• facebook
  • twitter
Friday, 20 December, 2024

ঘর্মাক্ত আর্দ্র উত্তাপের এ কোন অগ্রহায়ণ মাস?

একই ভাবে গত বছর ‘গ্লেসিয়াল লেক’ বিপর্যয়ের কারণে সিকিম ও সংলগ্ন অঞ্চলে হড়পা বানের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে ভারত। জানা গিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কল্যাণে একাধিক হিমবাহ-হ্রদের অবস্থাই বিপজ্জনক।

প্রতীকী চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

গত এক দশক ধরে বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলগুলি স্পষ্ট ও তীব্র ভাবে অনুভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে প্রচলিত পূর্বাভাস দেওয়ার ব্যবস্থাটিকে উন্নততর করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেরিতে হলেও সেই প্রয়োজনীয়তা অবশেষে বুঝেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ ক্ষেত্রে তাদের নবতম উদ্যোগ ‘মিশন মৌসম’। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই ‘মিশন’-এ সম্মতি জানিয়েছে। দু’বছরের বেশি সময়ের জন্য ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের এই উদ্যোগটির মূল লক্ষ্য— ভারতের চরম আবহাওয়াজনিত অবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সংক্রান্ত বিষয়ে পূর্বাভাস দানের ক্ষমতাকে আরও বৃদ্ধি করা। বর্ষা, বাতাসের গুণমান, চরম আবহাওয়া, ঘূর্ণিঝড় এবং কুয়াশা, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে আরও নিখুঁত এবং সময়নির্দিষ্ট পূর্বাভাসের উপর জোর দেবে এই উদ্যোগ। এই উদ্দেশ্যে আরও ৭০টি ডপলার রেডার, ১০ উইন্ড প্রোফাইলার (বিভিন্ন উচ্চতা থেকে বাতাসের গতি এবং দিক নির্ণয়কারী যন্ত্র) এবং ১০টি রেডিয়োমিটার যুক্ত হবে।

কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই। সৌজন্যে, এ দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবচিত্র। পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বহুল বিজ্ঞাপিত সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলি যে ভাবে প্রকৃত সমস্যা সমাধানে এবং প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, তাতে ‘মিশন মৌসম’-এর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অধিকতর আশাবাদী হওয়া মুশকিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাধের ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। বহু অর্থব্যয়ে, ঢাক পিটিয়ে তা চালু হলেও গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যটি এখনও দূর অস্ত্। আবহাওয়া পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূবিজ্ঞান মন্ত্রক ২০১২-য় চালু করেছিল ‘ন্যাশনাল মনসুন মিশন’। মূল লক্ষ্য ছিল কৃষিনির্ভর দেশটিতে বর্ষার বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত পূর্বাভাস আরও জোরদার করা। অতঃপর এক যুগ অতিক্রান্ত। নিঃসন্দেহে পূর্বের তুলনায় পূর্বাভাসব্যবস্থা উন্নততর হয়েছে। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব জলবায়ুর পরিপ্রেক্ষিতে তা কতটুকু? জলোচ্ছ্বাস, হড়পা বান, ভূমিধসের পূর্বাভাসের ব্যবস্থাটি এখনও জোরদার করা যায়নি। ২০১৩-য় কেদারনাথ বিপর্যয়ের পর পূর্বাভাসের বিষয়টি উন্নত করার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছিল। তার পরও একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে। বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি, সম্পত্তিহানি আটকানো যায়নি। কেরলের ওয়েনাড়ের বিপর্যয়ের পর জিএসআই-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, তাদের জেলাভিত্তিক ভূমিধসের সতর্কবার্তার মডেলটি এখনও পরীক্ষামূলক স্তরে আছে। এই বিষয়গুলি এখনও পিছিয়ে থাকলে সার্বিক ভাবে কোনও লক্ষণীয় পরিবর্তন প্রত্যাশা করা চলে না।

একই ভাবে গত বছর ‘গ্লেসিয়াল লেক’ বিপর্যয়ের কারণে সিকিম ও সংলগ্ন অঞ্চলে হড়পা বানের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে ভারত। জানা গিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কল্যাণে একাধিক হিমবাহ-হ্রদের অবস্থাই বিপজ্জনক। অবিলম্বে এই ধরনের বিপজ্জনক জলাশয়গুলি সম্পর্কে বিশদ ও নিখুঁত তথ্যের প্রয়োজন। সে কাজ কত দূর এগিয়েছে? দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের-প্রতিরোধী হিসাবে গড়ে তুলতে গেলে শুধুমাত্র ঝড়-বৃষ্টি-খরার পূর্বাভাসই যথেষ্ট নয়। শহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত এলাকাও যাতে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা করা দরকার। তার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি বিভাগের উন্নতি এবং পারস্পরিক সমন্বয় সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ প্রয়োজন। এই বিষয়টিতে ভারত এখনও বহু পিছিয়ে আছে। এই কারণে, অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস মিললেও হড়পা বানের সতর্কবার্তা মিলছে না, ঝড়ের প্রস্তুতি নেওয়া সম্পূর্ণ হলেও বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে, বহু প্রকল্প, কর্মসূচি, মিশন কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হচ্ছে। ‘মিশন মৌসম’-এর কৃতিত্ব নিয়ে ঢাক পেটানোর পূর্বে এই বিষয়গুলি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভাবনাচিন্তা করুক।

পাঠ্যপুস্তকের মতে ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কিন্তু কেতাবি বিদ্যা আর বাস্তব অভিজ্ঞতা কবেই বা মিলেছে? বঙ্গদেশের কবি তো সেই কোন কালেই ‘এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর’ লিখে পাঠকের মেঘভারাক্রান্ত মন আরও ভারী করে গিয়েছেন। আর, কালের গতিকে আশ্বিনও এখন শ্বাসরোধকর আর্দ্র উত্তাপের কবলে— এই ঘর্মাক্ত বদ্ধভূমিতে বসে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’ আওড়াতে বললে বালকবালিকারাও ফিক করে হাসবে। দোষ কালের নয়, মানুষের। জীবজগতের এই মহাপ্রাণীটি যত সভ্য এবং উন্নত হয়েছে, এই গ্রহের স্থলে জলে অন্তরিক্ষে তার দাপট ততই বেড়েছে। বিশেষত গত আড়াইশো বছরে, শিল্পবিপ্লব এবং তার উত্তরকাণ্ডের ঠেলায় এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে উঠেছে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রে নীলকণ্ঠ-রূপী ঋত্বিক ঘটকের সেই ঘোষণা: “ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে! পৃথিবীর জলবায়ুতে আগুন লাগলে বাঙালির শরৎই বা তার অমল মহিমা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে অথবা কমলবনে রক্ষা পাবে কী করে? বস্তুত, বিশ্ব উষ্ণায়নের অগ্নিবলয় ইদানীং গ্রাস করে ফেলেছে বিধিবদ্ধ হেমন্তঋতুর প্রথম মাসটিকেও। এই ১৪৩১ বঙ্গাব্দে ‘কচি সংসদ’ লিখতে বসলে পরশুরাম গোটা কার্তিক মাসের একটি দিনের কথা ভেবেও ‘শেষরাত্রে একটু ঘনীভূত হইয়া শুইতে হয়’ গোছের বাক্য লিখতে পারতেন না, তাঁর সত্যনিষ্ঠ কলম সরত না কিছুতেই।” অতএব, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার সম্মিলিত উদ্যোগে নিরন্তর সুসিদ্ধ হতে হতে বঙ্গজন শেষ অবধি অগ্রহায়ণে উপনীত।

এক কালে পয়েলা অগ্রহায়ণ দিনটির বিশেষ মহিমা ছিল। নামেই তার পরিচয় নিহিত আছে: অগ্রহায়ণ শব্দের আদি অর্থ বৎসরের প্রথম মাস। এই মাসের অন্য নাম মার্গশীর্ষ। গীতার দশম অধ্যায়ে পার্থসারথি নিজের সর্বময় মহিমার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে বলেন, ‘মাসের মধ্যে আমি মার্গশীর্ষ’। এক নিঃশ্বাসেই অবশ্য তিনি জানিয়ে দেন ‘ঋতুর মধ্যে আমি কুসুমাকর অর্থাৎ বসন্ত’, তবে তার ফলে বর্ষারম্ভের গৌরব কিছুমাত্র খর্ব হয় না। কেন অগ্রহায়ণ ছিল বার্ষিক গতির শীর্ষ বা প্রথম মাস, সে-কথা সহজেই বোঝা যায়। কৃষিজীবী জনসমাজে ফসল ওঠার সময়টিই নতুন বছর শুরু করার পক্ষে প্রশস্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তদুপরি জলবায়ুর দাক্ষিণ্য: গ্রীষ্মপ্রধান এবং বর্ষণমুখর দেশে বছরের এই সময়টিতে স্বচ্ছ আকাশ এবং হিমেল বাতাস জানিয়ে দিত, সুখের দিন সমাগত। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ অবশ্যই সেই আহ্লাদে বঞ্চিত, তাঁদের জীবনে বছরের এই সময়টি হাড়-হিম-করা দুর্গতির। শিশুপাঠ্য দ্বিপদীতেও আছে সেই বাস্তবের স্বীকৃতি: ‘উঃ কী শীত/ কষে গাও গীত’। কষে গীত গাওয়া ছাড়া গরিবের শীত-তাড়ানোর আর কোনও উপায় নেই, সেই সুকঠিন সত্যটি শিশুদের কাছে ফাঁস করে দিতে সে-কালের লেখক দ্বিধাহীন ছিলেন। তবে কিনা, ঋতুচক্রের সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি, উৎসব ইত্যাদির কথা ও কাহিনি রচনায় শ্রমজীবী মানুষের কথা স্রষ্টারা কতটুকুই বা মনে রেখেছেন? সুতরাং কালক্রমে মার্গশীর্ষের আসন থেকে বিচ্যুত হলেও এই মাসটি বাঙালির সামাজিক জীবনে অনেক কাল অবধি সমাদর পেয়ে এসেছে। তার একটি উৎকৃষ্ট নজির আছে বিবাহের বর্ষপঞ্জিতে। আজও বঙ্গসমাজের একটি বড় অংশে বিবাহের কাল হিসাবে এই মাসটির বিশেষ আকর্ষণ আছে, যে আকর্ষণ তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের চিহ্নবাহী।

কৃষিব্যবস্থা এবং তার উপর ভিত্তিশীল সামাজিক জীবনধারা থেকে এই ঐতিহ্যের উদ্ভব, আজ তা বহুলাংশে স্মৃতিমাত্র। তা নিয়ে আক্ষেপের কোনও যুক্তি নেই, যুগের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই অর্থনীতি বদলাবে, সমাজও তার অনুগামী হবে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। সে-প্রশ্ন পরিবর্তনের গতি এবং প্রকৃতি নিয়ে। যে গতিতে এবং যে ভাবে অর্থনীতির রূপান্তর ঘটছে, তার প্রভাবে সমাজের চেহারা ও চরিত্রে রাতারাতি অকল্পনীয় পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, তাকে কি যুগধর্ম বলে স্বাভাবিক বলে স্বীকার করা যায়? অন্য সব তর্ক সরিয়ে রাখলেও একটি প্রশ্নকে কোনও ভাবেই সরানো যাবে না। সেটি অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। ‘মানবসভ্যতা’র এমন অভূতপূর্ব অভিঘাত এই গ্রহ আর কত দিন সহ্য করতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তরে দুনিয়ার প্রকৃতি এবং পরিবেশ প্রতি মুহূর্তে যে অগণন সঙ্কেত দিয়ে চলেছে, তার মর্মার্থ অতি স্পষ্ট: শিয়রে শমন। মার্গশীর্ষের এই মাসে বঙ্গভূমির বিজাতীয় আকাশে এবং বাতাসে সেই সঙ্কেতই প্রকট। শরৎ, হেমন্ত বা শীত— শব্দগুলি থাকবে, তাদের অর্থ উত্তরোত্তর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে অচিরেই বোধ করি দিগন্তে বিলীন হয়ে যাবে। মানুষের বিবেচনাহীন আগ্রাসী কাজকর্মের কারণেই যে বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে কথা বহু আলোচিত।

এই বিষয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় এক নতুন দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। আন্টার্কটিকার বরফের উপর কার্বন ডাইঅক্সাইডের ছাপ ইঙ্গিত করছে যে, এত দিন বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গিয়েছে। ইংল্যান্ডের দুই পরিবেশ-গবেষকের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিশ্বের মানুষের কাজকর্মজনিত কারণে অষ্টাদশ শতকের তুলনায় গড় তাপমাত্রা ২০২৩ সালের শেষের দিকে বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৪৯ ডিগ্রি। এই বছর তা আরও খানিক বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতকের তাপমাত্রাকে যদি ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়, তা হলে বিপদসীমা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। অত্যধিক গরমে, খামখেয়ালি বৃষ্টিপাতে, ঘন ঘন শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে বিপদসীমা পার হওয়ার কুপ্রভাব ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছে মানবসভ্যতা। আমরা কলকাতার অগ্রহায়ণে বসে ঘামছি। ফ্যান, এসি চলছে দাপটের সঙ্গে।