তিনি ছিলেন গোটা ইন্ডাস্ট্রির ‘সলিলদা’। শুধু সুরকার হিসেবে তাঁর পরিচিতির গণ্ডিকে সীমাবদ্ধ করা চলে না। কারণ তিনি ছিলেন একাধারে একজন সঙ্গীতজ্ঞ, লেখক এবং কবিও। একসময় হিন্দি, বাংলা এবং দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে, দাপিয়ে কাজ করেছিলেন সলিল চৌধুরী। ৫০-এর দশক থেকে ৬০-এর দশক পর্যন্ত সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দুই শৈলীর ক্ষেত্রেই তিনি অসামান্য় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বাঁশি, এসরাজ, বেহালাতে যতটা সাবলীল ছিলেন,ততটাই দক্ষ ছিলেন পিয়ানোতে। গীতিকার এবং লেখক হিসেবেও তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
সলিল চৌধুরী ১৯৫৩ সালে বাংলা ছবি ‘রিকশাওয়ালা’ হিন্দিতে রূপান্তরিত করার সময়ে বম্বে চলে যান। এই হিন্দি রিমেক তৈরি করেছিলেন বিমল রায়। নাম ছিল ‘দো বিঘা জমিন’। এভাবে হিন্দি চলচ্চিত্রে তাঁর কাজ শুরু হয়। এই চলচ্চিত্রের সাফল্য আরও বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবিতে তাঁর কাজের সূচনা করে। অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৫৮-এর ‘মধুমতি’।
একশো বছরে পদার্পণ করার এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তাঁকে স্মরণ করলেন তাঁর পুত্র সঞ্জয় চৌধুরী। বহু স্মৃতি রয়েছে তাঁর এই বিদগ্ধ মানুষটিকে ঘিরে। সঞ্জয় নিজেও একজন কৃতী ব্য়াকগ্রাউন্ড স্কোরার। তাঁর সুর সংযোজনায় একদা আমরা মুগ্ধ হয়েছি ‘সরফরোশ’, ‘ওয়েডনেস ডে’, ‘জব উই মেট’ প্রভৃতি ছবিতে। বহু দক্ষিণ ভারতীয় ছবির অবহ সংগীতে তিনি তাঁর দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তাঁর এই সুরের সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার মূল নাবিক কিন্তু ছিলেন তাঁর বাবা। শুনে নেওয়া যাক তাঁর স্মৃতিকথন।
শতবর্ষে পা দিলেন সলিল চৌধুরী। তাঁর কর্মজীবনের এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তাঁর সুর এতটা জনপ্রিয়! এটার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি?
একেই কালজয়ী শিল্পী বলে। অথচ দুঃখের বিষয় হল, বাবা যখন বম্বে থেকে ফেরত চলে যাচ্ছেন একটা আক্ষেপ নিয়ে যে, তিনি তাঁর প্রাপ্য রেকগনিশনটা পেলেন না- তখন আমায় বলেছিলেন ‘তুই দেখে নিস আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর লোকে আমার কদর করবে। লোকে বুঝবে আমার মিউজিক কী, আমার গণসঙ্গীত কী, আমার কবিতা কী!’ প্রতিটা গান, প্রতিটা কবিতাই আসলে বাবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এত প্রেম তাঁর সৃষ্টিতে!
হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর লতাকে নিয়ে একবার বাবার রেকর্ডিংয়ে এসেছিলেন। অ্যারেঞ্জমেন্ট শুনে একটু কনফিউজড হয়ে ফিরেছিলেন। একবার চেলো ঢুকছে, কোথাও ফ্লুট কোথাও ভায়োলিন। এক সপ্তাহ পরে পুরো গানটা শুনে লতাকে বলেছিলেন, ‘সুরটা কিছুতেই কেন মাথা থেকে বেরোচ্ছে না বলতো!’। এটাই তো বাবার সুরের ম্যাজিক। মুখড়াটা গাইলে, অন্তরাতে যেতেই হবে, আবার মুখড়ায় না-ফিরে উপায় নেই এমনই কর্ড অ্যারেঞ্জমেন্ট, এমনই নোটস। আসলে বাবা সময়ের চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর এগিয়ে ছিলেন। সেটাই তাঁকে আজও আলোচনার শীর্ষে রেখেছে।
বাবার সঙ্গে এই যে আপনার নিবিড় অন্তরঙ্গতা, সেটার কারণ কী?
অনেকেই জানেন না, বাবা নিজে হাতে আমায় বাড়িতে ডেলিভারি করিয়েছিলেন। মানে নাড়ি কাটা থেকে সবটা! আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, আমার আর বাবার জন্মের তারিখটা একই, ১৯ নভেম্বর। হয়তো সেই জন্যই আমি বাবার খুব ক্লোজ ছিলাম।
বাবার কাছে মিউজিক শেখার ব্যাপারটা কেমন ছিল?
বাবার কাছে মিউজিক আর রান্না শেখা, দুটোই অ্যামেজিং এক্সপিরিয়েন্স! বাবা একবার বিরিয়ানি রাঁধছেন। গোটা গরম মশলাগুলো কাপড়ের পুঁটলি করে চাল ফোটার সময় সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন। কেন, প্রশ্ন করায় বললেন, ‘ফ্লেভারটাই আসল বুঝলি। এটা একটা মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের মতো। লবঙ্গ, দারচিনি, এলাচ সব আলাদা আলাদা ফ্লেভার! অ্যরোমাটা মিশে হচ্ছে একটা কম্পোজিশন’। মানে কাউন্টার পয়েন্ট, মেলোডি এগুলো আলাদা আলাদা করে ফিল করার জিনিস।‘ হি ওয়াজ আ বর্ন আর্টিস্ট!
আপনি তো ছোটো থেকে লতাজি, আশাজির মতো স্বনামধন্য গায়িকাদের দেখেছেন বাড়িতে আসতে। সেই সব অভিজ্ঞতা কেমন ছিল ?
মজার কথা হল এঁদের গাওয়া ওই সব জনপ্রিয় গানের সুর কিন্তু বাবা স্টুডিয়ো টানা বসে তৈরি করতেন না। বাবা সুর করতেন ঘুরে ঘুরে। মানে কিছুটা সুর হয়তো রান্নাঘরে কাজের সময় ভাবলেন, বাকিটা বাথরুমে, শেষটা হয়তো জুহু বিচে। সুরটা ভেবে ফেলার পর বাবার প্রথম কাজ হতো মা-কে ( সবিতা চৌধুরী ) সেটা তুলিয়ে দেওয়া। মা-ই কিন্তু লতাজি, আশাজি প্রমুখকে তোলাতেন সেই গান। সত্যি বলতে কী আমার মা না থাকলে বাবার ওই অত সুর, অত গান, সংরক্ষণই হতো না। বাবা রেকর্ডিং সেরে বাড়ি চলে আসার পরে, মা সারারাত রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে বসে ওগুলো ট্রান্সফার নিয়ে, ভোরবেলা নিজেই গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
সলিলবাবুর রেকর্ডিংয়ের কথা একটু বলুন।
আমার তখন বছর সাতেক বয়স। বাবার সঙ্গে যেতাম রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে। তখন ওই স্টুডিয়োর ভারী কাঠের দরজাটা আমার কাছে ছিল হেভেনস ডোর। ভিতরে প্রায় একশোজন মিউজিশিয়ান বসে রিহার্সাল করছেন। সেটা দেখার মতো ছিল। ওঁরা আসতেন বাবা ঢোকার একঘণ্টা আগে, অর্থাৎ ৯টায়। ওঁরা জানতেন বাবা ঢোকা মানেই সারাদিন ঘাম ছুটিয়ে দেবেন, অদ্ভুত সব নোটস আর সুরের মারপ্যাঁচে। ভুল করার অবকাশ নেই। পঞ্চাশটা ভায়োলিন, কুড়ি-বাইশটা গিটার। সঙ্গে চেলো, ট্রমবোন, হার্প, ঢোল। সে এক এলাহি কাণ্ড। আমার মনে হতো আমি এক গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে গেছি। বাবার ইন্স্ট্রুমেন্টেশন মানে সঠিক যন্ত্রের সঠিক রেঞ্জে কম্পোজ করা। একটা ইন্স্ট্রুমেন্টের নোট সিলেকশন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একই রকমের ইম্পর্ট্যান্ট, সিঙ্গারের গলার রেঞ্জ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘নিসা গামা পানি সারেগা, গা রে গা রে পাখি গা’, যখন হিন্দিতে জেসু দাস গাইলেন, বাবা ওটার স্কেল একেবারে আলাদা করে দিয়েছিলেন।
বাবার শেখানো সেরা পরামর্শ কোনটি বলে মনে হয় এখন কাজ করতে গিয়ে?
বাবা বলতেন যত শুনবে তত শিখবে। লিসনিং ইজ দ্য বেস্ট এক্সারসাইজ। ছোট থেকেই ফোক, ক্ল্যাসিকাল, রক সমস্ত ধরনের গান শোনার অভ্যাস গড়ে দিয়েছিলেন বাবা। বলতেন ‘মিউজিকের টেক্সচার হল জলের মতো। পাখি,আকাশ, বাতাস, গাছপালা, চাঁদ এমনকী আমাদের হৃদপিণ্ডেরও একটা গতি আছে। আর যাতে লয় আছে, তার ভিতরেই সুর আছে। সেই লয় আর সুরের সংযোগটা যদি তুমি খেয়াল করতে পারো, তাহলে সুর আপনা আপনি আসবে। শব্দও তা-ই। খেয়াল করবে কীভাবে একটি পিঁপড়ে প্রথমে চিনির দানার আশপাশে ঘোরে। ফিরে যায় তারপর সঙ্গী-সাথীদের ডেকে আনে। তারপর সকলে সঙ্গবদ্ধভাবে রানির জন্য চিনির দানা বয়ে নিয়ে যায়! সবেতেই গল্প আছে, ছন্দ আছে।‘ সুর বানাবার সময় বাবা বলতেন, ‘ইন্স্ট্রুমেন্ট নিয়ে বসে সুর ভাববে না। ওতে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। খালি গলায় সুর তৈরি করবে।‘ এই শিক্ষাই এখনও মেনে চলি।