মোহনবাগানের শেষ আইলিগ জয়ের গোলকিপার কোচ দীপঙ্কর চৌধুরী মনে করেন বাংলার ফুটবল এখনও জীবিত আছে। দেশের বড় রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজ্য বাংলা। এতগুলো জেলা আছে। প্রতি জেলায় ফুটবলের চল আছে। রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামেও ফুটবলের নানা টুর্নামেন্টে প্রচুর দর্শক সমাগম হয়। ফুটবলের প্রতি এমন সাপোর্ট দেশের কটা রাজ্যে দেখা যায়? ফুটবলের প্রতি যেখানে মানুষের এমন টান আছে, সেখানে বাংলার ফুটবল হারিয়ে গেছে বলা যায় না। সদ্য কেরল সুপার লিগ জয়ী কালিকট এফসির গোলকিপার কোচ মনে করেন, বাংলার ফুটবলে নতুন নতুন ভাবনা প্রয়োগ করতে হবে। জেলার ফুটবলকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সরকারি সাহায্য ও বেসরকারি আর্থিক বিনিয়োগ তৃনমূল স্তরে নিয়ে যেতে হবে। জেলার ফুটবলে অর্থের অভাব মেটাতে হবে। কলকাতার প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোকে যেমন লিগের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে আর্থিক সাহায্য করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই বিভিন্ন জেলা লিগে অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলোকে আর্থিক সাহায্য করতে হবে। সরকার রাজ্যের বিভিন্ন ক্লাবগুলোকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সাহায্য করে থাকে, এতে জেলার ক্লাবগুলোর সৌন্দর্য বেড়েছে। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে ফুটবলের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। জেলা স্তরে ইদানিং প্রচুর টুর্নামেন্ট হচ্ছে, তাতে প্রচুর অর্থের বিনিয়োগ হচ্ছে। অনেক ফুটবলারদের কাছে বেশ ভালো অর্থ উপার্জনের সুযোগ হচ্ছে। কিন্তু জেলা লিগের সঙ্গে ওই টুর্নামেন্টগুলোর সামঞ্জস্য নেই। জেলার বিভিন্ন ঐতিহ্যপূর্ণ ক্লাবগুলো টিমটিম করছে চলছে। জেলার অসংখ্য কোচিং ক্যাম্পগুলো প্রায় কিছুই আর্থিক সাহায্য পায় না। ব্যক্তিগত ভালোবাসা ও নিজস্ব আর্থিক অনুদানে ক্যাম্পগুলো চলে। তথাকথিত খেপের টুর্নামেন্টের কাছে জেলার ফুটবল ও তার ক্লাবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বাধীনতা পাওয়ার আগের ক্লাবগুলোর ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
নৈহাটি থেকে উঠে আসা ফুটবলার দীপঙ্কর, তার ১৬ বছরের ফুটবলার জীবনের অধিকাংশ সময়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ফুটবল খেলে বেড়িয়েছেন। ব্যাংকের নিশ্চিত চাকরি জীবনের সুযোগ পেয়েও সে পথে হাঁটেনি। পেশাদার ফুটবলের জীবনকে বেছে নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জকে বেশ ভালোই উপভোগ করছেন। ফুটবল ছাড়ার পর কোচিংয়ে এসেছেন। গোলকিপারের লেভেল-ওয়ান কোচিং ডিগ্রি পাস করেছেন। এআইএফএফের থেকে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের ফুটবলার বাছাইয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১৭ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ যুব বিশ্বকাপে ভারতের ফুটবলার বাছাইয়ের কাজ করেছেন। গোয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১৬-১৭ সালের সন্তোষ ট্রফিতে ভারতের অনূর্ধ্ব ২৩ ফুটবলার বাছাইয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। মনভীর সিং, প্রভাত লাকরা, লিস্টন কোলাসোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোহনবাগানে আসার আগে ব্যাঙ্গালোরের ওজোন এফসির দলের সঙ্গে ছিলেন। সেসময় কোচ ডেভিড বুথের সঙ্গে কাজ করেই কোচিংয়ে প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। আইলিগের পাশাপাশি আইএসএলে নর্থইস্ট দলের সঙ্গেও দীপঙ্কর চৌধুরী যুক্ত থেকেছেন। দেশের হয়ে বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলের গোলকিপার কোচের দায়িত্ব সামলেছেন। ডেভিড বুথ থেকে এ্যাসলে ওয়েস্টউড বা কিবু ভিকুনা– দেশের ক্লাব লেভেলে সাফল্য পাওয়া বিদেশি কোচেদের সঙ্গে কাজ করা ও সাফল্য এনে দেওয়া গোলকিপার কোচ দীপঙ্কর চৌধুরী এখনও বাংলার ফুটবলের প্রতি অগাধ আস্থা রাখেন।
তিনি বলেন, বাংলার ফুটবলে প্রধান চালিকাশক্তি কলকাতা লিগ। এই লিগ থেকেই জেলার ফুটবলাররা পারফরম্যান্স করে তাদের ফুটবলার স্বীকৃতি অর্জন করে। সব ঠিক আছে, কিন্তু বাংলা থেকে ফুটবলারদের জাতীয় স্বীকৃতি অর্জন করতে হলে বাংলার ক্লাবগুলোকে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করতে হবে। জুনিয়র থেকে সিনিয়র পর্যায়– প্রতি ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান দলগুলো দেশের সবোর্চ্চ লিগে সাফল্য পেতে পারে। কিন্তু সেই সাফল্যে বাঙালি ফুটবলাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারলে তবেই ভারতীয় দলে সুযোগ পাবে। ঠিক এভাবে, জুনিয়র আইলিগ থেকেই বাঙালি ছেলেরা ভারতীয় দলে সুযোগ পাবে। ভারতীয় দল বাছাইয়ের কাজে থেকে বলতে পারি পজিশন অনুয়ায়ী হাইট ও প্রথম টাচ খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। বয়স অনুযায়ী একজন ফুটবলারের শারীরিক গঠনের কতটা পরিবর্তন হয়, সেটা বিবেচনায় থাকে। সর্বভারতীয় স্তরে অংশগ্রহণের প্রশ্নে দল গঠনে ক্লাবগুলোকে এদিকে নজর দিতে হবে। তবেই ছেলেরা সুযোগ পাবে। কলকাতা লিগ বয়সভিত্তিক হয়েছে। প্লেয়ার তুলে আনার ক্ষেত্রে দারুন পদক্ষেপ।
নীচের ডিভিশনের খেলা ভালো মাঠে হলে আরও ভালো হবে। কিন্তু এই লিগ থেকে বাছাই করা ফুটবলারদের রক্ষণাবেক্ষণের প্ল্যানিং করতে হবে। এক্ষেত্রে ফুটবলারদের প্রকৃত শিক্ষা কে দেবে? এইসব প্রতিভাবান ফুটবলারদের নজরদারি কিভাবে হবে? কত ভালো ভালো বাঙালি ছেলে একাগ্রতা ও শৃংখলার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ দেখার নেই। এখন বাংলার ফুটবল আবার লাভজনক ব্যবসায় মনে দিয়েছে। সাধারণ কোচিং ক্যাম্প অ্যাকাডেমির নামে চালিয়ে যাচ্ছে। একটা অ্যাকাডেমি দেখানো যাবে, যেখানে ভালো থাকা ও পুষ্টিকর খাওয়ায় দেওয়ার ব্যবস্থা আছে? প্র্যাকটিসের পর ছেলেদের দেখভালের প্রয়োজন। কে কিভাবে কতটা বিশ্রাম নিচ্ছে, কতটা শরীরের যত্ন নিচ্ছে–এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ছেলেটির এডুকেশন কি হবে, তার সিস্টেম চাই। এগুলো একটা অ্যাকাডেমি মেনে চলে, বা তাদের কী সেই পরিকাঠামো আছে? কটা অ্যাকাডেমির নিজস্ব মাঠ আছে? বেঙ্গল ফুটবল অ্যাকাডেমি ছাড়া চারিদিকে শূন্যতা। খোঁজ নিয়ে দেখ, জেলার কোচিং ক্যাম্পগুলো এখানো ফুটবলার তুলে আনার মেইন কাজটা করে যাচ্ছে। তার মানে, তোমার বাস্তব ও খাতাকলমের হিসেবে গরমিল থেকে যাচ্ছে। এসব নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা চাই। ছোট ছোট বিষয়গুলো এখন থেকেই বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফুটবলারদের জন্য আইএফএ মেডিক্লেম চালু করেছে, দারুন উদ্যোগ কিন্তু প্রতিটি টিমে অন্তত একজন ফিজিও রাখার দিকে নজর দিতে হবে। লিগকে এরকম ২-৩ মাসের করলে হবে না। প্রচুর ডিগ্রিধারী কোচ এখন বাংলায় আছে। ক্লাবগুলোর সঙ্গে তাদের যুক্ত করতে হবে। নূন্যতম ৬ মাস তো তাদের কোচিং করানোর সুযোগ দিতে হবে। বয়সভিত্তিক লিগ তো ছেলেদের শেখার লিগ। এই লিগকে প্রিমিয়ার লিগের কাঠামোর সঙ্গে মেলালে চলবে না। হাজার হাজার ছেলে আমাদের বাংলায় আছে। কিন্তু তাদের সর্বভারতীয় স্তরে তুলে আনার সঠিক পরিকল্পনা চাই।
২০১৬-১৭মরশুমের সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দল শেষবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই টুর্নামেন্টে ভারতীয় অনূর্ধ্ব ২৩ ফুটবলার বাছাইয়ের জন্য কেরলের সেতুবন্ধ বালানের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা গোলকিপার কোচ দীপঙ্কর চৌধুরীর আছে। এবারের বাংলা দল নিয়ে দীপঙ্কর খুব আশাবাদী। তিনি বলেন, বাংলা দলের শেপটা খুব ভালো লাগলো। খেলার মধ্যে পরিকল্পনা আছে। কিন্তু প্রাথমিক পর্ব ও ফাইনাল রাউন্ডের মধ্যে পার্থক্য আছে। টুর্নামেন্টে কেরল টিমটা বেশ ভালো। ওখানে আমাদের সুপার লিগ জয়ী কালিকা এফসির ফুটবলাররা আছে। এখানে কলকাতা লিগে খেলা ইস্টবেঙ্গলের কিছু প্লেয়ার আছে। কিন্তু বাংলা দলে এবার প্রস্তুতির অনেক সুযোগ পেয়েছে। লোকাল লিগ শেষে প্লেয়ারদের বিশ্রামের সুযোগ ছিল। এই সুবিধাগুলো কেরলের ছেলেরা পায়নি। সার্ভিসেস তাদের গতবারের চ্যাম্পিয়ন দলের অনেক ফুটবলারদের আইএসএলে ও আইলিগে ছেড়ে দিয়েছে। এছাড়া বাংলা দলকে বেগ দেওয়ার টিম বলতে তামিলনাড়ু টিমের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু বাংলা দল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এগিয়ে থাকবে। বাংলা দলের কোচিং স্টাফও বেশ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বলা যায়।
প্রাথমিক পর্বের দুর্বলতা নিশ্চয়ই কোচ সঞ্জয় সেন চিহ্নিত করেছেন। সেসব দুর্বলতা নিশ্চয়ই কাটিয়ে ফেলেছেন।বলতে পারো বাংলা দল নিজেদের খেলাটা খেলতে পারলে চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার কারন নেই। কিন্তু এই দল থেকে অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলার কতজন ভারতীয় দলে সুযোগ পাবে, আমার সন্দেহ আছে। বাংলা শেষবার যখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেই টিমের বেশ কিছু ফুটবলার ভারতীয় অনূর্ধ্ব ২৩ দলে সুযোগ পেয়েছিল। তখন অবশ্য সন্তোষ ট্রফি দলে ৫ জন অনূর্ধ্ব ২১ ফুটবলার দলে রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। ৩ জন ফুটবলার প্রথম একাদশে রাখা হতো। ফলে, অনূর্ধ্ব ২৩ ফুটবলার বাছতে আমাদের সুবিধা হতো। এই বাংলা দলের ফুটবলারদের ক্ষেত্রে কারা সুযোগ পায়, তা দেখার আছে। কিন্তু এখনও যে বাংলা দল ফেভারিট হিসেবে মাঠে নামে– এটাই আমাদের আগামীদিনের কাজের প্রেরণা। আমাদের রসদ আছে। সঠিক পরিকল্পনা করেই বাংলার ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
দীপঙ্কর সদ্য ভারতীয় মহিলা অনূর্ধ্ব ২০ ফুটবল দলে ডাক পেয়েছেন। ভবিষ্যতে বাংলার হয়েও কাজ করতে চান।