মহাকুম্ভ প্রতি ১২ বছর অন্তর আয়োজিত একটি পুণ্য পার্বণ যেখানে সাধারণ মানুষ, স্নানার্থী ও পুণ্যার্থীরা ছাড়াও যোগ দেন সাধু সমাজ। এ যেন আস্থা, বিশ্বাস ও সনাতন সংস্কৃতির মহামিলন মেলা। মহাকুম্ভ আরম্ভ হয় পৌষ পূর্ণিমায় স্নান পর্ব দিয়ে। আসন্ন ২০২৫-এর পৌষ পূর্ণিমা ১৩ জানুয়ারি। মহাকুম্ভের শেষ শাহী স্নান হবে মহা শিবরাত্রি পর্বে, ২৬ ফেব্রুয়ারিতে।
এই মহাকুম্ভে সুরক্ষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রদর্শনীর জন্য, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং উপকরণ ব্যবহার করা হবে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেন যে, এই মহাকুম্ভ ২০২৫, এযাবৎ কালের সর্ববৃহৎ বর্ণাঢ্য এবং বৈভব্য আয়োজন হতে যাচ্ছে।
মকর সংক্রান্তির মহাস্নান পর্ব থেকেই এবারে আরম্ভ হতে চলেছে আস্থা ও সনাতনী বিশ্বাসের মহাপার্বণ। এই শতাব্দীর তথা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাকুম্ভ ২০২৫-এ, ২০০টি দেশের প্রতিনিধিদের আগমন হতে চলেছে। ত্রিবেণী সঙ্গম তটে তাদের অভ্যর্থনার জন্য বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম ‘তাম্বু শহর’ গড়ে উঠবে ৪০০০ হেক্টর জুড়ে। এর জন্য ১৭টি পয়েন্টে মহাকুম্ভের বিশেষ প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ত্রিবেণী সঙ্গমে আসা পুণ্যার্থী ও স্নানার্থী-সহ দেশবিদেশের অসংখ্য পর্যটকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করার জন্য, একগুচ্ছ পরিকল্পনা মহাকুম্ভ মেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মহাকুম্ভ নিয়ে সমীক্ষা বৈঠকে বলেন, ‘এই মহাকুম্ভ কেবল উত্তর প্রদেশ নয়, ভারতের গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং-এর কেন্দ্র হয়ে উঠবে।’
বিশাল এই মেলা প্রাঙ্গণে ২৫ হাজার পুণ্যার্থীদের জন্য থাকছে জনতা তাঁবু, ১০ হাজার ক্ষমতা সম্পন্ন বিশাল গঙ্গা প্যান্ডেল বা মণ্ডপও তৈরি করা হচ্ছে। প্রয়াগরাজ মেলা অথারিটির ১৫ তম পরিচালন পরিষদের বৈঠকে কমিশনার সর্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। ২৫টি সেক্টরে ছড়ানো এই মহামেলায় দেড় লক্ষ শৌচালয়, ২৫ হাজার ডাস্টবিন এবং ১০ হাজার সাফাই কর্মচারী মোতায়েন থাকবে।
মহাকুম্ভ ২০২৫ স্পিড বোট তথা মিনি ক্রুজে, মুহূর্তে ত্রিবেণী সঙ্গমে যেতে পারবেন স্নানার্থী ও পুণ্যার্থীরা। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশে ত্রিবেণী সঙ্গমে মহাস্নান প্রক্রিয়াকে আরও সুগম ও সুবিধাজনক করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। পর্যটন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মহাকুম্ভ ২০২৫-এ পুণ্যার্থীদের জন্য ত্রিবেণী বোট ক্লাব স্থল ( যমুনা ব্যাঙ্ক রোড, কিটগঞ্জ ) থেকে স্পিড বোট তথা মিনি ক্রুজ-এর সঞ্চালন করা হবে।
রেল যাতায়াত ও রেল স্টেশনে যাত্রী পরিষেবার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ সরকার এবং রেলের উচ্চ আধিকারীগণ, ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। থাকছে ১২০০ মহাকুম্ভ স্পেশল ট্রেন, ১০ হাজার বাসের ব্যবস্থা। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য ইন্টিগ্রেটেড কন্ট্রোল কমান্ড সিস্টেম। বিমান বন্দর, রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল থেকে মহাকুম্ভ অঞ্চল পর্যন্ত ৫০০০ ক্যামেরা, ২০টি শহর থেকে বিমান পরিষেবা, রাত্রে বিমান অবতরণের বিশেষ সুবিধা থাকছে। হেলিকপ্টার থেকে ত্রিবেণী সঙ্গম ক্ষেত্রের দর্শনের বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানা গেছে। পুণ্যার্থীদের জন্য সাত হাজারের অধিক শাটল বাস থাকবে।
মহাকুম্ভ উপলক্ষে তীর্থযাত্রীদের বিশাল ভিড় মাথায় রেখে, প্রয়াগরাজ স্টেশন-সহ মহানগরের আরও ৮টি স্টেশনের যাত্রীবহন ক্ষমতা ও বিভিন্ন আধুনিক সুখসুবিধার জন্য নানান পরিকল্পনার কাজ শেষ হয়েছে। প্রয়াগরাজ, সুবেদারগঞ্জ, নৈনি, ছিউকি, রামবাগ, ঝুঁসী, প্রয়াগ এবং প্রয়াগঘাট জংশনে কুম্ভমেলা স্পেশাল ট্রেনগুলির সঞ্চালনের ব্যাপক পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই সমস্ত স্টেশনগুলির আধুনিকিকরণের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে।
পূর্ব-উত্তর রেল-সহ উত্তর রেল ও উত্তর মধ্য রেল, মহাকুম্ভ-২০২৫ এর জন্য বিশেষ ট্রেন চালাবার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এর মধ্যেই ভারতীয় রেল যাত্রীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। মহাকুম্ভের সময়ে প্রয়াগরাজ থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪০টি ট্রেন চলাচল করবে। মৌনী অমাবস্যার দিন ৩০০-র বেশি কুম্ভ মেলা স্পেশাল ট্রেন চালানো হবে বলে জানা গেছে।
সমস্ত রেল স্টেশনগুলি থেকে কুম্ভমেলা অঞ্চলে পদব্রজে ওয়ান ওয়ের (একল মার্গ) ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন রেল স্টেশনগুলিতে হোল্ডিং এরিয়া তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। প্রয়াগরাজ জংশনে একটি বিশেষ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ তৈরি করা হয়েছে, যেখান থেকে সম্পূর্ণ কুম্ভমেলা অঞ্চলের পর্যবেক্ষণ করা হবে।
রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রী সুবিধার্থে টিকিটিং ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। মহাকুম্ভ মেলা চলাকালীন প্রতিদিন ১০ লক্ষ টিকিটের ব্যবস্থা থাকবে। রেল কর্তৃপক্ষ যাত্রী সুবিধার্থে নতুন প্ল্যাটফর্ম, নতুন ফুট ওভারব্রিজ, স্টেশনে হোল্ডিং এরিয়া (যাত্রী আশ্রয় স্থল) ও ব্যাপকভাবে সিসি টিভির সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। এই সমস্ত হোল্ডিং এরিয়ায় রেল টিকিটের জন্য অটোমেটিক টিকিট ভেন্ডিং মেশিন লাগানো হয়েছে। রেল কর্মচারীদের সেফটি জ্যাকেটের উপর QR কোড লাগানো হয়েছে। এই মাধ্যমেও যাত্রীরা টিকিট কাটতে পারবেন। প্রয়োজনে টোল ফ্রি নম্বর 1800 4199 139 ব্যবহার করা যাবে।
যাত্রীদের যাতে ন্যূনতম কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়, রেল কর্তৃপক্ষ ভিন্ন ভিন্ন দিশার জন্য আলাদা আলাদা কালার কোডিং করেছে।
মহাকুম্ভ ২০২৫ উপলক্ষে কল্পবাসীদের সুবিধার্থে মহাকুম্ভ মেলা প্রশাসন বিশেষ পরিকল্পনা করছে। মহাকুম্ভের সময় বহু পুণ্যার্থী দীর্ঘদিন অবধি মেলায় এসে ত্রিবেণী সঙ্গম তটে কল্পবাস করেন। এই কল্পবাসকারী পুণ্যার্থীদের কল্পবাসী বলা হয়ে থাকে। এঁরা স্বপাক ভোজন করেন। সরকারের তরফে কল্পবাসীদের বিনা পয়সায় রেশন বণ্টন করা হবে। কল্পবাসী ও পুণ্যার্থীদের জন্য রান্নার জিনিস ও গ্যাসের বিশেষ ব্যবস্থা করবে প্রশাসন। সরকারি রেশন দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও মেলায় সর্বসাধারণের ভোজনের জন্য ভান্ডারার আয়োজন করা হবে।
ত্রিবেণী সঙ্গমে পুণ্য স্নানার্থীদের সঙ্গমের জলে স্নান করতে গিয়ে যাতে কোনও দুর্ঘটনার কবলে না পড়তে হয়, তার জন্য অভূতপূর্ব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে মেলা প্রশাসন। জল-পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে থাকবে আন্ডার ওয়াটার ড্রোন। এই ড্রোন ৩০০ মিটার পরিধির মধ্যে যে-কোনও ডুবন্ত মানুষকে খুঁজতে সক্ষম হবে। জানা গেছে ড্রোন-টি মাত্র ১ মিনিটে দেড় কিলোমিটারের মতন দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে।
অস্থায়ী কুম্ভ নগরী অর্থাৎ ত্রিবেণী সঙ্গম অঞ্চলে গাইনোকলজিস্ট এবং পেড্রিয়াটিক চিকিৎসকগণ ২৪ ঘণ্টাই নিযুক্ত থাকবেন। এছাড়া প্রায় ৪০০ চিকিৎসক এই মহান কাজে মোতায়েন থাকবেন এবং পরিষেবা দেবেন বলে জানা গেছে।