আলোচ্য যুগের চিত্র যে যে বিষয়ে যতটা পাওয়া যায় তাহাকে অবলম্বন করিয়াই সেই যুগের বাহিরের রূপ এবং আভ্যন্তর রূপ সম্বন্ধে আমরা একটু প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করিতে পারি, ইতিহাস তখন আর সন-তারিখ রাজাদের নাম যুদ্ধ দেশজয় অন্তর্বিবাদ রূপ অস্থি-নিচয়-পূর্ণ কঙ্কাল মাত্র থাকে না, আলোচ্য যুগ যেন একেবারে তাহার স্বকীয় রূপে রক্তমাংসে গঠিত মানুষের আকার ধরিয়া মূর্ত হইয়া আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। তাই আজকাল ইতিহাসকে জীবন্ত করিয়া দেখাইবার জন্য প্রাচীন কালের মানুষের কথা যথাসম্ভব তাহাদেরই হাতের কাজ দেখাইয়া, তাহাদের আঁকা (বা তাহাদের আঁকার নকলে আঁকা) নিজেদের ঘর-বাড়ী চেহারা পোষাক গহনা ইত্যাদি সমস্তর ছবি বইয়ে ছাপাইয়া কৌতূহল উদ্রেক করা হয়, জিজ্ঞাসার স্পৃহা বাড়াইবার চেষ্টা করা হয়।

ইউরোপের কথা ছাড়িয়া দিই। আমাদের নিজেদের দেশের প্রাচীন কথা, চাল-চলন, রীতিনীতি বাস্তুশিল্প বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষিত লোকেরই ধারণা অনেক সময়েই কত ভুল! শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন রথে চলিয়াছেন— রথ বলিতে আমরা বুঝি, চার চাকার বা দুই চাকার এক-রকম গাড়ী, কেবল তাহার মাথার ছাতটী একটা মুসলমান যুগের ছত্রীর মত; সাধারণতঃ ছবিতে এই রূপই আঁকা হয়। সেদিন পর্য্যন্ত, হিন্দু আমলের রাজা-রাজড়ার, পোষাক যাহা পাঙ্গালী চিত্রকরে, আঁকিত এবং যাহা যাত্রা ও থিয়েটারে চলিত, তাহা ছিল নানা রঙের মখমলের এক কিম্ভূতকিমাকার সৃষ্টি—পরণে পেন্টুলেন বা হাফ-প্যান্ট (হাফ-প্যান্ট হইলে বিলাতী মোজাও থাকিত), চাপকান, কোট এবং পাঠান ওয়েষ্টকোট এই তিনের এক খিচুড়ী, এবং পিঠে একটা শ্রীকৃষ্ণের ধড়ার মত পিঠ-বস্ত্র, ও মাথায় সাদা পালক দেওয়া টুপী বা পাগড়ী; মোগলযুগের রাজপুত রাজার পোষাকের উপর, ইংরেজী থিয়েটারে ব্যবহৃত ইউরোপীয় মধ্য-যুগের পাত্রদের নানা রঙ্গীন জামা-পাজামা-পিঠবস্ত্রর সমাবেশ করিয়া, থিয়েটারের বেশ-কারীরা বাঙ্গালী জন-সাধারণকে হিন্দু রাজার পোষাক বলিয়া এই অপূর্ব সৃষ্টি উপহার দিয়াছিল, এবং বিনা প্রতিবাদে বাঙ্গালী শিক্ষিত সমাজও তাহা গ্রহণ করিয়া আসিতেছিল।

যখন ইস্কুলে পড়ি, ফোর্থ্ ক্লাস কি থার্ড্ ক্লাসে, তখন স্কটের আইভানহো-খানি পড়িয়া ও তাহার ছবি দেখিয়া ইউরোপের মধ্যযুগে যে বর্ম ব্যবহর হইত তৎসম্বন্ধে প্রথম জ্ঞান পাই, এবং এই সম্বন্ধে কৌতূহলও খুব হয়; সঙ্গে সঙ্গে ইহাও জানিবার ইচ্ছা হয় আমাদের দেশে বর্ম ছিল কিনা, এবং কি-রকম ছিল। ওয়াই-এম্-সী-এ বালক-বিভাগের সদস্য ছিলাম, পাদ্রি আর্থার লি-লেভর্ সাহেব তখন ছিলেন তাহার পরিচালক, এ সম্বন্ধে তাঁহাকে প্রশ্ন করি। তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, ছিল বৈ কি—লোহার জিঞ্জির বা শিকলের বর্ম এদেশে পরিত, আবার তাহার উপরে লোহার পাতের বর্ম পরারও রেওয়াজ ছিল—মিউজিয়ামে গেলে দেখিতে পাইবে।’’ তাঁহার কথায় মিউজিয়ামে গিয়া যখন সত্যি-সত্যই জিঞ্জিরের সাঁজোয়া দেখিয়া আসিলাম—তখন কত না আনন্দ হইল! চোখের সামনে কত হলদীঘাটের, ফতেপুর সিক্রীর, পানিপথের যুদ্ধের ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল, মিউজিয়মের আলমগীর ভিতরের বর্ম পরিয়া কত রাজপুত আর মোগল সওয়ারের ঘোড়া ছুটাইয়া গমন চোখের সামনে যেন ফুটিতে লাগিল—সোনা-রূপার কাজ করা লোহার শিকলের সোনা বা বর্মের ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ ঘোড়ার টপকের ধ্বনির সহিত মিশিয়া যেন কানে বাজিতে লাগিল। এক আইভানএহা বইয়ের ছবি, বর্ম-সম্বন্ধে এই কৌতূহলের উদ্রেক করিয়াছিল।

(ক্রমশ)