সুতপা ব্যানার্জী (রায়)
মৌবনি ট্রেনের জানলা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। যদিও বাড়ির পরিস্থিতি এই হাঁ করে দৃশ্য দেখার উপযোগী নয় তবুও সাত বছরের শৈশবের স্বাভাবিক ঔৎসুক্য তো থাকবেই। ওর বাবার কী যেন একটা রোগ হয়েছে। গত পাঁচ মাস ধরে বাবা ঠিকমতো হাঁটতে চলতেও পারছে না। মায়ের আদুরে দৃষ্টিটা কেমন করুণ দৃষ্টিতে বদলে গ্যাছে। মৌবনি এখন খাওয়া-পরা কোন কিছু নিয়েই বায়না করে না। স্কুলের হোম ওয়ার্ক নিজের মতোই করে নেয়। প্রথম প্রথম পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে বায়না করত। ক্রমশ মায়ের খিটখিটে আচরণে ও পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝেছে। বাবার অফিস যাওয়াও বন্ধ। কী একটা যেন মাইনে না পাওয়া ছুটিতে আছে। তাই মৌবনির এবারে একটাও পুজোর জামা হয়নি। তা না হোক গে, ঠাকুর যেন ওর বাবাকে ভাল করে দেয়। ডাক্তার- কাকুরা যেন বাবার রোগ ঠিকমতো ধরতে পারে,তাহলেই ও খুশি। পুরোনো জামা পরে ওর আনন্দ কিছু কম পড়বে না। মৌবনির বাবা দীপায়নের শিথিল হাত-পা ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টিতেও একরাশ শূন্যতা। বাবাকে এরকম অবস্থায় দেখতে মৌবনি অভ্যস্ত নয়। তবু মায়ের কথা চিন্তা করে ওর ভেতরে কী হচ্ছে মাকে সেটা বুঝতে দেয় না।
নদীর চরা দ্রুত গতিতে ওর দৃষ্টিপথ থেকে সরে গেল। কাশের ওরকম দোল কি ওদের ঘরেও লাগবে? আবার বাবার সঙ্গে দুলে দুলে ছড়া বলবে? আড়াল আবডাল থেকে ও শুনেছে বাবার মাথার ভেতরে একটা মাংসপিণ্ড ঘাপটি মেরে বসে আছে। শিবুদের বাড়ির দারোয়ানের মত ও বাবার মাথার ভেতরে বাতাস, খাবার কিচ্ছু ঢুকতে দিচ্ছে না। উল্টে যেসব দড়িদড়া দিয়ে আমরা চলি, বলি সেগুলোকে নিজেদের কাজ করতে দিচ্ছে না। ডাক্তারদের পরামর্শেই ওর মা ব্যাঙ্গালোরে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওর বাবা মৌবনির মায়ের কাঁধে এমন করে ঢুলছে যেন মৌবনির থেকে বাবা অনেক ছোট হয়ে গেছে। ও আর মায়ের হাতে খাওয়ার সুযোগ পায় না। বাবাই তো এখন ছোটদের মত হয়ে গেছে তাই বাবাকেই তো খাইয়ে দিতে হয়।
পাড়ার প্রসূন কাকু, মনা কাকুরা বলে— ‘তোর বাবা তো মরে বেঁচে আছে।’
কেউ কেউ মাকে সহানুভূতি দেখিয়ে বলে— ‘আহা কি-ই বা এমন বয়স।’
মৌবনির এসব কথা শুনতে একেবারেই ভাল লাগে না। ওর আর মায়ের যদি এমনটা হতো বাবা তো এমনই করত। পাড়ার কুকুর বাচ্চাগুলো পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজলে বাবা ওদের বাড়ি নিয়ে আসত। মৌবনি কামরার জানলায় চোখ রাখতেই দেখল একটা রেল স্টেশন পার হচ্ছে। ওরই মত বাচ্চারা স্কুলের পোশাক পরে স্কুলে যাচ্ছে। ও নিজের স্কুলে লম্বা ছুটির দরখাস্ত দিয়ে এসেছে। বাবা সুস্থ হলে একেবারে বাবার হাত ধরেই স্কুলে যাবে। নিমেষে দৃশ্যপট পাল্টে চলে এসেছে একটা আস্ত নদী। মৌবনির পরিচয় শুধুমাত্র দামোদরের সঙ্গে। বর্ষায় সামান্য দুষ্টুমি করা ছাড়া যে নদী সারাবছর শান্ত থাকে। চরের বুক পেতে দেয় শীতের পিকনিকে। বাবা সুস্থ থাকতে ওরাও যেতো ওই চরে। ছোট ছোট ঝিনুক কুড়িয়ে ফ্রকে জড়ো করে মায়ের বকুনি খেতো। আচ্ছা, ওইসব শহরে কি লোকে শুধু অসুখ করলেই যায়? নাকি ওদের মত প্যান্ডেল করে মা দুগ্গার পুজোও হয়? প্রশ্নটা মাকে করতে গিয়েও বুঝল সময়টা সঠিক নয়। বিকেলে একটা বড় হ্রদের পাশ দিয়ে ট্রেনটা চলল। এটা নাকি চিল্কা, ওদের পুরীতে আসার পরিকল্পনা ছিল। বাবা সুস্থ থাকলে চিল্কাতেও আসা হতো। আপাতত পড়ন্ত বিকেলের আলোয় চিল্কাকে দৃষ্টি দিয়ে গিলে চলেছে মৌবনি। সারাদিন একভাবে বসে থেকে ট্রেনের দুলুনিতে এবার ঘুম পাচ্ছে ওর। আপার বার্থে তিড়িংবিড়িং করে উঠে ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখল। চারদিকে ধুনোর গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ। মা দুর্গা দশ হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মৌবনি আর ওর মা-বাবা একসঙ্গে অঞ্জলি দিচ্ছে। অঞ্জলির পর যেই চন্নামেত্ত খেতে যাবে অমনই মায়ের ডাক— ‘বনি, নীচে আয়, দেখে যা, এখানেও পুজো হচ্ছে। ওই দ্যাখ, বাজনা বাজিয়ে ঠাকুর নিয়ে আসছে।’ ঘুমের ঘোর ভাঙতেই চট করে নেমে জানলা দিয়ে সেই পার হওয়া দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল মৌবনি। আরও অবাক হল দেখে যে, বাবার উৎসুক চোখে সেই আগের দীপ্তি। উল্টো সিটে শুয়ে থাকা অসুস্থ ছেলেটাও খুশিতে আকার ইঙ্গিতে কী বলে চলেছে। মনে মনে যে আনন্দ খুঁজছিল মৌবনি তা হঠাৎ করেই যেন ফিরে পেল।