• facebook
  • twitter
Saturday, 9 November, 2024

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ‘প্রথম’ নির্বাসিত লেখক গোলাম মুরশিদ চব্বিশের অভ্যুত্থানেও নির্বাসিত থেকে গেলেন

বাংলাদেশও তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়ে দেশ তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। প্রবন্ধ ও গবেষণায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮২) থেকে ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান 'একুশে পদক' (২০২১) প্রদান করে।

নির্বাসিত লেখক গোলাম মুরশিদ। ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

সময়ের অভিঘাত এড়ানো যায় না বললেই চলে। এজন্য সুসময়ের প্রাণপ্রবাহই দুঃসময়ের মরুভূমিতে গতিহারা নদীর মতো ছিন্নমূল অসহায়তাবোধ আমাদের কুরে কুরে খায়। জীবনের চড়াই-উতরাই যাত্রাপথে সময়ের পালাবদল অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সরকার উৎখাতের বিপর্যয়ের মধ্যেই চলে গেলেন সে দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক ও গবেষক, বেতার সাংবাদিক এবং একালের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক গোলাম মুরশিদ। প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার আকস্মিক অভ্যুত্থানে উৎখাত হয়, সরকারবিরোধী উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতায়নে দেশজুড়ে অস্থির বিপর্যয় নেমে আসে। চারদিকে নৃশংস তাণ্ডব শুরু হয়, অসংখ্য প্রাণ অকালে ঝরে যায়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে, উৎখাত হওয়া বিগত সরকারের শাসক দল থেকে তার অগণিত সমর্থকের বিরুদ্ধে লাগামহীন প্রতিশোধের পালা সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মুক্তিযোদ্ধার দেশটির ইতিহাস মুছে ফেলার আয়োজনের মধ্যেই সহিংস প্রতিশোধের আগুনে পোড়ার ভয়ে জনমানসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সেখানে আগের সরকারের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আত্মগোপনই যেখানে স্বাভাবিক প্রবণতা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে, সেখানে সম্পর্ক এড়িয়ে চলাই শ্রেয় মনে হয়।

বাংলাদেশের সরকারবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ ষড়যন্ত্রের সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ঘটে চলা সেই পালাবদলের আবহের মধ্যেই লণ্ডনপ্রবাসী গোলাম মুরশিদ ২২ আগস্ট প্রয়াত হন। এতে তাঁর শূন্যতাবোধে যেভাবে গণমাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রত্যাশিত শ্রদ্ধায় পূর্ণতার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ার বিপুল সম্ভাবনা ছিল, অচিরেই তা নামমাত্র সংবাদ পরিবেশনই মিলিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুও যেন অদ্ভুত নীরবতার গ্রাসে নৈঃশব্দে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাঁর প্রয়াণের আঘাতও যেন বাংলাদেশের সময়ের অভিঘাতের কাছে তুচ্ছ হয়ে ওঠে, মৃত্যুপরবর্তী মূল্যায়নের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণপ্রবাহও স্বাভাবিকভাবেই আত্মগোপন করে। শুধু ওপার বাংলাতেই নয়, এপার বাংলাতেও একই চিত্র বর্তমান। অথচ এপার-ওপার দুই বাংলাতেই তাঁর স্বচ্ছন্দ ও অবাধ বিচরণের আলো নিরন্তর সমীহ আদায় করে চলেছে সুদীর্ঘকাল। বাংলাদেশের আকস্মিক অভ্যুত্থানে সে দেশের ইতিহাসের মতো গোলাম মুরশিদের প্রয়াণের শূন্যতাকেও গ্রাস করে নিয়েছে। এজন্য তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাই দায়ী। যে মানুষটি দেশ ও দেশবাসীর জন্য নিজেকে গবেষণায় সঁপে দিয়েছেন, সেই গবেষকই ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’র ব্যক্তিত্বে স্বদেশে পরবাসীর উপেক্ষা ও অবজ্ঞার শিকার হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য বন্ধন ছিল প্রথমাবধি।

বাংলাদেশেই গোলাম মুরশিদের বেড়ে ওঠা, গড়ে তোলা জীবন ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। গ্রামবাংলার সঙ্গেই তাঁর নাড়ির যোগ পরবর্তীতে গবেষণার আগ্রহ ও প্রকাশের মধ্যেই প্রতীয়মান। ১৯৪০-এর ৮ এপ্রিল বরিশালের ধামুরা গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে গোলাম মুরশিদের জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুলের হেডমাস্টার। সেই বাবার কড়া শাসনেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। পল্লিগ্রামের স্কুলেই তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে তিনি যে খুব মনোযোগী ছাত্র ছিলেন, তাও নয়। তবে তাঁদের বাড়িতে থাকা ইতিহাসের শিক্ষকের ব্যবহৃত ইংরেজিতে লেখা বইগুলি পড়ে ফেলার মধ্যে তাঁর মননশীলতার পরিচয় ছোটবেলাতেই প্রতীয়মান। অন্যদিকে তাঁর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন কেটেছে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করার সময়েই তিনি উচ্চশিক্ষার স্বাদ পেতে শুরু করেন। সেখানে কৃতবিদ্য অধ্যাপকদের মধ্যে পেয়েছিলেন মুনীর চোধুরী, মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও আহমদ শরিফ প্রমুখ। তখনও তাঁর লেখাপড়ার বিস্তৃতি ঘটেনি, জানার পরিসরও ছিল সংকীর্ণ। ‘বইয়ের দেশ’ (জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭)-এর সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে জানিয়েছেন : ‘তবে সত্য কথা বলতে কী, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে যখন বের হই, তখন লেখাপড়া সামান্যই জানতাম। সে অর্থে আমি যেটুকু শিখেছি, নিজে নিজেই শিখেছি এবং তাও সামান্য।’ গোলাম মুরশিদের এই মন্তব্যে কোনও অসাধারণত্ব নেই।

অনেক কৃতী মানুষের ক্ষেত্রেই তা সত্য। কিন্তু তাঁর অসাধারণত্ব অর্জনের সাধনায় ও প্রকাশের অবিরত অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে। তিনি ক্রমশ নিজেকে স্বশিক্ষিত করে অধ্যাপনা থেকে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তার নিরলস সাধনা ও অধ্যবসায়ের বাইরেও তাঁর প্রকাশের নিবিড় আয়োজন বিস্ময়কর বিস্তৃতিতে সমীহ আদায় করে নেয়। আবার সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগ সুদূর লণ্ডনে থেকেও অবিচ্ছিন্ন অবিরল হয়ে ছিল আজীবন। প্রথমে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর উত্তরণ ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। সেখানে দু’দশকের ঘটনাবহুল অধ্যাপনা জীবনের সঙ্গে তাঁর দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ার আয়োজনের মধ্যেই তাঁর পরিচিতি ডানা মেলে। উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তান সরকারের মুখাপেক্ষী পূর্ব পাকিস্তানে থেকেও তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ উঁচু তারে বাঁধা মনটি প্রকাশের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকত। ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরিসরে সে দেশের মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে মনের ভাষাও প্রকাশের আলো খুঁজে পায়। শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ক্রমশ নিবিড় হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের সেই পরিসরে ১৯৭০-এ বিদ্যাসাগরের জন্মের দেড়শ বছর উপলক্ষ্যে তাঁকে নিয়ে ২৬ সেপ্টেম্বরের পরিসরেই গোলাম মুরশিদের মনে একটি সম্পাদিত বইয়ের পরিকল্পনা উঠে আসে। তখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কয়েকমাস আগে ডিসেম্বরে বইটি প্রকাশিত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিদ্যাসাগর সার্ধ শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ’টি প্রকাশিত হয় ১৭ জানুয়ারি, সভাপতিত্ব করেন হাসান আজিজুল হক। সেই জানুয়ারিতেও পূর্ব পাকিস্তানে উৎসবের মেজাজ ছড়িয়ে পড়েছিল ।

পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিপুল জয়লাভে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রত্যাশায় ওপার বাংলার বাঙালিমানসে আনন্দ ও উত্তেজনার হাওয়া বইছিল। সেই পরিসরে বই প্রকাশের খবর দেশের প্রধান কাগজগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে সেই প্রকাশের আলোতেই গোলাম মুরশিদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।

শেখ মুজিবর রহমানকে প্রধানমন্ত্রিত্ব না দিয়ে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বপ্নকে শুধু ভেঙ্গে দেয়নি, সমূলে বিনাশের আয়োজনে পূর্ব বাংলাজুড়ে দমনপীড়নের আয়োজন শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ২৫ মার্চের দিনচারেক আগেই ২১ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় কলকাতার আকাশবাণীতে গোলাম মুরশিদের সম্পাদিত বিদ্যাসাগরের বইটির প্রণবেশ সেনের আবেগমথিত সমীক্ষা ও দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ততোধিক আবেগে উচ্ছ্বসিত পাঠ পাকিস্তান সরকারেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় বাংলার ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শটি বিশেষভাবে তৎকালীন সরকারের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে। প্রসঙ্গত, বইটিতে অসংখ্য গুণী অধ্যাপক ও কৃতী মানুষের লেখা প্রকাশিত হয়। আহমদ শরীফ, মযহারুল ইসলাম, সনৎকুমার সাহা, সুশীলকুমার মুখোধাধ্যায়, বদরুদ্দীন উমর, রমেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখ। স্বাভাবিকভাবেই আকাশবাণীতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় উগ্র মৌলবাদী পাকিস্তান সরকারের চোখে গোলাম মুরশিদ সহজেই ‘ভারতের দালাল’ হয়ে ওঠেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিধনযজ্ঞে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশজন অধ্যাপকের মধ্যে গোলাম মুরশিদের নাম দুই নম্বরে উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩ এপ্রিল ছাব্বিশ দিনের শিশুকন্যাকে নিয়ে সপরিবারে তাঁকে রাজশাহীর ফ্ল্যাট, গবেষণার লেখালেখি, এলবাম, চিঠিপত্র ফেলে রেখে এবং ফটোফ্রেম থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি পাল্টে জিন্নার ছবি সেঁটে জীবন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। আধা শুকনো পদ্মা পেরিয়ে পরদিন বহরমপুর পৌঁছান, পরে ট্রেন ধরে ৬ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছে মৈত্রেয়ী দেবীর সহযোগিতায় সেখানে আশ্রয় লাভ করেন। সেই ভয়ঙ্কর আতঙ্কিত জীবনের কথা গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘যখন পলাতক : মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’(১৯৯৩)-তে সবিস্তারে লিখেছেন।

আবার সেখানেই শেষ নয়। সেই কলকাতার প্রবাসকালেই তাঁর লেখকজীবন ছড়িয়ে পড়ে। আবার তার সঙ্গে ভাবী বাংলাদেশেরও যোগ প্রকট হয়ে ওঠে। কলকাতায় পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই আনন্দবাজার পত্রিকার আমন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিকা সম্পর্কে ধারাবাহিক কিস্তিতে গোলাম মুরশিদের লেখনী সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখনও ওপার বাংলা সম্পর্কে এপার বাংলায় স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি। সেদিক থেকে বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্যকথা প্রকাশের আয়োজনে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোয় গোলাম মুরশিদের চটজলদি লেখাগুলি সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সেই ধারাবাহিক লেখার সংকলনই তাঁর প্রথম একক বইয়ের সমাদর লাভ করে। সেই ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে সাংস্কৃতিক পটভূমি’ বইটি ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় যখন সারা দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের আপসহীন সংগ্রাম চলেছিল। পাকিস্তান সরকারের ভয়ে নির্বাসিত ‘প্রথম’ লেখক হিসেবে তিনি যেভাবে দেশের বাইরে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিকে আনন্দবাজারে লেখার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তাতেই তাঁর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় (১৯২১) স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম না থাকায় মনের আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন। সেদিক থেকে গোলাম মুরশিদের লেখক জীবনের সঙ্গেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যোগ অত্যন্ত নিবিড়।

অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশেই তাঁর গভীর অধ্যবসায় ও গবেষণার পরিসর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের কৃতবিদ্য অধ্যাপক তপন রায়চোধুরীর ইতিহাসবোধ তাঁকে প্রভাবিত করে। তাঁকে তিনি একলব্যের মতো ধারণ করতে চেয়েছিলেন। ইতিহাস মানে যে সাল-তারিখের আর ঘটনার ফিরিস্তি নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তির নানাবিধ বিষয়ের সঙ্গেই তার সুগভীর সম্পর্ক বর্তমান, সে-সম্পর্কে তাঁর ধারণা ক্রমশ বিস্তার লাভ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গোলাম মুরশিদ তাঁর বহুল সমাদৃত ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ (প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০০৬) বইটি লেখার জন্য ‘সবচেয়ে বেশি সাহায্য’ পেয়েছিলেন তপন রায়চৌধুরীর কাছে থেকে। ‘তিনি অকৃপণভাবে’ তাঁকে ‘এন্তার তথ্য’ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ১৯৭৪-এ তপন রায়চৌধুরীর মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই গোলাম মুরশিদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর গবেষক-জীবন শুরু হয়ে যায়। সেখানে ‘বঙ্গবিদ্যা-বিশারদ’ ডেভিড কফের কাছে ‘হিন্দু সমাজ-সংস্কার সচেতনতার ইতিহাস’ নিয়ে পিএইচ.ডি করেন। তাঁর সেই গবেষণার ফসল পরে ‘সমাজ-সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক’(১৯৮৪) ও পরবর্তীতে ‘হিন্দু সমাজ-সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক’(২০১২) নামে বই প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় সূত্রে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের অধীনে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক রচনা নয়, বিশ্লেষণমূলক রচনার প্রাধান্যের ধারণাই গোলাম মুরশিদকে প্রাণিত করেছিল। সেদিক থেকে তাঁর গবেষণার সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির আত্মিক যোগ তাঁকে গবেষণার মাধ্যমে দেশ ও জাতির উত্তরণে সামিল করেছিল। ১৯৮৪-তে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)-তে যোগ দিয়ে আমৃত্যু দেশ ছেড়ে লন্ডনে প্রবাসী জীবন কাটালেও তাঁর গবেষণার সিংহভাগ জুড়েই বাংলার ইতিহাস-সমাজ-ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্য আবর্তিত হয়েছে। বিবিসি থেকে ২০০৩-এ অবসর নিয়েছেন। তার মধ্যেই তিনি বেতার সাংবাদিকতা, সংবাদ পাঠ ও উপস্থাপন থেকে সে দেশ ও বিদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। অবসরের পরেও তিনি দেশে ফেরেননি। অথচ দেশ তাঁর মন ও হৃদয় জুড়ে জেগে ছিল। অসংখ্য জরুরি গবেষণা তার পরেই সম্পন্ন করেছেন। তার মধ্যে দুটির কথা বিশেষভাবে অবিস্মরণীয়। একটি ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ (২০০৬), অন্যটি তিন খণ্ডে সমাপ্ত বাংলার সর্ববৃহৎ ও অভিনব অভিধান ‘বিবর্তনমূলক অভিধান’। অভিধানটির সম্পাদক ও পরিকল্পক হিসাবেও বাঙালির কাছে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আবার বাংলাদেশও তাঁকে আপন করে নিয়েছিল। সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়ে দেশ তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। প্রবন্ধ ও গবেষণায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮২) থেকে ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘একুশে পদক’ (২০২১) প্রদান করে। অথচ প্রয়াণের পরেও তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর অবকাশ পেল না সে দেশ। শুধু তাই নয়, দুই বাংলা জুড়ে তাঁর গবেষণার সৌরভ যেভাবে সুদীর্ঘ সময় জুড়ে প্রচারের আলো পেয়েছিল, তাঁর অন্তিম প্রয়াণের সংবাদও সেভাবে প্রচারের আলো পেল না। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। তাঁর মূল্যায়নেও সেকথা বারবার উঠে এসেছে। ‘হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতি’তেও তিনি তা লিখেছেন : ‘সত্যি বলতে কি, ধর্মের নামে দেশ বিভক্ত হলেও, পরিহাসের বিষয় এই যে, দেশবিভাগের পর শিক্ষার বিকাশ, শিল্পায়ন, এবং নগরায়নের ফলে আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি শিক্ষিত মানুষের আনুগত্য উভয় বাংলায়ই কমে যায়। তা ছাড়া, ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ববাংলায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধে এবং তাও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি আনুগত্য হ্রাস পেতে সাহায্য করেছিল।’ গোলাম মুরশিদের ধারণা বা মূল্যায়ন যে বর্তমান বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী ও বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক শক্তি ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেক্ষেত্রে তাঁর মতো ‘ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে নিজেকে একজন নির্ভেজাল আন্তর্জাতিক মানুষ’ হিসেবে তুলে ধরতে চাওয়া মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাসকে অস্বীকার করে মুছে ফেলা ধর্মান্ধ দেশে সমাদর লাভ করতে না পারাই দস্তুর। যে বাংলাদেশ গোলাম মুরশিদের মনে জেগেছিল, ৫ আগস্টে তা ধবংস হয়ে গেছে। ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস এবারে তা-ই উল্টে গেল! তাঁর রচিত ইতিহাসেই মুক্তিযোদ্ধার দেশ বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ আত্মগোপন করে আছে, ভাবা যায়! বেঁচে থাকলে গোলাম মুরশিদ তাঁর আপসহীন ব্যক্তিত্বে নিশ্চয় তাঁর মূল্যায়ন ফিরিয়ে নিতেন।