পূর্ব প্রকাশিতর পর
বাঙ্গালার নগরের মধ্যে লক্ষ্মণাবতী, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি দুই-একটির নাম মাত্র করা যায়। বাঙ্গালা দেশ ভারতের জীবনের স্রোতের এক পাশে, একটু যেন বিচ্ছিন্ন ভাবেই বরাবর ছিল। শিল্প-নগরী রূপে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে পশ্চিম-বঙ্গে বিষ্ণুপুর বিশেষ সমৃদ্ধ হইয়া উঠে। এই সময়ের বিষ্ণুপুরের হঠাৎ বড়ো হইয়া উঠার দুইটি কারণ ছিল— (১) উড়িষ্যা এবং দক্ষিণ-ভারতের পূর্ব উপকূলের সহিত উত্তর ভারতের যোগ-বিধায়ক পথের উপরেই বিষ্ণুপুর অবস্থিত ছিল; সেইজন্য উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে তীর্থ-যাত্রা ও অন্য উদ্দেশ্য লইয়া যাহারা যাতায়াত করি, তাহাদের মারফত বাহিরের জগতের সহিত বিষ্ণুপুরের সংযোগ সহজ হইয়াছিল; (২) বিষ্ণুপুরের সঙ্গে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বাঙ্গালা দেশের হৃদয়-স্থানীয় নবদ্বীপ অঞ্চলের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। ষোড়শ-শতকের শেষভাগে এবং সমগ্র সপ্তদশ শতক ধরিয়া, কতকগুলি বাঙ্গালী পণ্ডিত ও কর্মী বাঙ্গালা দেশের গ্রাম্য সংকীর্ণতা ছাড়াইয়া উঠিতে পারিয়াছিলেন, বাংলার বাহিরেও একটি বিরাট্ কর্মক্ষেত্র গড়িয়া তুলিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
ইহার কারণ যেমন একদিকে ছিল শ্রীচৈতন্যদেবের শিক্ষা, অন্য দিকে ছিল— বাঙ্গালা দেশের স্বাধীন মুসলমান নরপতির হাত হইতে মুক্ত হইয়া, মোগল সম্রাটের অধীন হওয়া। স্বাধীন মুসলমান রাজাদের অধীনে থাকিয়া বাঙ্গালা দেশ ভারতবর্ষের এক কোণে পড়িয়া ছিল, এবং রুদ্ধবার জলাশয়ের মতো অবস্থায় ছিল; বাহিরের জগতের সঙ্গে তাহার তেমন কোনও যোগ ছিল না। মোগল সাম্রাজ্যের সহিত যুক্ত হইয়া, বাঙ্গালার পক্ষে আংশিক-ভাবে সমগ্র ভারতের প্রাণের স্পন্দন পাওয়া সম্ভবপর হইল। দিল্লী-আগরার কেন্দ্রীভূত শাসন বাঙ্গালার পক্ষে হিতকর হইয়াছিল বলিয়াই মনে হয়। বাঙ্গালীর প্রতিভা বাঙ্গালার বাহিরে আদর পাইল— বাঙ্গালার বিদ্যাধর পণ্ডিত জয়পুর নগর স্থাপন কালে সাহায্য করিলেন। ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দ), বাঙ্গালার পণ্ডিত ও গোস্বামীরা উত্তর-ভারতের ধর্ম-জীবনে অংশগ্রহণ করিলেন, বাঙ্গালার মধুসূদন সরস্বতী শঙ্করাচার্য্যের মতকে উত্তর-ভারতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিলেন, দিল্লী-আগরা জয়পুর-চিতোর হইতে পারস্য ও তুরস্ক পর্য্যন্ত সর্বত্র রাজদরবারে বাঙ্গালার ঢাকাই মলমলের চাহিদা বাড়িয়া গেল, বাঙ্গালার বাঁশে তৈয়ারি ‘কুঁড়ে’ ঘরের বাঁকা ধাঁচা, ‘রেওটি’ নামে রাজপুত-মোগল বাস্তু-শিল্পের মধ্যে স্থান পাইল। মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, হিন্দু যুগের অবসানের পরে, বাঙ্গালী গ্রামীণ সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, হিন্দু-যুগের অবসানের পরে, বাঙ্গালী গ্রামীণ সভ্যতার গণ্ডি প্রথম কাটাইয়া, নিখিল-ভারতীয় সভ্যতার অংশ গ্রহণের একটা বড়ো সুযোগ পাইল। সপ্তদশ শতকে উত্তর-ভারতের লোক-ভাষা (‘হিন্দী’) হইতে বাঙ্গালাতে দুইখানি বই অনূদিত হইল— নাভাজী দাসের ‘ভক্তমাল’, এবং মালিক মুহম্মদ জয়সীর ‘পদুমাবৎ’।
দিল্লী-আগরা এবং উত্তর পশ্চিম ভারতের সঙ্গে যে-যোগ নতুন করিয়া মোগল-বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হইল, সে-যোগ আর বিলুপ্ত হয় নাই। বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ইতিহাসে এই যোগকে একটা বড় স্থান দিতে হয়।
যদিও বাঙ্গালী জাতির অর্ধেকের উপর এখন মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে, ইহা লক্ষণীয় যে অতি অল্প কয়েক বৎসর পূর্ব পর্য্যন্ত মুসলমান সংস্কৃতি (অর্থাৎ আরবী, ফারসী ও উত্তর-ভারতীয় মুসলমান মনোভাব বা বাস্তব সভ্যতা, রীতি-নীতি এবং চিন্তা-প্রণালী) বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনেও তেমন কার্যকর হয় নাই। সুফী মতের ইসলামের সহিত বাঙ্গালী (অর্থাৎ বাঙ্গালী হিন্দু) মনোভাবের একটা আপস হইয়াছিল, সে-কথা পূর্বে বলিয়াছি। সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমান (কতকগুলি বিশেষ প্রান্তে, বিশেষ কতকগুলি গোষ্ঠী বা পরিবার ব্যতীত), বিশিষ্ট মুসলমান সংস্কৃতি সম্বন্ধে উদাসীন ছিল।
(ক্রমশ)