পূর্ব প্রকাশিতর পর
তারপরে আসে নিষাদজাতীয় মানুষ, যাদের ইউরোপীয় পণ্ডিতদের পরিভাষায় Austric বা Austro-Asiatic বলে। এদের ভাষা এখন পরিবর্তিত আকারে কোল খাসিয়া আর নিকোবারীদের ভাষা ব’লে বিদ্যমান—মুন্ডারী, সাঁওতালী, হো কুরকুঁ গদব শবর প্রভৃতি ভাষা যারা বলে তারা এদের সাক্ষাৎ বংশধর। সারা বাঙলা জুড়ে এদের বাস ছিল। এখন যারা এদের মধ্যে বনে-পাহাড়ে গিয়ে আছে তারা-ই নিজেদের পৃথক সত্তা বজায় রেখেছে, আর বাকি সব বাঙলা-দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে মিলে গিয়েছে— ভাষা নিজেদের যা ছিল, তা ত্যাগ ক’রে, বাঙলা নিয়ে, ক্রমে বাঙালী হ’য়ে গিয়েছে। এরা চাষবাস করত, কাপড় বুনত, ভারতের সভ্যতার বুনিয়াদ পত্তন হয়ে এদেরই হাতে। তারপর আসে দ্রাবিড়ভাষী জাতি। এরা নিষাদদের পাশে সারা বাঙলায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপরে নাম করতে হয় পূর্বদেশ থেকে আগত কিরাতদের। নাক চ্যাপ্টা, হলদে রঙ, বেঁটেখাটো মানুষ ছিল এরা।
এদের বসবাস হয় হিমালয়ের দক্ষিণ অঞ্চলে, উত্তর বিহার আর উত্তর-বাঙলায়, পূর্ব বাঙলায়, আর সারা আসাম জুড়ে। সভ্যতায় এরা তেমন অগ্রসর ছিল না, কিন্তু বাঙালী জনগণের গঠনে উপাদানস্বরূপ এরাও এসেছে—বিশেষ ক’রে উত্তর আর পূর্ব বঙ্গে। শেষে আসে আর্য্যভাষী জাতি। পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার সর্বত্রই এই আর্য্যভাষী জাতি স্থানীয় নিষাদ কিরাত দ্রাবিড়দের সঙ্গে অনুলোম আর প্রতিলোম বিবাহে বদ্ধ হ’তে থাকে, এদের ভাষা একটি প্রবর্ধমান মিশ্রজাতির সভ্যতার বাহন হ’য়ে দাঁড়ায়। সংস্কৃত আর প্রাকৃত রূপে এই ভাষা সর্বত্র প্রসারিত হয়, আর শেষে মগধ হ’য়ে এই আর্য্যভাষা বাঙলা দেশে এসে বাঙলা ভাষার রূপ নিয়ে বাঙলার মিশ্র নিষাদ কিরাত দ্রাবিড়, আর্য্যজাতির মানুষদের ‘বাঙালী’ বা ‘বঙ্গভাষী জাতি বা জন রূপে গঠন ক’রে তেলে।
‘গৌড়’, বাঙ্গালা দেশের অন্যতম নাম—একথা আমরা সকলেই জানি। এই নাম, আর ‘বাঙ্গালাদেশে’ বা ‘বঙ্গদেশ’— এই দুইটি নামের পিছনে যে-ইতিহাস আছে, তাহা কৌতূহলোদ্দীপক।
ভারত-বিভাগের পরে যখন পাকিস্থান সৃষ্ট হইল, তখন হইতে প্রায় বিশ বৎসর হইতে চলিল, ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাঙ্গালাদেশ’, যাহা সমগ্র বাঙ্গালা-ভাষী জনগমের অবিভক্ত মাতৃভূমি ছিল, তাহার নামেও ভাঙ্গন ধরিল। ভাষার ভিত্তিতে, বঙ্গভাষী সমগ্র বাঙ্গালাদেশে প্রচলিত এক-মাত্র ভাষা বাঙ্গালা-ভাষার কতকগুলি লক্ষণীয় কিন্তু অপ্রধান। (অর্থাৎ যাহা বোধগম্যতার হানি করে না এমন) প্রান্তিক ভেদ বা পার্থক্য ধরিয়া, মোটামুটি ভাবে, ‘‘পশ্চিম বঙ্গ’’ ও ‘পূর্ব বঙ্গ’’, এই দুইটি ভাগে সমগ্র বঙ্গদেশকে বিভাগ করিয়া দেখিতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম।
ইংরেজ আমলের বাঙ্গালাদেশের প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমান ডিভিসনের অন্তর্গত জেলাগুলির কথ্য ভাষার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য ধরিয়া, ঐ দুই ডিভিশনকে ‘‘পশ্চিম বঙ্গ’’ বলিয়া ধরা হইত, এবং তদ্রূপ রাজশাহী ঢাকা ও চট্টগ্রাম ডিভিসনের অধীন জেলাগুলিকে তেমনি ‘‘পূর্ব বঙ্গ’’ পর্যায়ে ফেলা হইত— উত্তর বঙ্গের স্বতন্ত্র মর্যাদা স্বীকৃত হয় নাই, ভাষা-ভিত্তিক বিচারে কতকগুলি বাঙ্গালা ধ্বনির উচ্চারণ ধরিয়া উত্তর বঙ্গের কথ্য ভাষাগুলিকে পূর্ব বঙ্গের কথ্য ভাষার সামিল বা তাহার সহিত সম্পৃক্ত করিয়া ধরা হইত। ভাষা-বিষয়ক, হ-কার ও মহাপ্রাণ ঘোষবদ্ ধ্বনি ‘‘ঘ ঝ ঢ ধ ভ’’, এই বর্ণগুলির উচ্চারণ, সাধারণতঃ স্বরধ্বনির উচ্চারণে অপিনিহিতির সংরক্ষণ ও অভিশ্রুতির অভাব—এইগুলিকে আশ্রয় করিয়াই বিদ্যমান ছিল পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গের কথ্য ভাষার মুখ্য প্রভেদ। (ক্রমশ)