• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

বাঙ্গালীর সংস্কৃতি

দেশে যখন ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ-মতাবলম্বী হিন্দু রাজা ছিলেন, ভারতের বাহিরের দেশের প্রতি অথবা ধর্মগুরুর প্রতি তাকাইয়া থাকে এমন বিদেশীয় ধর্ম যখন দেশে ছিল না, তখন দেশের জন-সাধারণের প্রতি শিক্ষিত বা অভিজাত সমাজের দৃষ্টি ততটা আকর্ষিত হয় নাই।

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ তন্ত্রও এই ঝংকারের অন্যতম।
পাল ও সেন রাজাদের আমলে বাঙ্গালী-সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হইল, ইহার মূল সুর বাঁধা হইল। তারপর তুর্কী আক্রমণ ও বিজয়ের ঝড় বহিয়া গেল। মনে হইল, বুঝি সে-ঝড়ের মুখে বঙ্গ বীণার বাঁধা তার ছিঁড়িয়া যাইবে,—প্রাচীন ও মধ্য যুগের ভারতের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালী জাতীয়তার সৌধ ভাঙিয়া পড়িবে। তখন বাঙ্গালীর মধ্যে প্রান্তিক বা প্রাদেশিক জাতীয়তার বোধ হয় নাই—তখনকার দিনের বাঙ্গালীর সাহিত্যিক গৌরব ছিল না, বাঙ্গালী নিজেকে এক অখণ্ড ভারতেরই প্রত্যন্ত বা প্রদেশ-বাসী বলিয়া মনে করিত। যে-ঝড় কাবুল হইতে বিহার পর্য্যন্ত সমস্ত হিন্দুস্থানে বহিয়া গিয়াছিল, বাঙ্গালী তাহার প্রতিরোধ করিতে পারিল না। তাহাকে বৈতসী বৃত্তি অবলম্বন করিতে হইল।

কিন্তু এই বৈতসী বৃত্তির মধ্যেই তাহার জীবনী শক্তি অটুট রহিল। মুষ্টিমেয় তুর্কী বিজেতা ও তাহাদের পারসিক, পাঠান ও পাঞ্জাবী মুসলমান অনুচর যাহারা বাঙ্গালায় রহিয়া গেল, তাহারা বাঙ্গালার হিন্দুর সাহায্যেই বাঙ্গালায় দিল্লী হইতে স্বাধীন এক মুসলমান-শাসিত রাজ্য স্থাপন করিল। তুর্কী ও অন্য বিদেশী বিজেতৃগণ দুই-চারি পুরুষের মধ্যেই বাঙ্গালী বনিয়া গেল। তখনও ঊর্দু ভাষার উদ্ভব হয় নাই। উত্তর ভারতের সঙ্গে তুর্কী-বিজয়ের পূর্বে বাঙ্গালার যে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, সে-যোগ তুর্কী-বিজয়ের পরে যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হইয়া গিয়াছিল। বাঙ্গালায় উপনিবিষ্ট বিদেশী মুসলমানদের বাঙ্গালী স্ত্রী গ্রহণ করিতে হইত; তাহাদের সন্তানেরা ভাষায় বাঙ্গালীই হইত।

প্রথম সংঘাতের পরে বাঙ্গালায় উপনিবিষ্ট বিদেশী ও বিদেশী-মিশ্র মুসলমান এবং দেশের হিন্দু বাঙ্গালী জন-সাধারণের মধ্যে একটি সংস্কৃতি বিষয়ক সহযোগিতা আরম্ভ হইল; মুসলমান সুফী, দরবেশ, ফকীর ও গাজী ধর্ম-প্রচারের জন্য উত্তর-ভারত হইতে এবং ক্কচিৎ ভারতের বাহির হইতেও বাঙ্গালায় আসিতে লাগিলেন। ইহাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির লোক ছিলেন। ধর্মোন্মত্ততার ফলে হিন্দুদের অনেককে বল-পূর্বক মুসলমান করিয়া দেওয়া যে হয় নাই, তাহা নহে; তবে পীর, ফকীর, দরবেশ, আউলিয়া প্রভৃতিদের প্রচার ও কেরামতির ফলে, মুখ্যতঃ ব্রাহ্মণ্যের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ বৌদ্ধ ও অন্যান্য মতের বাঙ্গালী, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে। বাঙ্গালা দেশে যে মতের মুহম্মদীয় ধর্ম প্রচারিত হইয়াছিল, তাহা খাঁটি শরিয়তি অর্থাৎ কোরান-অনুসারী ইস্লাম নহে।

শরিয়তি মত, অন্য কোনও ধর্মের সঙ্গে সহযোগ করিতে প্রস্তুত নহে; বাঙ্গালা দেশে ইসলামের সুফী মত-ই বেশি প্রসার লাভ করে। সুফী মতের ইস্লামের সহিত বাঙ্গালার সংস্কৃতির মূল সুরটুকুর কোনও বিরোধ হয় নাই। সুফী মতের ইস্লাম সহজেই বাঙ্গালায় প্রচলিত যোগ-মার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধন-মার্গের সঙ্গে একটা আপস করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল; মধ্য-যুগে তুর্কী-বিজয়ের পর হইতে, যে ইসলাম বাঙ্গালায় আসিয়াছিল, তাহা নিজেকে বাঙ্গালীর পক্ষে সহজ-গ্রাহ্য করিয়া লইয়াছিল। বাঙ্গালা দেশে প্রচলিত ইসলাম ধর্ম বাস্তবিকই ‘মুজ্ম’উ-ল্-বহরৈন্’’ অর্থাৎ ‘দুইটি সাগরের সম্মিলন’ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। আমার ভূতপূর্ব ছাত্র ডক্টর শ্রীযুক্ত মুহম্মদ এনামূল্ হক্ বঙ্গদেশে ইসলাম-প্রচার বিষয়ে যে মূল্যবান গবেষণা করিয়াছেন, তাহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইলে আমরা বাঙ্গালী জাতির সংস্কৃতির একটা প্রধান দিকের ইতিহাসের উপর লক্ষণীয় আলোকপাত দেখিতে পাইব।

তুর্কী-বিজয়ের পরে যেমন একদিকে মুসলমান-ধর্ম-প্রচার চলিতে লাগিল, তেমনি অন্য দিকে বাঙ্গালার হিন্দু সমাজ-নেতৃগণ ঘর সামলাইবার জন্য বদ্ধ-পরিকর হইলেন। দেশে যখন ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ-মতাবলম্বী হিন্দু রাজা ছিলেন, ভারতের বাহিরের দেশের প্রতি অথবা ধর্মগুরুর প্রতি তাকাইয়া থাকে এমন বিদেশীয় ধর্ম যখন দেশে ছিল না, তখন দেশের জন-সাধারণের প্রতি শিক্ষিত বা অভিজাত সমাজের দৃষ্টি ততটা আকর্ষিত হয় নাই। অশিক্ষিত জন-সাধারণ চিরাচরিত রীতি অনুসারে গ্রাম্য ধর্ম পালন করিত, উচ্চ বর্ণের দ্বারা অনুষ্ঠিত নানা পূজা যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিত; তাহাদের মধ্যে ধর্ম-পিপাসা জাগাইবার এবং মিটাইবার জন্য যোগী, সন্ন্যাসী ও ভিক্ষু ছিল; তাহারা নিজেরাও নানা পর্ব-দিবস পালন করিত, সমাজের মন্থর গতির সঙ্গে-সঙ্গে চলিয়া তাহারাও মোটামুটি ভাবে ধর্ম সম্বন্ধে একটি ধারণা করিত।

(ক্রমশ)