‘দ্য গডফাদার’ ছবিটি হয়তো সকলেই দেখেছেন। কিন্তু এর নেপথ্য কাহিনিটিও কম আকর্ষণীয় নয়। এবছর ছবিটি দেখা যাবে ৩০ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। বড় পর্দায় ছবিটি দেখার সুযোগ দর্শকরা মিস করতে চাইছেন না। কিন্তু দেখার আগে একবার জেনে নেওয়া যাক ছবিটি তৈরির আগে ঠিক কী ঘটেছিল।
নির্দেশক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা শুরুতে একটু চিন্তায় ছিলেন, ‘দ্য গডফাদার’ ছবিতে প্রধান ভূমিকার জন্য কাকে বাছবেন, তা নিয়ে। তাঁর ইচ্ছার একটা তালিকা তৈরি করে শীর্ষ পছন্দ হিসাবে লেখেন, মাইকেল কার্লিওনি চরিত্রে আল পাচিনো, সনি কার্লিওনি হিসাবে জেমস কান এবং টম হ্যাগেন হিসাবে রবার্ট ডুভালের নাম। চলচ্চিত্রটির শুটিং কোথায় হবে এবং এর ক্রমবর্ধমান বাজেট, সবই তাঁকে বেশ সমস্যায় ফেলেছিল। একদিকে পরিচালক কপোলা, কল্পনাশীল ও প্রাণবন্ত এক তরুণ, এই হেভিওয়েট অভিনেতাদের কাস্ট করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন- অন্যদিকে ছিলেন রবার্ট ইভান্স, স্টুডিও প্রধান যিনি তখনও এই তরুণ পরিচালক সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারছেন না। এদিকে মুখ্য ভূমিকা ভিটো কার্লিওনির চরিত্রই বা কে করবে, তা-ও তখন অনিশ্চিত। এদিকে সাতচল্লিশ বছর বয়সি, মার্লন ব্র্যান্ডোকে ইন্ডাস্ট্রিতে তখন সকলে এক ডাকে চেনেন। গত এক দশক ধরে, অভিনেতার প্রায় সমস্ত চলচ্চিত্রই বক্স অফিসে ঝড় তুলেছিল। কিন্তু ইদানীং সহজেই মেজাজ হারিয়ে ফেলায় বারবার তাঁর সুনাম ব্যাহত হচ্ছিল।
১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে ‘দ্য গডফাদার’ উপন্যাসের লেখক মারিও পুজো, নর্থ ক্যারোলিনার একটি ওয়েট লস ক্লিনিকে গিয়েছিলেন। সেখানে, তিনি সকালের কাগজে পড়েন যে, অভিনেতা ড্যানি থমাস নাকি ভিটো কর্লিয়নের চরিত্রে অভিনয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে, প্যারামাউন্ট পিকচার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভাবছেন। থমাস ততদিনে ‘দ্য ড্যানি থমাস শো’-সহ টেলিভিশনের কয়েকটি হিট প্রযোজনা করার সুবাদে বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন।
কিন্তু পুজোকে এই খবর হতাশ করল। তিনি ব্র্যান্ডোর কাছে নিজের হাতে লেখা একটি দীর্ঘ চিঠি পাঠিয়ে দেন। তাতে জানান যে, তিনি ব্যান্ডোকেই ‘দ্য গডফাদার’ লেখার সময় নামভূমিকায় কল্পনা করেছিলেন। চিঠির উপরে পুজো তাঁর ঠিকানাটি লিখে রেখেছিলেন, ‘নর্থ ক্যারোলিনা ফ্যাট ফার্ম’।
চিঠিটি শুরু হয়েছিল এভাবে, ‘প্রিয় মিঃ ব্র্যান্ডো, আমি দ্য গডফাদার নামে একটি বই লিখেছিলাম যা কিছুটা সাফল্য পেয়েছে এবং আমি মনে করি আপনিই একমাত্র অভিনেতা যিনি গডফাদারের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারেন।’
এই চিঠিটি ব্র্যান্ডোর জীবনে এমন একটি সময়ে এসেছিল যখন তিনি মরিয়া হয়ে একটি ভালো ভূমিকার অন্বেষণ করছিলেন। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে সেইসময় বিপর্যস্ত ছিলেন এই মধ্যবয়সি অভিনেতা। তাঁর প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিবেচিত হওয়া সত্বেও, ঋণের বোঝায় জর্জরিত ব্র্যান্ডো, ঘুমের ওষুধের উপর পুরোদমে নির্ভরশীল ছিলেন। তৃতীয়বার বিবাহবিচ্ছেদের দিকে এগোচ্ছিলেন এবং আর কখনও অভিনেতা হিসাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি বাড়িতে তাঁর এলোমেলো জীবনযাপন, যেখানে তাঁর সর্বক্ষণের সহকারী, অ্যালিস মার্চাক তাঁর দেখাশোনা করতেন।
প্যারামাউন্ট তখনও গডফাদারের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য একজন অভিনেতার সন্ধান করছে। এই সময়ই পুজোর চিঠি সমেত তাঁর বইটি ব্র্যান্ডোর হাতে তুলে দেন মার্চাক। কিন্তু প্রথমিকভাবে অভিনেতা বইটি মার্চাককে ফিরিয়ে দেন। তিনি উদাসীনভাবে বলেন, ‘এটি একটি মাফিয়া ডন সম্পর্কে বই। আমি মাফিয়াদের গডফাদার নই। আমি কোনও মাফিয়াকে গ্লোরিফাই করতে চাই না।’
কিন্তু মার্চাক নাছোড়বান্দা। তাই ব্র্যান্ডো সপ্তাহান্তে বইটি পড়েন। শেষ পর্যন্ত ব্র্যান্ডো বলেন, ‘আমার একটা ফোন করা উচিত এবং পুজোকে ধন্যবাদ জানানো উচিত এই চরিত্রে আমার কথা ভাবার জন্য আর আমায় বইটি পাঠানোর জন্য।’ ব্র্যান্ডো ‘গডফাদার’ ছবিটি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, ব্র্যান্ডোর কাছে পাঠানো সমস্ত স্ক্রিপ্ট এবং বই পড়ার দায়িত্ব নেন মার্চাক। পল নিউম্যান, ব্র্যান্ডোকে তাঁর পছন্দের প্রধান ভূমিকার প্রস্তাব দেওয়ার পরে, তিনি ‘ডার্টি হ্যারি’, ‘বুচ ক্যাসিডি’ এবং ‘সানড্যান্স কিড’-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ঋণ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্র্যান্ডোর লক্ষ লক্ষ টাকার প্রয়োজন ছিল এবং সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বজায় রাখার জন্য তাঁকে তাঁর মাদকের অভ্যাস ত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি মার্চাককে কথা দিয়েছিলেন যে, দিনে একটি ভ্যালিয়ামের বেশি খাবেন না। তবে তিনি ছবিটি করতে রাজি একমাত্র যদি তিন সপ্তাহের বেশি শুটিংয়ের প্রয়োজন না হয়।
পরিচালক কপোলার মাথায় প্রধান চরিত্রের জন্য দুজন অভিনেতার নাম ঘুরপাক খাচ্ছিল। মার্লন ব্র্যান্ডো অথবা লরেন্স অলিভিয়ার। শেষ পর্যন্ত ‘গডফাদার’-এর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য, যে-বলিষ্ঠ অভিনেতা প্রয়োজন, তা তিনি সাতচল্লিশ বছর বয়সের ব্র্যান্ডোর মধ্যে খুঁজে পেলেন। ইতালীও-আমেরিকান অপরাধের বস হিসাবে এরপর ব্র্যান্ডো যা করলেন, তা ইতিহাস। কলকাতার দর্শক হয়তো পর্দায় আবার ‘গড ফাদার’-কে পেয়ে, সেই ইতিহাসের আঁচটাই পুরোদমে উপভোগ করতে চাইছেন।