তিন বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনের ফল ঘােষণার পর কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে ফের মােদি সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়ালেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সােমবার বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, উপকুলর্তী তিন জেলায় বুলবুলের জন্য ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করে ২৩ হাজার কোটি টাকার অর্থসাহায্য চেয়ে রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রের কাছে। বুলবুলের তাণ্ডবের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদি টুইট করে জানিয়েছিলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাকে প্রয়ােজনীয় আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। একই আশ্বাস ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহেরও। কিন্তু আজ পর্যন্ত এক পয়সাও অর্থ সাহায্য আসেনি কেন্দ্রের কাছ থেকে। এমনকী আগেও যখন এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছিল, তখনও কেন্দ্র কিছু দেয়নি। তবে ‘লেট আস হােপ ফর দ্য বেস্ট’।
আগে আশ্বাস দিলেও এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রের কাছ থেকে ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের অর্থসাহায্য না আসার নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে ধারণা মুখ্যমন্ত্রীর। তবে বুলবুলের পর ত্রাণ বন্টনে রাজনীতি দূর করতে টাস্ক ফোর্স গড়ে তােলা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীরই নির্দেশে।
সােমবার বুলবুল নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে বিধানসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন বিধায়ক গীতা ভুইয়্যা। তখন বিপর্যয় মােকাবিলা দফতরের মন্ত্রী উত্তর দিতে উঠলেও নিজেই জবাব দিতে শুরু করে দেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে। তার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিন দুই চব্বিশ পরগণা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর মিলিয়ে প্রায় ১৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে কৃষিজমিতে চাষের ক্ষতি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৬ জন মানুষের। বুলবুল অধ্যুষিত অঞ্চলে ধান, শাকসজি, ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
গত ৯ নভেম্বর রাজ্যের বুকে আছড়ে পড়ে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। ব্যাপক ক্ষতি হয় উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার উপকূলবর্তী এলাকা ক্ষতি হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বুলবুলের তাণ্ডবের পরে আমি নিজে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ঘুরে দেখেছি। পূর্ব মেদিনীপুর ঘুরে দেখেছে শুভেন্দু অধিকারী। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল রাজ্যে এলে তাদেরও হেলিকপ্টারে করে বুলবুল অধ্যুষিত অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখানাে হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে কোনও অর্থসাহায্যের আশ্বাসটুকুও আসেনি।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে উপেক্ষা থাকলেও রাজ্য এই বুলবুলের মােকাবিলায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, বুলবুলের জন্য অনেক মানুষের প্রাণহানি হতে পারত। কিন্তু রাজ্য সরকার আগেই ৭৮ হাজার মানুষকে বিভিন্ন রেসকিউ সেন্টারে সরিয়ে দিয়েছিল। এছাড়া যাদের বাড়ি ভেঙে গিয়েছে, বাংলা আবাস যােজনায় তাদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ৫ লক্ষ বাড়ির ক্ষতি হয়েছে, সেই সমস্ত বাড়ির সরকারি প্রকল্পের আওতায় তৈরি করে দেওয়া হবে।
অর্থ দফতর ইতিমধ্যেই বুলবুল আক্রান্ত কৃষিজমির জন্য অর্থ দফতর ১২.১৬ কোটি টাকা মঞ্জুর করে দিয়েছে। বুলবুল আক্রান্তদের জন্য ৬ লক্ষ ‘কিট’ বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে। এই কিটের মধ্যে রয়েছে রান্না করার বাসনপত্র, বেবিফুড, পােশাক, স্টোভ ইত্যাদি। জেলাশাসকের তত্ত্বাবধানে সেগুলি বুলবুল আক্রান্তদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ৪ হাজার জনের মধ্যে হারিকেন বিলি করা হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পরিবারকে ৫ লিটার করে কেরােসিন তেল দেওয়া হচ্ছে। মৃতদের পরিবার পিছু ২ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের একশাে শতাংশ শস্যবীমা দেওয়ার কথা ঘােষণা করেছে রাজ্য সরকার।
এছাড়া আগামীদিনে ফ্লাড রিলিফ সেন্টারের সংখ্যা আরও বাড়ানাে হবে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী। নষ্ট হয়ে যাওয়া পাকা ধান থেকে বিকল্প কিছু করা যায় কিনা ভাবা হচ্ছে। রাজ্যের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ধান মজুত রয়েছে। তাই ধান নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। ধানের আড়তদারদের আরও সুবিধে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার বিপরীতে রাজ্য সরকারের এই মানবিক মুখ রাজনৈতিক কৌশলকে ব্যর্থ করার জন্যই। কেউ কেউ মনে করছেন কেন্দ্রীয় সরকার বুলবুলের জন্য অর্থসাহায্য না পাঠিয়ে দুর্যোগ মােকাবিলায় রাজ্য সরকার ব্যর্থ এটাই প্রমাণ করতে চাইছে। সেই কারণেই রাজ্য সরকার বুলবুল আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে রাজ্য সরকার। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সরকার আসবে যাবে, কিন্তু দেশ থাকবে।
অন্যদিকে বুলবুল দুর্যোগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর এই ক্ষোভের নেপথ্যে রাজনীতিই দেখছেন বাম বিরােধী দলনেতা সুজন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, আয়লার সময় যখন মনমােহন সিংহের সরকার রাজ্যকে অর্থসাহায্য দিয়েছিল, সেইসময় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা মথুরাপুরের তৃণমূল সাংসদ সি এম জাটুয়া আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেইসময়ের তৃণমূলের আশঙ্কা ছিল, আয়লা ত্রাণের টাকা পেয়ে কাজ করলে আসন্ন ভােটে বাম সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। তখন তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা কঠিন হবে। সুজনবাবু বলেন, বুলবুল তাণ্ডবের পর বিরােধী দলের পক্ষ থেকে বাম-কংগ্রেস কিন্তু পথে নেমেছে। দুর্যোগ নিয়ে তৃণমূলের মতাে তাঁর রাজনীতি করেন না বলে জানান সুজনবাবু।