• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

রূপে রোমাঞ্চে অনন্য আনিনি

এ হল পূর্ব অরুণাচলের এক অফবিট ডেস্টিনেশন। দিবাং উপত্যকার এক অপরূপ ছোট্ট শহর আনিনি। ছবির মতোই সুন্দর। একলা ভ্রমণে বেরিয়ে এমনই এক অনাবিষ্কৃত ডেস্টিনেশন খুঁজে আনলেন  সুব্রত সরকার।

সকালের প্রথম টাটা সুমোটা ছুটে চলেছে রোয়িং থেকে আনিনি। পূর্ব অরুণাচলের অচেনা এবং অফবিট ডেস্টিনেশন। দিবাং উপত্যকার এক অপরূপ ছোট্ট শহর এই আনিনি। আমি একদিন আগে ড্রাইভারের পাশের সিটটা এক হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বুক করে রেখেছিলাম। সিট নাম্বার টু। সবচেয়ে মহার্ঘ্য সিট নাম্বার। তাই মনের আনন্দে পথের শোভা দেখতে দেখতে চলেছি।

একলা ভ্রমণে বেরিয়ে আমি সব সময়ই চেষ্টা করি সার্ভিস জিপ বা সুমো গাড়িতে ট্রাভেল করতে। এই ভ্রমণে যাতে স্থানীয় মানুষজনদের সাথে একটু জানপহচানের সুযোগ তৈরি হয়। বোবা হয়ে ভ্রমণের মজা আমি একদম পছন্দ করি না। আমার ভ্রমণ মানে শুধু নতুন জায়গায় যাওয়া নয়, নতুন নতুন মানুষের কাছেও যাওয়া।

রোয়িং-এ দু’রাত কাটিয়ে আনিনি চলেছি। দুটো রাত আনিনিতেও থাকব। রোয়িং থেকে আনিনি এক দীর্ঘ দুর্গম পাহাড়ি পথ। পথের হিসেবে প্রায় ২২০ কিমি। আট ঘন্টার টানা সফর। পথে জলখাবার ও লাঞ্চ বিরতি আছে।

লোয়ার দিবাং ভ্যালির রোয়িং থেকে একটু একটু করে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে টাটা সুমো। গাড়ির ড্রাইভার এক নবীন যুবক। অসমের ছেলে। নাম দীপঙ্কর বোরা। বেশ দক্ষ হাতে গাড়িকে ছোটাচ্ছে। বিহু গান বাজছে গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে। ফলে এই জার্নি আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে।

রোয়িং থেকে প্রায় ৫৫ কিমি পথ পেরিয়ে এসে, গাড়ি প্রথমবার একটু থামল পূর্ব অরুণাচলের বিখ্যাত এক পয়েন্ট মায়োদিয়া পাসে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২৬৫৫ মিটার( ৮৭১১ ফুট)। ডিসেম্বর মাসে নাকি এখানে বরফ পড়ে। তখন বহু পর্যটক আসে সেই বরফাবৃত মায়োদিয়া পাসকে দেখতে। এই অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে অবশ্য আমি মায়োদিয়া পাস-কে দেখে তেমন কোনও রোমাঞ্চ অনুভব করলাম না।

এরপর পথে পড়ল ৬৫ মাইল। জলখাবারের বিরতি দেওয়া হল সেখানে। ছোট্ট পাহাড়ি একটা জায়গা। গুটিকয় ঘরবাড়ি ও ছোট ছোট হোটেল। দেখলাম এখানে বেশির ভাগ লোকই নেপালি এবং বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের লেবার।

জলখাবারের বিরতি শেষ করেই টাটা সুমো আবার ছুটতে শুরু করল। পথ সব জায়গায় ভালো নয়। পথের দু’ধারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। এপথের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ দিবাং ভ্যালি ও দিবাং নদী।  সারা পথ জুড়ে দিবাং নদী পাশে পাশে চলেছে। সব সময় চোখে ধরা দেয় না। কিন্তু সে আছে। আর কোথাও কোথাও তো দিবাং নদীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি। আনন্দ উত্তেজনায় ছটফট করেছি। একের পর এক ছবি তুলেছি।

প্যাসেঞ্জার সুমো। সওয়ারি গাড়ি। আমিও দশজনের একজন। তবু দু’একবার  আমার অনুরোধে দীপঙ্কর গাড়ি থামিয়ে আমাকে ছবি তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। সহযাত্রীরা এতটুকু বিরক্ত হয়নি। বরং তারা যেন নতুন করে আনন্দ পেয়েছে তাদেরই চিরপরিচিত একটা উপত্যকার নদীকে দেখে, পরদেশি এক মুসাফির এমন পাগলের মতো ছবি তুলে আনন্দ পাচ্ছে!

রোয়িং থেকে আট ঘণ্টার সফর আনিনি। পথে পড়ল অনেক জনপদ। মায়োদিয়া পাস পেরিয়ে ৬৫ মাইল, হুনলি, রনলি, আরজু, এটানিল, রিয়ালি। আনিনিতে যখন এসে পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন আড়াইটে। সাড়ে ছ’টায় ছেড়েছিল টাটা সুমো। পাক্কা আট ঘণ্টাই লাগল।
আনিনিতে নেমে একটু খোঁজ খবর করে নিজের পছন্দমতো সুন্দর একটা হোটেল পেয়ে গেলাম। মিশমি পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে এই হোটেলটি, প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল এবং সাধ্যের মধ্যে একটা ছোট্ট কাঠের ঘরও পেয়ে গেলাম।

বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই আকাশের আলো কমে এল। অরুণাচলে ভোরগুলো হয় যেন ভোরেরও আগে, আর দিন ফুরিয়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি। এখানে এসে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে বসে পড়লাম উন্মুক্ত লনে। চোখের সামনে ছড়ানো ও সাজানো আনিনি। মিশমি পাহাড়ের পাদদেশে জনপদ গড়ে উঠেছে। দূরে একটা খেলার মাঠ স্টেডিয়াম-সহ। তার পাশে হেলিপ্যাড। একটা হেলিকপ্টারও দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের বুকে খোদাই করে সবুজ ঘাসে সাদা রং দিয়ে লেখা – ANINI বহু দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। IPBT র ক্যাম্পও চোখে পড়ল। শান্ত, স্নিগ্ধ আনিনি মনকে সহজেই ছু্ঁয়ে যায়। বিকেলের শেষ আলোয় আনিনির এই সৌন্দর্যকে বহুক্ষণ উপভোগ করলাম।

আনিনির উচ্চতা ১৯৬৮ মিটার (৬৪৫৭ ফুট)। বেশ আরামদায়ক একটা ঠান্ডা উপভোগ করছি। চারপাশের পাহাড় নিস্তব্ধ। আকাশে আলো ছড়িয়ে কোজাগরী জোছনা হাসছে। শান্ত সুন্দর নির্জনতায় নিজেকে নিয়ে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম।

একসময় হঠাৎ দেখি গমগম করে কতগুলো বাইক ঢুকে এল লনে। শান্ত চরাচর কোলাহলে মুখর হয়ে গেল। একটু পরেই জানলাম এরা সবাই বাইকার। অ্যাডভেঞ্চার ট্রিপে বেরিয়েছে। ওরা আসামের তিনসুকিয়া থেকে আসছে। ছটফটে যুবকের দল। ওদের দেখে বেশ লাগল।
আলাপও হয়ে গেল। পাহাড়ে রাত্রি নামে ঘড়ির কাঁটা মেনে নয়। তাই ন’টা বাজতেই ডিনার সারলাম।

আনিনির দ্বিতীয় দিনের সকালে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম বাজারের সুমো স্ট্যান্ডে। আজ আমার এখানকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ মিশমি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি ভ্রমণ। এছাড়া সেখানকার দ্রি নদী, চিগু ক্যাম্প গ্রাউন্ড ও উচ্ছল সুন্দরী এক ঝরনা, মাউ আন্দো জলপ্রপাত দেখা।
এপথে যেতে হলে নিজেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে হবে। কোনও বাস বা শেয়ার গাড়ি যায় না। আনিনি থেকে মিশমি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি কম বেশি চল্লিশ কিমি পাহাড়ি পথ। চিগু ক্যাম্প ও ঝরনা আরও দশ কিমি। সব মিলিয়ে  যাওয়া আসা নিয়ে পড়বে একশো কিমি। ভাড়া নিল দু’হাজার টাকা। এই গাড়ির মালিক একজন নেপালি।  বহু বছর ধরে সপরিবারে রয়েছেন আনিনিতে। ড্রাইভার পেলাম অসমের এক আদিবাসী যুবককে। নাম রেগন মুড়া।

আনিনি শহর ছেড়ে গাড়ি একটু একটু করে এগিয়ে চলল। এপথের শোভা ও পাহাড়ের সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে যাচ্ছি। রেগনের কাছে টুকিটাকি গল্প শুনছি। পথে অনেকবার এখানকার প্রিয় পোষ্য মিথুন দেখলাম। নিজের মনে চরে বেড়াচ্ছে। ঘাস খাচ্ছে। হরেক পাখির কিচিরমিচিরও শোনা গেল চারপাশে। খুব ছোট ছোট পাখি দেখলাম সর্বত্র। কিন্তু নাম জানতে পারলাম না। পাখিগুলো খুব ছটফটে আর দুরন্ত। কিছুতেই ক্যামেরায় ধরতে পারলাম না তাদের।

অরুণাচলের এই দিবাং উপত্যকার মিশমি পাহাড় এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। উন্নয়নের যাঁতাকলে যাচ্ছেতাই ভাবে ধ্বংস হয়নি। পাহাড়ের সবুজ ও প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ রূপ দেখার পরিপূর্ণ আনন্দ পাওয়া যায় এপথে এসে।

ছোট ছোট কয়েকটা গ্রাম চোখে পড়ল। গুটিকয়েক বাড়ি ও খেতি-বাগান নিয়ে ওদের জীবনযাপন। এই সব সহজ জীবনের ছবি দেখতে বেশ লাগে। কত সাধারণভাবেও সুন্দর বেঁচে থাকা যায় এমন প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসতে পারলে।

দ্রি রিভার মিশমি পাহাড়ের ঢাল থেকে গড়িয়ে এসে সমতলে কুল কুল করে বয়ে চলেছে আপন বেগে। এমন এক সমতলের সুন্দর পটভূমিতে দেখলাম ছড়ানো রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্পের সুন্দর আয়োজন। গাড়ি থামিয়ে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে।  দ্রি নদীর একদম কাছে এসে পড়েছি। পা ডুবিয়ে নেমেও পড়লাম দ্রির জলে। বড় সুন্দর এখানকার দৃশ্য।

এবার পথে পড়ল একটি চেক পোস্ট। সীমান্ত রক্ষী বাহিনির ITBPF। জায়গাটার নাম – DAMBEUN। পাশেই দেখলাম একটা হেলিপ্যাড রয়েছে। এখানে নাম লিখে, পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকে পড়লাম সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর জওয়ান শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, ‘আরাম সে ঘুমিয়ে।’ অসাধারণ সুন্দর রাস্তা। এই পথ গিয়ে শেষ হয়েছে একদম চায়না বর্ডারে।

চিগু ক্যাম্পে পৌঁছনোর আগে দু’পাশের পাহাড়-জঙ্গলের শরীর জুড়ে কত অসংখ্য ঝোরা ও ঝরনা যে দেখলাম! মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। প্রকৃতির এই অঢেল রূপ ও সৌন্দর্য চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার আনন্দ, মনকে কখনও কখনও অবশ করে দেয়।

চিগু হল আনিনির অহংকার। এখানে পর্যটকরা সারা বছর আসে। চিগুতে উৎসব হয় প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে। উন্মুক্ত গ্রাউন্ডে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে অনেকগুলো কটেজ। একটা-দুটো রাত এমন নির্জনে এই সুন্দরের সমারোহে যাপন করতে পারা এক পরম আনন্দ।
চিগু থেকে কয়েক কিমি এগিয়েই পেয়ে গেলাম সেই বিখ্যাত ঝরনা মাউ আন্দো।

যেতে হবে জঙ্গলের পথে পায়ে হেঁটে কিছুটা। রেগন আমাকে নিয়ে গেল সেই আড়াল ও অন্ধকারকে ভেদ করে একদম ঝরনার কাছে। প্রায় কয়েকশো ফুট উঁচু থেকে সেই জলরাশি দুরন্ত বেগে ধেয়ে এসে পাথরে আছড়ে পড়ছে প্রবল বেগে। তার সে কি গর্জন ও উল্লাস! সমস্ত চরাচরটা সে দখল করে নিয়ে বিরাজ করছে। বাক্যহারা আনন্দে শুধুই চেয়ে থাকলাম উচ্ছল সুন্দর জলরাশির দিকে। ছেড়ে চলে আসার সময় বেশ মন কেমন করছিল।

কিন্তু এবার ফিরে যাওয়ার পালা। মিশমি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির প্রধান তিনটে আকর্ষনীয় জিনিসই দেখলাম। বাড়তি পাওনা মিশমি পাহাড় ও দিবাং উপত্যকার রূপ ও সৌন্দর্য। রেগন গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। দু’চোখ  জুড়িয়ে আছে। একসময় গাড়ি এসে থামল চেক পোস্টে। সীমান্তের জওয়ান জানতে চাইলেন, ‘ক্যায়সা লাগা?’ আমি অল্প হেসে বললাম, ‘বহুত বড়িয়া। অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। আপনারা কত ভাগ্যবান যে এমন সুন্দর একটা জায়গায় রয়েছেন।’ জওয়ান হাসিমুখে বিদায় জানালেন।

‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা…’ আমি মনে মনে একবার জায়গাটিকে স্যালুট  জানালাম। রেগন এগিয়ে নিয়ে চলল গাড়ি। আমি যেন আনিনির কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম আজীবন।