• facebook
  • twitter
Thursday, 28 November, 2024

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

আর ভাষার পিছনে যে কতকগুলি বড়ো-বড়ো জিনিস আছে— যেমন একটি বিশেষ মনোবৃত্তি, এক ধরনের চিন্তা আর কল্পনা, আর এক ধরনের economic life বা অর্থনৈতিক জীবন।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল ছবি।

পূর্ব প্রকাশিতর পর
প্রথম ‘বাঙালী জনগণ’ (বা সাধারণ ভাষায় ব’লতে গেলে বাঙালী ‘জাতি’) ব’লতে এমন এক শ্রেণীর লোককে বুঝি, যারা রক্তে নানা জাতির মিশ্রণ হ’তে পারে, কিন্তু ভাষায় এক—যেহেতু তারা বাঙলা ভাষা বলে। বাঙালীর মধ্যে— অর্থাৎ বঙ্গভাষী জনগণের মধ্যে বামুন, কায়েত, বদ্যি আছে, রাজপুত, ছত্রী, বৈশ্য আছে, যারা নিজেদের খাঁটি বা মিশ্র আর্য্য ব’লে মনে ক’রে থাকে; আছে নানা অন্যজাতীয় ব্যক্তি যাদের উৎপত্তি হ’য়েছে দ্রাবিড় বা কোল অর্থাৎ নিষাদ থেকে, মোঙ্গোল অর্থাৎ কিরাত থেকে। ব্রাহ্মণ, চন্ডাল, বাউরী, পশ্চিমী ছত্রী, চট্টগ্রামের চাকমা, উত্তর বাঙলার রাজবংশী, পশ্চিম বাঙলার মাহিষ্য, হিন্দুস্থান থেকে আগত পশ্চিমা মুসলমান, কত বিভিন্ন বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের মূল বংশগত উৎপত্তি-পৃথক, তারা সকলেই বাঙালী বা বঙ্গভাষী জাতির সামিল হ’য়ে গিয়েছে। বাঙলা ভাষা নিয়েই বাঙালী জাতি বা জনগণ। যত দিন না বাঙলা ভাষা মিলছে তত দিন বাঙালী জনের বা জাতির পাত্তাই নেই।

‘‘একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়’’—বিজয়সিংহ বাঙলা দেশ থেকে গিয়ে সিংহল জয় ক’রেছিলেন, সেই বিজয়সিংহকে বাঙালী জাতির মানুষ ভেবে আমরা আজ কালকার বাঙালীরা গর্ব করি। বিজয় সিংহের হয়তো ‘বঙ্গবাসী’ ছিলেন (এ-সম্বন্ধেও কিন্তু মতভেদ আছে), কিন্তু তাঁকে ‘বাঙালী’ ব’লতে পারি না, কারণ তিনি ‘বঙ্গভাষী’ ছিলেন না, বাঙলা ভাষার উদ্ভব বিজয়সিংহের সময়ে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ বছরের দিকে হয়-ইনি। মোটামুটি এইভাবে কথাটা বলা যায়। বাঙলা ভাষার উৎপত্তির আগে বাঙলা দেশে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন মানব-বংশের বা মূল জাতির লোক এসে বাস আরম্ভ ক’রে দেয়। তাঁদের বংশগত উৎপত্তি ছিল আলাদা, মূল ভাষা ছিল আলাদা, ধর্ম, সভ্যতা সংস্কৃতি রীতিনীতি রহন-সহন চাল-চলন সব আলাদা আলাদা ছিল। খ্রীস্টজন্মের কাছাকাছি সময়ে এদের নিজ নিজ পৃথক্ অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু খ্রীস্টজন্মের পরে, প্রায় হাজার বছরের মধ্যে সব উলট-পালট হ’য়ে গেল। আর্য্যভাষা মাগধী প্রাকৃত আর মাগধী অপভ্রংশ, পশ্চিমের বিহার অঞ্চল থেকে বাঙলা দেশে গড়িয়ে-গড়িয়ে আসে—খ্রীষ্টজন্মের পূর্বেকার কয়েকশত বৎসর ধরে এই আর্য্য ভাষার প্রসার বাঙলা দেশ হ’তে থাকে। পরে এই মাগধী প্রাকৃত আর তার পরেকার রূপ মাগধী অপভ্রংশ, বাঙলা দেশে বাঙলা ভাষার রূপ নেয় খ্রীষ্টজন্মের পরে ৮০০-১০০০ বৎসরের মধ্যে। দেশের প্রায় তাবৎ বিভিন্ন জাতির আর ভাষার লোকেরা এই নবজাত বাঙলা ভাষাই গ্রহণ করে, ভাষায় ভাবে এক ধরনের হ’য়ে যেতে থাকে; পরে তারা সকলে বঙ্গভাষী ‘গৌড় জন’ বা বাঙালী জাতিতে পরিণত হয়। বর্ণভেদ, বৃত্তিভেদ, উচ্চ-নীচ স্তর-ভেদের জন্য বঙ্গভাষী জনগণের বিভিন্ন স্তরের বা দলের মধ্যে সব ক্ষেত্রে বৈবাহিক আদান-প্রদান চলত না, কিন্তু তাতে এক-জাতীয়তার—এক-জনতার—অভাব হয়নি। ভাষা-ই হ’ল এক্ষেত্রে প্রধান বাঁধন।

আর ভাষার পিছনে যে কতকগুলি বড়ো-বড়ো জিনিস আছে— যেমন একটি বিশেষ মনোবৃত্তি, এক ধরনের চিন্তা আর কল্পনা, আর এক ধরনের economic life বা অর্থনৈতিক জীবন। বাঙালী জনের মানুষেরা ভাষায় এক; সংগে-সংগে খাওয়া-দাওয়ার এক (মাছ-ভাত-তেলের ভক্ত এই জাতি বা জন, উত্তর ভারতের মতো দাল-রুটি-ঘি-এর নয়)। পোশাক-পরিচ্ছদে এক (ধুতি-চাদর-গামছা বা মাথা বাঁধবার কাপড় বা রুমাল—আজকাল ধুতির বদলে বর্মা থেকে নেওয়া লুঙ্গি), বাস করবার ঘরেও এক (মাটির বা ছেঁচা বা বোনা বাঁশের দেয়াল, গোলপাতার বা খড়ের চাল, বাঁশের খুঁটি, ভিটার মধ্যে অনেকগুলি পৃথক বা একেনে ঘরের সমাবেশ)।
(ক্রমশ)