শোভন মণ্ডল
হেডক্লার্ক রাঘববাবু বেশ দক্ষতার সঙ্গে সব কিছু সামলাচ্ছিলেন। একেবারে ট্যুর কোম্পানির ম্যানেজারের মতো। মালপত্তরগুলো তোলা হল লঞ্চে। ভাল করে মিলিয়ে নিলেন তিনি। সেই দিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরালেন বিনয়বাবু। মেদিনীপুরের একটা ব্লকের ল্যান্ডের অফিসার। রাঘববাবু না থাকলে এই ট্যুরের ভাবনাই তিনি আনতেন না। অফিসের অডিট শেষ হওয়ার পরে রাঘববাবুই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন, ‘চলুন স্যার, অফিসের সবাই মিলে কোথাও একটা ঘুরে আসা যাক।’ অনেকেই লাফিয়ে উঠেছিল সেদিন। কম্পিউটার অপারেটর রাজু বেশ গদগদ হয়ে বলেছিল, ‘সুন্দরবন যাওয়া যেতে পারে। লঞ্চে কাটান যাবে। বেশ থ্রিলিং একটা ব্যাপার হবে স্যার।’ সবাই হই-হই করেছিল সেদিন।
রাঘববাবু একটা হুইসল নিয়ে এসেছেন কোথা থেকে। জোরে জোরে দু’বার বাজালেন। বিনয়বাবু সিগারেটটা ফেলে ছেলে বিট্টুর হাত ধরে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মনিকা চলো, এবারে ওঠা যাক।’
অফিসের প্রায় পনের জন স্টাফ এসেছে। বিনয়বাবুর মতো কয়েকজনের ফ্যামিলিও আছে। মোট সাকুল্যে ত্রিশ জনের টিম। আর ক্যাটারিংয়ের ছ’জন।
সবাই উঠেছে দেখে লঞ্চের পাটাতন তুলে নেওয়া হল। লঞ্চের সাইরেনটা বাজতেই সকলে এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘দুগগা, দুগগা।’
ক্যাটারিং স্টাফদের লিডার বনমালী সব বাসনপত্রগুলো বস্তা থেকে বের করে টিফিনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সকলেরই খিদে পেয়েছে। কম ভোরে তো বেরয়নি। বিনয়বাবু লঞ্চের ওপরে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে বসে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বিট্টু পিছন থেকে গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, বাঘ কখন দেখব?’ সুন্দরবন যাচ্ছি মানেই বাঘ দেখতে যাচ্ছি— পাঁচবছরের বাচ্চার মনে এই ধারণা চেপে আছে। তাই বাঘের ব্যাপারে প্রথম থেকেই তার উৎসাহ। বনমালী কথাটা শুনতে পেয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘বাবু, দেখতে পাবে, আর একটু এগোক লঞ্চ।’ মনিকাও একটা চেয়ার নিয়ে বিনয়বাবুর পাশে বসলেন। একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে ছেলেকে দিলেন। তারপর বনমালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্যিই কি একটাও বাঘ দেখতে পাব?’ বনমালী কাজ করতে করতেই বলল, ‘ভাগ্যে থাকলে একটা কেন, অনেক বাঘ দেখতে পাবেন?’
লঞ্চটা সাজানো গোছানো। নীচের রুমগুলো অত্যাধুনিক। ছোট-ছোট অনেকগুলো কামরা রয়েছে। বাড়ির মতো না হলেও দু’এক দিন থাকাই যায়। ট্যুরটা দুদিনের। সমস্ত আয়োজনের ভার রাঘববাবুর। এসব কাজ করতে তিনি বেশ উপভোগও করেন। ট্যুর শুরু হওয়া থেকে অনেক দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন। লঞ্চ ছাড়া থেকে একবারও বসেননি। সারাক্ষণ কিছু না কিছু করছেনই। চা হয়ে গেছে রাঘববাবু নিজেই চা পরিবেশন শুরু করে দিলেন। স্ত্রী এসেছে। সে বেচারা একা-একা একটা চেয়ারে বসে ছিল। মনিকা ব্যাপারটা দেখে বললেন, ‘রাঘবদা এবার একটু ওয়াইফের কাছে গিয়ে বসুন।’ রাঘববাবু গদগদ হয়ে স্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বনমালী চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ, রাঘবদা আমরা তো আছি। কোনও চিন্তা নেই।’
লঞ্চ অনেকদূর চলে এসেছে। প্রথম প্রথম কূল ঘেঁষে অনেকটা আসার পর লঞ্চ এখন নদীর মাঝ বরাবর চলছে। একদিকের ডাঙা প্রায় দেখা যাচ্ছে না, তবে সামনের দিকে জঙ্গলের চিহ্ন আস্তে আস্তে প্রকট হচ্ছে। আর একটু এগোতেই জঙ্গলটা যেন কাছাকাছি দেখাচ্ছে। বিনয়বাবু একটা দূরবিন এনেছেন, তাতে চোখ লাগিয়ে দেখছেন। মাঝে মাঝে বিট্টুও কাড়াকাড়ি করছে। রোদ ঝলমল দিন। তবে লঞ্চের ওপরটায় আচ্ছাদন আছে বলে গায়ে রোদ লাগছে না।
বনমালী আর তার টিম সারাক্ষণ খাবারের আয়োজন করেই চলেছে। বনমালীর সঙ্গে যে পাঁচজন এসেছে সকলেই মোটামুটি সমবয়সী। নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মশগুল। শুধু একজন একটু ছোট। বয়স বড়জোর সতের কিংবা আঠার হবে। কিন্তু চুপচাপ। ঠিক যেন আনন্দ করতে পারছে না। রাঘববাবু গিয়ে একবার ধমক দিলেন, ‘কীরে! এত স্লো হলে হবে? হাত চালা!’ তারপর বনমালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘একে কোথা থেকে নিয়ে এসেছেন?’ বনমালী পকোড়া তেলে ছাড়ছিল। বলল, ‘সবাই আমার বাড়ির কাছে থাকে, ক্যানিংয়ে। আমার ক্যাটারিংয়ে কাজ করে, তবে এই ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে। পাড়ারই একজন নিয়ে এসেছিল। বেচারার বাপ-মা কেউ নেই।
সজনেখালিতে থাকত। গত মাস থেকে আমার কাছে থাকে।’ এসব শুনেটুনে রাঘববাবুর বোধহয় একটু মায়া হল। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী নাম তোর?’ মাথা নীচু করে বলল, ‘দিগন্ত’। রাঘববাবু রসিকতা করে বললেন, ‘বাব্বা! নামের বাহার তো বেশ। তা একটু হাত চালিয়ে কাজটা করিস খোকা।’
‘বাবা বাবা! বাঘ!’ বিট্টুর চিৎকারে শুধু বিনয়বাবু নয়, সবাই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে। এতোক্ষণে কেউ খেয়াল করেনি লঞ্চটা জঙ্গলের বেশ কাছ থেকে যাচ্ছে। এতগুলো চোখ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাঘের টিকিটিও দেখতে পেল না। হয় বিট্টু ভুল কিছু দেখেছে। না হলে বাঘ বাবাজি গা-ঢাকা দিয়েছে। তবে প্রায় সবাই প্রথম সম্ভাবনাকে মনে মনে মেনে নিল। রাজামশাই এত সহজে সবার সামনে ধরা দেবেন, সেটা কেউই ভাবতে পারছে না। সকলে নিজের কাজে মন দিলেও দিগন্ত অনেকক্ষণ ধরেই তাকিয়ে থাকল গভীর জঙ্গলের দিকে।
লাঞ্চ শেষ হল প্রায় দেড়টার সময়। রাজু বিনয়বাবুর কানে কানে কানে এসে বলল, ‘স্যার, নীচে গিয়ে আপনারা কি একটু জিরিয়ে নেবেন?’ আসলে রাজু আর কয়েকজন অনেকক্ষণ সুযোগ খুঁজছিল একটা বোতল খোলার। স্যারের জন্য কিছুতেই হচ্ছিল না। নীচেও মহিলাদের ভিড়। ড্রাইভার চিৎকার করে বলল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নামব, সামনেই সজনেখালি।’ এটা বলার পর রাজুর রণে ভঙ্গ দিতে হল।
সজনেখালিতে সবাই নেমে পড়লেও বনমালী আর তার টিম থেকে গেল। এখানে আড়াইঘন্টার সময় বেঁধে দেওয়া হল। কারণ সন্ধে হয়ে গেলে লঞ্চ চালান যাবে না। বর্ডার এরিয়া বলে কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ড্রাইভার সময়ের ব্যাপারটা সবাইকে বেশ কয়েকবার বলে দিল। ড্রাইভারের দায় আছে। একবার দেরি হয়ে গেলে তার সমস্যা হতে পারে। নিয়ম খুব কঠিন।
হইহই করে সবাই নেমে পড়ল। সজনেখালিতে একটা ছোট ঘাট আছে। ঘাটের পাশেই লঞ্চটা বাঁধা হল। দল বেঁধে সকলে এগিয়ে চলেছে। অফিসের অ্যাকাউন্ট ক্লার্ক আনারুল তার বিবিকে নিয়ে এসেছে। সদ্য সাদি হয়েছে। তাই তাদের ব্যাপার-স্যাপার অন্য রকম। খুব হাসি ঠাট্টা করছে, কখনও হাসতে হাসতে একে ওপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। আর চলছে সেলফির ঘটা। ফোটো তোলা যেব তাদের শেষ হয় না। পাশ থেকে রাজু টিপ্পনী কাটল, ‘ভাবি! বাঘের ছবিও দু একটা তুলবেন।’ রাঘববাবু পাশ থেকে যেতে যেতে কথা শুনে মুচকে হেসে বললেন, ‘আনারুল তো এখন বাঘ।’
সবাই মিলে হো হো করে হেসে উঠল খুব। ভাবি খুব লজ্জা পেল মনে হয়। বিট্টুর এসব ভাল লাগছে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কখন বাঘ দেখব মাম্মি?’
সজনেখালির এই অঞ্চলে বাঘের আনাগোনা আছে। তাই এর রাস্তাটাও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। কিছু দূর গেলে একটা ওয়াচ টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। তার পথও তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখান থেকে নীচের জঙ্গলের একটা অংশ দেখা যায়। একটা জলাশয় রয়েছে। আসলে নদীর জলই এই খানে ঢুকেছে। কয়েকটা হরিণ জল খেতে এসেছে এখানে। মনিকা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়েছিলেন ওই দিকে। বিনয়বাবুও চোখে দূরবিন দিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করলেন। না, বাঘ বাবাজির কোনো সন্ধান নেই। বিট্টু বেচারি অস্থির হয়ে উঠেছে। এক দৃষ্টিতে এতোক্ষণ তাকিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়, মাথার হ্যাটটা খুলে সে লাফালাফি শুরু করেছে। পাশ থেকে কে একজন বলে উঠল, ‘আছে, বাঘ আছে।’ বিনয়বাবু আর মনিকা দু’জনেই ঘুরে দেখলেন, দিগন্ত তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে। বিনয়বাবু বেশ হকচকিয়ে গেলেন। ‘তুমি? তুমি কখন এলে?’ এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না সে। মনিকা বললেন, ‘আরে! তুমি শুনলে না, ওরা তো এখানে আগে থাকত’। বিনয়বাবু বনমালীর কথাটা একবার ভাবলেন। আরও কি সব বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু ঘুরে দেখলেন হনহন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দিগন্ত।
আনারুলকে দেখা গেল ভাবির সঙ্গে খুনসুটি করতে। ওরা আছে বেশ। সব চেয়ে বেশি এনজয় বোধহয় ওরাই করছে। মনিকা তাদের দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসলেন।
ওয়াচ-টাওয়ার থেকে ওরা একে একে সবাই নেমে এল। একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম রয়েছে ওখানে। বাঘের মূর্তির সামনে অনেকে পোজ নিল বেশ। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান আর কী! রাঘববাবু একবার হুইসল বাজালেন। আর বেশি দেরি নেই। পনের মিনিটের মধ্যে লঞ্চে পৌঁছতে হবে। বিনয়বাবু বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন রোদ পড়ে গেছে। সূর্য বোধহয় ঢলে পড়বে তাড়াতাড়ি।
ঘাটের কাছে রয়েছে বন দপ্তরের একটা অফিস। তার মধ্যে কয়েকজন স্টাফও আছে। সেদিকে তাকিয়ে বিনয়বাবু বললেন, ‘দেখেছ মনিকা, ছুটির দিনেও এদের কাজ করতে হয়।’
পাশ থেকে রাজু বলল, ‘স্যার, আমরাও তো ইলেকশনের সময় রাত দিন এক করে খেটেছিলাম।’ বিনয়বাবু মুচকি হাসলেন।
রাঘববাবুর বাঁশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একেবারে খেলার রেফারির মত ঘন ঘন বাজছে। সবার পিছনে তিনি। যেন সবাইকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে আসছেন। লঞ্চের কাছে গিয়ে দেখা গেল লঞ্চের ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ যে চিন্তাটা তার মাথায় ছিল সেটার অনেকটা কেটে গেছে। মুখে একটা মৃদু হাসি। মোটামুটি পনের মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ ছেড়ে দিল। সবাই আবার হইহই করে উঠল।
বনমালী বেগুনি আর মুড়ি রেডি করে রেখেছিল। সবাই সেদিকে মন দিল।
সূর্য সমুদ্রের গা-ঘেঁষে ডুবে যাচ্ছে। কী সুন্দর লাগছে পশ্চিম দিকটা। আনারুল মোবাইলটাকে অনেক কায়দা কানুন করে এই দৃশ্যটাকে পিছনে রেখে সেলফি নেওয়ার চেষ্টা করছিল। লাস্টে ওদের ব্যাপার-স্যাপার দেখে রাজুই ফোটো তুলে দিল।
বিট্টুর এক বায়না, ‘বাবা, বাঘ তো দেখতেই পেলাম না!’ মনিকা ছেলের দুঃখকে কিছুটা লাঘব করার জন্য বলছেন, ‘কেন, তুমি কতগুলো হরিণ দেখলে বলো, একটা শুকর দেখলে, এসব কিন্তু দিদুনকে গিয়ে বলতে হবে।’ এই সব কথায় বিট্টুর মনটা খুব একটা শান্ত হল বলে মনে হয় না। ড্রাইভার ভাই চিৎকার করে বলল, ‘এর পর যেখানে যাব, বাঘ সেখানে হানড্রেড পার্সেন্ট দেখতে পাবে।’ তারপর মৃদু হেসে যোগ করল, ‘তবে খাঁচার বাঘ।’ রাঘববাবু বললেন, ‘এরপর আমরা ঝড়খালির দিকে যাব। ওখানে নাইট স্টে করব।’
বিনয়বাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পাশ থেকে আরও কয়েকটা লঞ্চ বেরিয়ে গেল। সকলের যেন খুব তাড়া। প্রতিটা লঞ্চের মাথায় পতাকা উড়ছে। কোনটার ভারতীয় তেরঙ্গা, কোনটার আবার বাংলাদেশের। বর্ডার এরিয়া। কিন্তু কোন ভৌগোলিক বেড়াজাল নেই। যা কিছু নিয়মকানুন সব সরকারি খাতায়-কলমে।
বেগুনি দিয়ে মুড়ি খাওয়ার পর চায়ে চুমুক দিচ্ছিল সবাই। হঠাৎ বনমালীর চিৎকার। ‘দিগন্ত কই, দিগন্ত?’
তাই তো ছেলেটাকে তো দেখা যাচ্ছে না। রাজু দৌড়ে লঞ্চের নীচের তলায় ছুটে গেল। না, সেখানে নেই। তাহলে? গেল কোথায় ছেলেটা?
বিনয়বাবু বললেন, ‘ওকে কিন্তু দেখেছি, ওয়াচ টাওয়ারে। তার পর কি লঞ্চে ওঠেনি?’
বনমালী বলল, ‘আমরা তো কেউ যাইনি। ও কখন নেমেছিল?’
রাঘববাবু ড্রাইভারের দিকে তাকালেন। ‘ও তাহলে সজনেখালিতেই রয়ে গেছে। লঞ্চ ঘোরাও।’
ড্রাইভার কোনও মতে রাজি হতে চাইছে না। এই সন্ধেবেলায় যাওয়া নিষিদ্ধ। ওকেই জবাবদিহি করতে হবে।
বিনয়বাবু ঊঠে গিয়ে ড্রাইভারকে অনুরোধ করলেন। রাজু বলল, ‘স্যার যখন বলছেন, তোমার কোনও সমস্যা হবে না।’ অনেক অনুরোধের পর প্রায় গোমড়ামুখ হয়ে ড্রাইভার লঞ্চ ঘোরাল। তবে এক্সট্রা টাকাও ডিম্যান্ড করে রাখল। ঠেলায় পড়ে সব কিছু মেনে নিলেন রাঘববাবু।
অনেকটা পথ আরও যেতে হবে। সকলের মন হঠাৎ করে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল। কেউ আর কোনও কথা বলছে না। শুধু বনমালী রাগে গজগজ করছে। ‘ওর মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটার মাথাটা গেছে।’ রাঘববাবু জিজ্ঞেস করলে, ‘কী করে মারা গেছে?’
‘এই সজনেখালিতে ওরা থাকত। জঙ্গলের মধু সংগ্রহ করত। বাপটা তো আগেই গেছে। কয়েকমাস আগে ওর মা জঙ্গলে গিয়েছিল। তারপর লা-পাতা। বনদপ্তর নানা অনুসন্ধান করে বুঝল ওর মা বাঘের পেটেই গেছে। তবে বেচারা মায়ের লাশটাও পর্যন্ত দেখতে পায়নি।’
সজনেখালির ঘাটে যখন লঞ্চ পৌঁছাল, তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাতটা ছুঁইছুঁই। ঘাটের ওপরে একটা জটলা। কয়েকজন লোক একটা ছেলের দু’হাত ধরে রেখেছে। দিগন্তকে দেখে সকলে গভীর শ্বাস নিল। কিন্তু লঞ্চের ড্রাইভারের মুখচোখ পালটে গেল। ঘাটের ওপরে এই দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি রেঞ্জার সাহেব। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে বেজায় খেপে গেছেন। প্রথমেই ড্রাইভারকে লাইসেন্স নিয়ে নামতে বললেন। ড্রাইভার গুটিগুটি পায়ে নেমে এল।
সকলেই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সেদিকে। রাজু বিনয়বাবুকে বলল, ‘স্যার, আপনি একটু যান। নাহলে বোধহয় ড্রাইভারের লাইসেন্স কেড়ে নেবে।’
বিনয়বাবু নামলেন। ড্রাইভারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। রেঞ্জার সাহেবের বক্তব্য, লঞ্চে সবাই উঠেছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব ড্রাইভারের। সে তার দায়িত্ব পালন করেনি।
বিনয়বাবু নিজের পরিচয় দিয়ে কিছুটা অনুরোধ করলেন। অনেক কথাটথা শোনানোর পর রেঞ্জার সাহেবের মন ভিজল।
লঞ্চ অনেকটা দূর চলে এসেছে। গুমোট ভাবটা এখনো কাটেনি। বনমালী প্রথমে যে রাগটা দেখাচ্ছিল, সেটা এখন স্থিমিত। কিন্তু সকলেই চুপচাপ। ড্রাইভারও কোনও কথা বলছে না।
দিগন্ত এক মনে ময়দা মাখাচ্ছে। মাথাটা নীচু। একবারও কারর দিকে তাকাচ্ছে না সে। রাঘববাবু পাশে দাঁড়ালেন। আদর করে মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই লঞ্চে উঠলি না কেন তখন? আমার হুইশিল শুনতে পাসনি?’
দিগন্ত মাথা তুলে তাকাল একবার। তারপর আবার কাজে মন দিল।
আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কিরে শুনতে পাসনি?’
মাথা নাড়ল সে।
‘কোথায় গিয়েছিলি?’
‘জঙ্গলের ভিতর’
সকলে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
বনমালী বলল, ‘জঙ্গলে? কেন?’
—‘মা-কে খুঁজতে।’