পূর্ব প্রকাশিতর পর
কিন্তু মুসলমান প্রচারক আসিলেন; তাঁহার পিছনে ছিল মুসলমান রাজার প্রচণ্ড শক্তি; মুসলমানের ধর্ম সহজে-বোধ্য, তাহাতে হিন্দু অর্থাৎ বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সূক্ষ্ণ intellectualism বা আধি-মানসিকতা নাই বলিয়াই, তাহা সাধারণ মানবের পক্ষে আপাতগ্রহণীয় ছিল। অবস্থা দেখিয়া উচ্চ-বর্ণের হিন্দুও সজাগ হইলেন। তখন বৌদ্ধ ধর্মের অবসানের যুগ, বৌদ্ধ ধর্ম তখন তান্ত্রিকতা ও সহজিআ মতের পঙ্কের মধ্যে নিমজ্জমান। তুর্কীদের আগমন ও মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা, এবং ভারতে (বিশেষ করিয়া বঙ্গে) বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ-লাভ— এই দুইটি কাকতালীয় ন্যায়ে হইয়াছিল। জীবনী শক্তিতে হীন বৌদ্ধ ধর্ম, নবশক্তিতে জাগ্রৎ পুরাণ ও তন্ত্র-জীবী ব্রাহ্মণ্য ধমে4র নিকট পরাভূত হইতেছিল; ব্রাহ্মণ ও তাঁহার অনুগামীর দল নব উৎসাহে তখন বেদ উপনিষৎ পুরাণ ও তন্ত্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট নবহিন্দুধর্মকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করিতেছিলেন। সমাজে তখন ব্রাহ্মণ-ই প্রধানতম চিন্তা নেতা; বৈদ্য এবং কায়স্থও এ-বিষয়ে ব্রাহ্মণের পার্শ্বেই দাঁড়াইয়াছিল। বাঙ্গালার ক্ষাত্র শক্তি তখন কায়স্থ এবং অন্য কতকগুলি জাতির মধ্যে সজীব অবস্থায় বিদ্যমান; এবং বৈদ্য এখনকার মতো তখনও বিদ্যাবৃত্ত।
ব্রাহ্মণ বিদ্যাসর্বস্ব, এবং বিদ্যার বলে ও বুদ্ধির বলে রাজসেবা কার্য্যেও নিযুক্ত। দেশের মধ্যে বাঙ্গালা প্রভৃতি লোক-ভাষা তখন সাহিত্যের কার্য্যেও নিযুক্ত। দেশের মধ্যে বাঙ্গালা প্রভৃতি লোক-ভাষা তখন সাহিত্যের উপযোগী হইয়া উঠিতেছে। অবস্থা বুঝিয়া, উচ্চ-বর্ণের হিন্দু, সাধারণের জন্য শাস্ত্রকে উন্মুক্ত করিয়া দিতে সচেষ্ট হইলেন। তুর্কী-বিজয়ের পরে, কেরামত জহির করেন এমন পীর ও আউলিয়াদের দ্বারা মুসলমান ধর্মের প্রচারের ফলে, উত্তর ভারতের সর্বত্র লোক-ভাষায় হিন্দুর ধর্ম-গ্রন্থ প্রচারের একটা সাড়া পড়িয়া গেল। হিন্দী-মারাঠী বাঙ্গালা প্রভৃতি ভাষাতে নিবন্ধ আমাদের সাহিত্যের মুখ্য প্রেণা এইখানেই— রাজশক্তিতে শক্তি-শালী, সহজ-বোধ্যতায় প্রবল মুসলমান ধর্মের সমক্ষে, জনসাধারণের নিকটে হিন্দু সাহিত্য, ধর্ম-শাস্ত্র ও ইতিহাস, তৎসঙ্গে গভীর অধ্যাত্ম-চর্চার অনুভূতি, এবং প্রাচীন উপাখ্যানবলীর অন্তর্নিহিত রোমান্স ও উচ্চ আদর্শাবলী—এগুলিকে উন্মুক্ত করিয়া দিবার ইচ্ছাতেই;—কৌতূহলী বিদেশী মুসলমান রাজাদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য মধ্য-যুগের ভারতের ভাষা সাহিতেরে সৃষ্টি বা আরম্ভ হয় নাই।
তুর্কী আক্রমণ ও বিজয়ের প্রথম যুগের পরে বাঙ্গালী যখন আত্মরক্ষায় তৎপর হইল, তখন কেবল সাহিত্য-রচনাতেই তাহার দৃষ্টি বা চেষ্টা নিবদ্ধ রহিল না। বাহিরের ধর্ম ও রাজশক্তির হাত হইতে দেশকে আবার স্বাধীন করিয়া দেখিবার স্বপ্নও তাহাকে বিচলিত করিল। খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকের প্রথম পাদে ‘‘চণ্ডীচরণ-পরায়ণ’’ মহারাজ শ্রীদনুজমর্দন দেব দেখা দিলেন। ইনি সমগ্র বাঙ্গালার স্বাধীন হিন্দু রাজা হন, এবং যে-কার্য্য সারা উত্তর ভারতের কোনও হিন্দু রাজা তুর্কীবিজয়ের পরে করিতে সাহসী হন নাই, সেই কার্য্য ইনি-ই করিয়াছিলেন— নিজ নামে দেশ-ভাষায় মুদ্রা প্রচলন করিয়াছিলেন। দনুজমর্দন দেবকে অনেকে মুসলমান ইতিহাসে বর্ণিত রাজা ‘‘কনস্’ (কাঁশ’ বা কংশ)-এর সহিত অভিন্ন বলিয়া মনে করেন। এই রাজা সংখ-ই বাঙ্গালা রামায়ণের রচয়িতা ব্রাহ্মণ কবি কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, এইরূপ অনুমান হয়। সমগ্র বঙ্গের স্বাধীন হিন্দু রাজা দনুজমর্দন দেব কংশ, হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থ রামায়ণ ভাষায় প্রচারে উদ্যোগী; কর্ম-চেষ্টা ও জাতীয় সহিত্যের প্রসার, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে নিঃসন্দেহে দুই-ই সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছিল।
এইরূপে ভাষায় প্রাচীন সাহিত্য প্রচারের ফলে বাঙ্গালা দেশে যাহা ঘটিল, তাহা বাঙ্গালী জাতির উত্তর-কালের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পরিস্ফুট। শিক্ষিত ব্যক্তিরা সংস্কৃতে বিষ্ণুপারাণ, পদ্মপুরাণ, মহাভারত, হরিবংশ, সারদাতিলক তন্ত্র প্রভৃতি পড়িতেন— চৈতন্যদেবের পূর্বেকার কলে বাঙ্গালা দেশে বাঙ্গালা অক্ষরে লেখা এই-সব সংস্কৃত পুঁথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পুঁথিশালায় সংগৃহীত হইয়া আছে।
(ক্রমশ)