• facebook
  • twitter
Friday, 27 December, 2024

এমন বাদলে

দুপুরে খায়নি কিছু অবিনাশ। অঘোরে ঘুমিয়েছে। এই নতুন নার্ভের ওষুধটায় ঘুম একটু বেশিই হয়। সন্ধ্যায় পুরনো ফ্যামিলি অ্যালবামটা নিয়ে বসল সর্বাণী।

কাল্পনিক চিত্র

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

‘সবিতা, সবিতা’। পাশের ঘর থেকে শব্দটা ভেসে আসতেই টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল সর্বাণী। আজ সেন্টার থেকে যে লোকটির আসার কথা ছিল, সে এখনও আসেনি। সকাল থেকে কালো চাদরে ঢেকে গেছে আকাশ। টিভি খুললেই ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে আবহবিদরা। একশো কিলোমিটার বেগে ঝড় আছড়ে পড়বে শহরে। হয়তো সেই সব শুনেই আসেনি। আদৌ আসবে কিনা কে জানে!
পাশের ঘরে গিয়ে সর্বাণী দেখল তার বাবা অবিনাশ সোফা থেকে মেঝেতে নেমে এসেছে। তার চোখে চশমা নেই। কী খুঁজছে যেন।

—কী হয়েছে বাবা?
—কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? দেরি হয়ে গেল আমার। বের হতে হবে। হাসপাতালে পৌঁছাব কী করে?
সর্বাণী বলল না কিছুই। নিঃশব্দে বাবার কাঁধে হাত ধরে তুলে বাথরুমে নিয়ে গেল। গেল বছর মা চলে যাবার পর এই কাজ সে প্রতিদিন নিষ্ঠার সঙ্গে করে আসছে। অবশ্য তরিত্র যখন কলকাতা থাকে, ও-ও হাত বাড়ায় খানিকটা। তরিত্রর দিনহাটায় পোস্টিং। সপ্তাহে একদিন আসে। কখনও বা মেরেকেটে দুইদিন।

বাথরুমে বাবাকে ঢুকিয়ে দরজাটা আধভেজা করে দাঁড়িয়ে রইল সর্বাণী। বাইরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কাগজফুলের গাছের পাতাগুলো ঘনঘন দুলছে আর এলিয়ে পড়ছে। সকালে বাড়ির ঠিক পাশেই চিলড্রেন্স পার্কে দু-একজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা হাঁটতে আসেন, হো হো করে লাফিংক্লাব করেন, মাঝেমাঝে দু-একটি প্রজাপতির মতো বাচ্চা আসে খেলতে। আজ কেউ কোথাও নেই। চারপাশ থমথমে। বিলম্বিত বৈরাগীর বিস্তারের মতো সবকিছু যেন ধ্যানমগ্ন। নিঃস্পন্দ। এই পরিস্থিতিতে সেন্টার কারোকে আজ পাঠাতে পারবে বলেই মনে হয় না।

‘সবিতা সবিতা’। বাথরুম থেকে ডেকে উঠলেন অবিনাশ। সর্বাণী দরজা খুলে বাবাকে লুঙ্গি পরিয়ে ধরে ধরে আবার সোফায় নিয়ে এসে বসালো। জলখাবার করতে হবে। বাবার ধরাবাঁধা মেনু। দুটো রুটি আর এক বাটি মুসুরডাল। এদিক ওদিক হলেই সুগার চড়ে বসবে। বাবাকে সোফায় বসিয়ে টিভিটা চালিয়ে দিল সর্বাণী। খবরের চ্যানেল। শহরে আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের কথাই বলে চলেছে সব জায়গায়। সেদিকে তাকিয়ে অবিনাশ বলল, ‘সবিতা, খাবারটা দে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল যাবো তো…’

সর্বাণী ঘাড় নেড়ে চলে এল রান্নাঘরে। সেন্টারে ফোন করে লাভ হল না। ফোন বেজে গেল, তুলল না কেউ। তার বাবা অবিনাশ একসময় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের হেড ছিলেন। রোজ ঘড়ি ধরে আউটডোর শুরু করতেন। মার কাছে সেসব গল্প শুনত সর্বাণী। রোগটা বেড়ে যাবার পর তাই ন’টা বাজলেই বাবা অস্থির হয়ে ওঠে। তাঁর মনে হয় হাসপাতালে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এসময় বাধা দিলে কখনও সখনও প্রচণ্ড আক্রমণাত্মকও হয়ে ওঠে বাবা। এর আগে অন্য এক সেন্টারের আয়ামাসি বাধা দিতে গেলে হাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছিল। সে এক ভয়ানক কাণ্ড। সেবার অনেক কষ্ট করে ঘটনাটা সামাল দিয়েছিল সে।

রান্নাঘরে ঘষা কাঁচের জানলায় জলের ঝাপটা নেমে আসছে। সপসপ ঝাপটে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। জলখাবার তৈরি করে বাবার কাছে গিয়ে সর্বাণী দেখল অবিনাশ সকালের খবরের কাগজ কুটিকুটি করে ছিঁড়েখুড়ে ফেলে মেঝেময় ছড়িয়ে রেখেছে।
—কী হয়েছে বাবা?
—এসব কী লিখেছে কাগজে? আমার ডিপার্টমেন্টে নাকি দালালচক্র চলছে, এসব আমি বরদাস্ত করব না।
—আচ্ছা। বেশ। এবার খেয়ে নাও লক্ষ্মী ছেলের মতো।

বাবাকে খেতে বসিয়ে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে গেল সর্বাণী। বাইরে বৃষ্টিধারা আলপনার আলোলিকার মতো টবের অর্কিড আর ফুলের চারাগুলোকে চান করিয়ে দিচ্ছে। দু-একটা বৃষ্টির ফোঁটা তার চোখে মুখেও পড়ল। বারান্দার এক কোণে একটা ছোট বেতের চেয়ার অবহেলায় ধুলোর ভিতর পড়ে আছে। ওই চেয়ারে মা বসতে পছন্দ করত খুব। শেষ বয়সে ওখানে বসেই গুনগুন গান করত। তার মা, সঙ্ঘমিত্রা দে বাঙলা টপ্পাসঙ্গীতে একসময় একটি পরিচিত নাম ছিলেন। পরে হঠাৎ একদিন গলা পাকাপাকিভাবে ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। গুনগুন সেই গানের সুর বৃষ্টিফোঁটার মতো যেন ঘিরে ধরছে সর্বাণীকে। তরিত্র আর সে একইসঙ্গে এমডি পাশ করে। তরিত্রকে বিয়ে করার পর কিছুদিন চাকরি করেছিল সে। তারপর ধীরে ধীরে বাবার শরীরে এই রোগ দেখা দিল। ডিমেনশিয়া। ধীরে ধীরে স্মৃতির রেখা আবছা হয়ে মুছে যাবার রোগ। এর পরিণতি সর্বাণীর অজানা ছিল না। মা একা পেরে উঠত না। তাই সেই সিদ্ধান্ত নিল প্রিন্সপার্কের বাপের বাড়িতে চলে আসবে। তরিত্র আর সে নিঃসন্তান। তরিত্র উত্তরবঙ্গে পোস্টিং। সেও আপত্তি করল না।

‘সবিতা, সবিতা’। অবিনাশ ডাকছে আবার। সর্বাণী দরজা বন্ধ করে ভিতরে এসে দেখল একটা আধখাওয়া পাঁউরুটি পড়ে আছে প্লেটে। বাবা থম মেরে বসে আছে সোফায়।
—কী হয়েছে বাবা?
—আরে, তোকে হাজার বার বলেছি না। আমাকে ‘বাবা বাবা’ বলবি না। ‘স্যার’ বলবি। আমি কি তোর বাবা নাকি?
সর্বাণী তার বুক বেয়ে উথলে ওঠা অভিমান নিঃশব্দে গিলে ফেলে বলে, ‘বলো, ডাকছিলে কেন?’
—এই প্লেটটা নিয়ে যা। আমি একটু ঘুমোব।

বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে আবার নিজের পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে বসল সর্বাণী। একটা টেলিকনসালটেশন ফার্মে পার্টটাইম কাজে যোগ দিয়েছে সে গত একমাস। ডাক্তারি ছেড়ে দিলেও পড়াশোনার অভ্যাসটা আসলে ছাড়তে পারেনি সে। এই কাজ করতে করতে খানিকটা পড়াশোনাও করা হয়। এক জটিল কেস এসেছে। বট্সওয়ানার একটি সাতবছরের ছেলের কানের পাশে অদ্ভুত চাকা চাকা দাগ। হঠাৎ দেখে মনে হবে ফাইব্রোসারকোমা। কিন্তু এই বয়সে! জন্মগত? ভাবতে ভাবতে আবার সেই অভিমান ঝোড়ো হাওয়ার মতোই ভাসিয়ে নিয়ে গেল সর্বাণীকে। তার ঘরের জানলার কাঁচও ঘষা। বাইরে কাঠবাদাম গাছে বসে দুটো মাছরাঙা গা থেকে জল ঝেড়ে নিচ্ছে। বৃষ্টিটা বুঝি খানিকটা ধরেছে। পাখিদুটির চোখ বড় স্বপ্নালু। ঘষাকাঁচের এই এক সুবিধা। ভিতর থেকে বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে ভিতর কখনও নয়। তাই নিশ্চিন্তে পাখিদুটো দেখতে দেখতে হঠাৎ সর্বাণী বুঝতে পারল তার গাল বেয়ে জল নেমে আসছে। বাবা সত্যিই ভুলে গেছে তাকে? কোনও কিছুই মনে নেই তার? সেদিন তরিত্রর এক সিনিয়র দাদা, স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ রঞ্জন মিত্র এসেছিল বাবাকে দেখতে। এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে রঞ্জনদা হঠাৎ সর্বাণীর দিকে আঙুল নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘বলুন তো কাকু, এটা কে?’

বাবা সেদিন চেয়েছিল তার দিকে। সেই চাহনি ঘূর্ণিঝড়ের কৃষ্ণবর্ণ দানবমেঘের ভ্রুকুটির থেকেও ভয়ঙ্কর। খানিক সেইভাবে তাকিয়ে অবিনাশ বলেছিল, ‘ও সবিতা। আমার দেখভাল করে।’
—ভালো করে দেখুন তো কাকু? সবিতাই কী?

অবিনাশ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ। সবিতা।’ সর্বাণীকে চিনতে না পারলেও তাঁর স্ত্রী সর্বাণীর মা সঙ্ঘমিত্রাকে মনে রেখেছিলেন বাবা। চোখ মুছে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে মন দেয় সে। এই রোগের এমনটাই তো ধারা। সাম্প্রতিক যা কিছু, ধীরে ধীরে মুছে যাবে স্মৃতি থেকে। মনে থাকবে বহুদিনের আগের স্মৃতি। কিছু আজকালের সমস্ত কথা মুছে যাবে চিরদিনের জন্য।

দুপুরে খায়নি কিছু অবিনাশ। অঘোরে ঘুমিয়েছে। এই নতুন নার্ভের ওষুধটায় ঘুম একটু বেশিই হয়। সন্ধ্যায় পুরনো ফ্যামিলি অ্যালবামটা নিয়ে বসল সর্বাণী। সবাই বলেছে পুরনো ছবি নিয়ে দিনে অন্তত একবার বাবার সামনে বসতে। একে বলে রেমানিসেন্স থেরাপি। আজ সারাদিন সেন্টার ফোন ধরেনি। বৃষ্টিও থেমে থেমে হয়েই চলেছে। বাইরে সিঁড়ির পাদানিতে সামান্য জল জমতে শুরু করেছে। বাবার সামনে বাবা আর মায়ের বিয়ের ফোটো খুলে বসল সর্বাণী। বাবা সেই ফোটোর দিকে চেয়ে বলল, ‘এই মেয়েটা কে রে?’

বাবা সর্বাণীর মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
—চিনতে পারছ না? ভালো করে দেখ তো।
—এই মেয়েটা সেদিন এসেছিল আমাদের কলেজফেস্টে। ভালো গান করে।
—তাই? কী গান করল?
—এমন বাদলে তুমি কোথায়?
—বাহ। তোমার প্রিয় গান তো…
—হ্যাঁ। ঠিক তাই। কিন্তু তুই জানলি কীকরে সবিতা! তোর তো জানার কথা নয়…
সর্বাণী তার মনের ভিতরের কান্না গিলে ফেলে বলল, ‘আন্দাজ করলাম।’
—জানিস সবিতা, মেয়েটা, কী যেন নাম, সঙ্ঘমিত্রা না কী যেন। চিঠি লিখেছে আমাকে।
—কী লিখেছে?
—লিখেছে বর্ষার অঝোরধারা নাকি তাকে আমার কথা মনে করিয়ে দেয়।
—লিখেছে? তা তুমি কী লিখলে?
—আমি কিছুই লিখিনি। কিন্তু কী জানিস সবিতা, আমি না কিছুতেই ওকে ভুলতে পারছি না
—কেন?
—কে জানে? বারবার ভেসে আসছে সুর। যেন বারেবারে বলছে, ‘থমকে দামিনী বিকট হাসে; গরজে ঘন ঘন মরি সে ত্রাসে…’

গুনগুন করতে থাকে অবিনাশ। নিজের অজান্তেই সুর মেলায় সর্বাণী। দু’জনে মিলে গেয়ে ওঠে, ‘এমন দিনে হায় ভয় নিবারি, কাহার বাহু পরে রাখি মাথা…’
অবিনাশ হঠাৎ থেমে গিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ রে সবিতা। একটা কথা বলবি আমায়?’
—বলো না।
—এই যে মেয়েটা, সঙ্ঘমিত্রা, ওকে তোর কেমন লাগলো?
—ভালোই তো।
—একটা বই দেব ওকে?
—কোন বই?
—কী বই দেওয়া যায় বল তো? আচ্ছা, যদি ‘শেষের কবিতা’ দিই। ভিতরে একটা গোলাপ দেব। কেমন হবে?
—দারুণ হবে।
—ও আবার রেগে যাবে না তো? যদি বলে অমিত আর লাবণ্যর মতো আমাদেরও আর দেখা হবে না! তখন?
সর্বাণী চোখের জল মুছে বলল, ‘বলবে না। আমি ঠিক জানি। তুমি দাও না বাবা।’
বাইরে বৃষ্টি নেমে আসে আবার।