হীরক কর
বারংবার জলবায়ু পরিবর্তনে বিজ্ঞানী থেকে বিশেষজ্ঞ সকলেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। বিশ্বজনীন তাপমাত্রার পারদ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তবে সতর্কবার্তা কেউ যেন কানেই তুলছেন না। টনকই নড়ছে না কারও। প্রত্যেক বছরই বন্যায় ভেসে যাচ্ছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ। বারবার ধ্বস নেমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ‘শিলিগুড়ি- সিকিম জাতীয় সড়ক’। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে দার্জিলিং, কালিম্পং।
মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বানের প্রকোপও রয়েছে।
তারওপর বিশ্ব জুড়ে দ্রুত গলছে হিমবাহ। হিমালয়ের কোলেও রয়েছে এই রকম বহু হিমবাহ। সেগুলোও গলছে। গলে তৈরি হচ্ছে বিপুল জলাভার। হিমবাহ গলে নামছে ধস। আর ওই সব জল পাহাড়ি নদীর মধ্যে দিয়ে নেমে এসে ঘটায় বন্যা, ‘ফ্ল্যাশফ্লাড’। আর তার চেয়েও বড় ও ভয়ংকর যেটা ঘটতে পারে, সেটা হল ক্রমশ নদী ও সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি এবং তার থেকে প্লাবন। তখন ডুববে নগর-গ্রাম-জনপদ।
বিশ্ব জলবায়ু সংস্থা জানিয়েছে, চলতি বছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিবেশগত বিপর্যয়ের সাক্ষী থেকেছে এশিয়া। বলাবাহুল্য, ভারতের পরিস্থিতিও শোচনীয়। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র তরফে জানানো হয়েছে, হিমালয় অঞ্চলে শতাধিক হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে। সেই বরফগলা জলে বাড়ছে হ্রদের আয়তন। যা বড়সড়ো বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে হিমবাহের পশ্চাদপসরণের পরিপ্রেক্ষিতে, কিছু হ্রদের এলাকা “বিপজ্জনকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে”। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি (এনডিএমএ) দ্বারা গঠিত কমিটি দেশের হিমবাহ হ্রদের দুর্বলতা পুনর্মূল্যায়ন করতে ১৩টি “সম্ভাব্য বিপজ্জনক” হিমবাহ চিহ্নিত করেছে। পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞদের মতে, হিমালয়ের হিমবাহের হ্রদ এবং ‘গ্লাসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’-এর সাথে জড়িত। হিমালয়ান জিওলজির ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে গঙ্গোত্রী হিমবাহের কাছে অসংখ্য হিমবাহী হ্রদ অবস্থিত , যার কিছুকে “অত্যন্ত বিপজ্জনক” হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। তারা বিশেষভাবে ‘বসুধারা’ লেককে হাইলাইট করেছে, “উচ্চ স্তরের বিপদ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার” ওপর জোর দিয়েছে।
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ রিমোট সেন্সিং’-এর বিশেষজ্ঞ, যাঁরা মন্দাকিনী , ভাগীরথী এবং অলকানন্দা নদীর ধারে হিমবাহের চারপাশে গঠিত হ্রদগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন । তাঁরা উল্লেখ করেছেন যে বিশেষ করে কেদারতাল, ভিলাঙ্গানা এবং গোরিগঙ্গা হিমবাহগুলো সম্প্রসারণের সম্মুখীন হচ্ছে।
সৃষ্টির নিরিখে হিমবাহ হ্রদগুলোকে মূলত দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়, মোরেন-ড্যামড লেক বা গ্রাবরেখা থেকে সৃষ্ট হ্রদ। অধঃক্ষিপ্ত হিমবাহ অগ্রসর হওয়ার সময় তার সঙ্গে যে নুড়ি, পাথর, বালি, কাদা বাহিত হয়, হিমবাহ গলতে শুরু করলে, সেগুলো হিমবাহের প্রবাহপথের আশেপাশে সঞ্চিত হতে থাকে। যে রেখা বরাবর ওইসব পদার্থ জমা হয়, তাকে বলা হয় গ্রাবরেখা। এই গ্রাবরেখার মধ্যিখানে জল জমে তৈরি হয় মোরেন-ড্যামড লেক।
আইস ড্যামড লেক বা বরফ জমে তৈরি হ্রদও রয়েছে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে। নদী বা উপনদীর জলপ্রবাহে যখন হিমবাহ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা থেকে সৃষ্টি হয় আইস ড্যামড লেকের। ভূমিক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট হ্রদ এং হিমবাহ হ্রদও রয়েছে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে, যা হিমবাহ গলে তৈরি হয়। বিপজ্জনক ভাবে আয়তন বৃদ্ধি পাওয়া ৬৭৬টি হ্রদের উল্লেখ করে উদ্বেগের কথা শুনিয়েছে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’। তার মধ্যে ৩০৭টি মোরেন হ্রদ, ২৬৫টি ভূমিক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট হ্রদ, আটটি বরফ গলা জল জমে তৈরি হ্রদ এবং অন্য়ান্য হ্রদ রয়েছে ৯৬টি।
‘ইসরো’র তরফে জানানো হয়েছে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ থেকে সৃষ্ট হ্রদের ব্যাপ্তি ঘটেছে হু হু করে। শতাংশের হিসেবে যা ৮৭। কয়েক বছরে কিছু হ্রদের আয়তনও ফুলে ফেঁপে দেড় থেকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একটি বা দু’টি হ্রদেই বিষয়টি থেমে নেই, আয়তন বেড়েছে ৬৭৬টি হ্রদের।
আরও উদ্বেগের বিষয় হল যে ৬৭৬টি হ্রদের আয়তন বৃদ্ধির কথা ‘ইসরো’ জানিয়েছে তার মধ্যে ১৩০টি হ্রদই ভারতে অবস্থিত। ৬৫টি হ্রদ অবস্থিত সিন্ধু নদ অববাহিকা অঞ্চলে। সাতটি অবস্থিত গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে। ৫৮টি অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলে। উদ্বেগ দেখা দিয়েছে হ্রদগুলোর ভৌগলিক অবস্থান নিয়ে। ৩১৪টি হ্রদ যেগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০-৫০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত সেগুলির আয়তন বেড়েছে বিপজ্জনক ভাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় অবস্থিত ২৯৬টি হ্রদ।
উদাহরণস্বরূপ, ‘ইসরো’র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, হিমাচল প্রদেশের সিন্ধু অববাহিকায় অবস্থিত ঘেপাং হ্রদে দীর্ঘ বছর ধরেই পরিবর্তন হচ্ছে। ১৯৮৯-২০২২ সালের মধ্যে হ্রদটির আয়তন ৩৬.৪৯ হেক্টর থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০১.৩০ হেক্টর। অর্থাৎ গত তিন দশকে, হ্রদটির প্রতি বছর ১.৯৬ হেক্টর করে আয়তন বেড়েছে।
গত তিন-চার দশক ধরে ‘ইসরো’ মহাকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে একাধিক ছবি তুলে তথ্য সংগ্রহ করেছে। তার ভিত্তিতেই হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের বিপজ্জনক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে এই রিপোর্ট। ১৯৮৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে নদী অববাহিকায় কী কী পরিবর্তন ঘটেছে ‘ইসরো’ রিপোর্টে তার বিশদ তথ্য উল্লেখ করেছে। ২০১৬-২০১৭ সালে চিহ্নিত করা হয়েছিল ১০ হেক্টর আয়তনের ২,৪৩১টি হ্রদকে। কিন্তু ১৯৮৪ সাল থেকে এর মধ্যে ৬৭৬টি হ্রদের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। ৬০১টি হ্রদের আয়তন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ১০টি হ্রদের আয়তন ১.৫-২ গুণ বেশি হয়েছে। ৬৫টি হ্রদের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৫ গুণ।
‘ইসরো’র তরফে জানানো হয়েছে, হিমবাহ গলে যেভাবে আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে হ্রদগুলোর, তাতে জল বিস্ফোরণের সম্ভাবনা ক্রমে বেড়েই চলেছে। এতে সংলগ্ন এলাকার পরিকাঠামো, জনজীবন এবং পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে। ইসরোর উদ্বেগ, লাগাতার নজরদারি চালানোর পাশাপাশি, ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।
কিন্তু এ বিপদের কথা তো এতদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি। এ তো আর তত নতুন কথা নয়। তাহলে নতুন করে কেন বিপদের কথার আলোচনা কেন ? কারণ, সত্যিই নতুন আর একটি বিপদ উঁকি দিচ্ছে। জানা গেছে, হিমবাহে জমে থাকা বরফেই লুকিয়ে রয়েছে ভয়ংকর এক অন্য বিপদ। লুকিয়ে আছে হাজার হাজার প্রাচীন ভাইরাস! এর কয়েকটি তো প্রায় ৪১,০০০ বছরেরও পুরনো! উত্তর-পশ্চিম তিব্বত মালভূমিতে ‘গুলিয়া’ হিমবাহ থেকে বরফের কোর সংগ্রহ করেছিল চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ জন গবেষকের এক দল। সেই বরফের নমুনাগুলো থেকেই ১৭০০টিরও বেশি ‘ভাইরাল জিনোম’ পাওয়া গিয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশ সম্পর্কেই বিজ্ঞানীদের এর আগে কিছু জানা ছিল না। ‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্নালে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬,০০০ মিটার উপরে অবস্থিত ওই হিমবাহটিতে যুগে যুগে এই সব ভাইরাস সংরক্ষিত হয়েছে। অন্তত ন’টি আলাদা আলাদা প্রাচীন যুগ থেকে এসেছে এই সব ভাইরাস। গবেষকরা জানিয়েছেন, হিমবাহগুলো গলে এই সব ভাইরাস যদি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে এবং ‘করোনা’র মতো মহামারি সৃষ্টি করতে পারে। আগামী দিনে এগুলো যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তাঁরা। এই গবেষণায় জলবায়ু-পরিস্থিতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ভাইরাসগুলোর মধ্যেও কী পরিবর্তন ঘটেছে তাও পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই অর্জিত জ্ঞানও এ সংক্রান্ত নতুন গবেষণায় আগামীদিনে কাজ হবে।
দেখা যাচ্ছে, ত্রিশ লাখ ভারতীয় এমন এলাকায় বাস করে যেখানে হিমবাহ লেক আউটবার্স্ট বন্যা যে কোনো সময় ঘটতে পারে। এই ধরনের এলাকার প্রথম বৈশ্বিক মূল্যায়ন পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে দুই মিলিয়ন পাকিস্তানি, তারা বিশ্বব্যাপী এই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন মোট লোকসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ।
বিজ্ঞানীদের দাবি, ভারতীয় ভূখণ্ডের হিমালয় অঞ্চলে ৫ হাজার হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদ রয়েছে। তার মধ্যে ৫০০-র বেশি হ্রদ রয়েছে শুধুমাত্র উত্তরাখণ্ডেই। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডের ৭৮টি তহশিলের মধ্যে ২৬টি হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদের কারণে ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়তে পারে। যাকে ভূগোলের পরিভাষায় ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ বলা হয়।
বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’-এর রিপোর্ট বলছে, ১৯৯০-২০১৮ সালের মধ্যে এ ধরনের হ্রদের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক এ পি ডিমরি জানিয়েছেন, উত্তরাখণ্ডে যে ভাবে হড়পা বানের সৃষ্টি হয়েছে, আগামী দিনে আরও বেশি মাত্রায় এমন বানের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। তাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে ভাতওয়াড়ি, জোশীমঠ এবং দারচুলার মতো এলাকাগুলোর।
নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী, ৩৯টি দেশে ৯০ মিলিয়ন মানুষ হিমবাহী হ্রদ ধারণকারী ১,০৮৯ অববাহিকায় বাস করে। এর মধ্যে ১৫ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৬.৬ শতাংশ হিমবাহী হ্রদের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে। বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ৯.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬২ শতাংশ উচ্চ পর্বত এশিয়া হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত।
মাত্র চারটি উচ্চ জনসংখ্যার দেশ,ভারত, পাকিস্তান, পেরু এবং চীন। বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত জনসংখ্যার ৫৯ শতাংশের বেশি। ‘নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি’র ক্যারোলিন টেলরের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের একটি দলের গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় অর্ধেক (৪৮ শতাংশ) উদ্ভাসিত জনসংখ্যা বিশ্বব্যাপী হ্রদের ২০ কিমি থেকে ৩৫ কিলোমিটার নিচের দিকে অবস্থিত। বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ এক বা একাধিক হিমবাহী হ্রদের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে। যার অধিকাংশই – ৬৬ শতাংশ বা ১৯৮,০০০ মানুষ হিমালয়তে পাওয়া যায়।
সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এবং ডাউন টু আর্থ স্টেট অফ ইন্ডিয়াস এনভায়রনমেন্টের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে ভারত, চীন এবং নেপালে জলের বিস্তারের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ভারতের সাতটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য একটি বিপজ্জনক। এর মধ্যে ছয়টি হিমালয় রাজ্য, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশ।
ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা এই হ্রদের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করে এবং বন্যার ঝুঁকি তৈরি করে – একটি পরিস্থিতি যা ‘গ্লাসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ নামে পরিচিত। এই ধরনের বন্যা ২০১৩ সালে কেদারনাথ উপত্যকা এবং ২০২১ সালে চামোলির কিছু অংশ ধ্বংস করেছিল। গত বছরের অক্টোবরে, উত্তর সিকিমের দক্ষিণ লোনাক হ্রদটি ভেঙ্গে যায়, যার ফলে একটি হিমবাহী হ্রদ বিস্ফোরণে বন্যা হয়। ৪ অক্টোবর, ২০২৩-এ দক্ষিণ লোনাকের ৬ কিলোমিটার ভাটিতে ঝানাকে আইটিবিপি পোস্টটি ধ্বংস করা হয়েছিল।তিস্তা-৩ বাঁধ, সিকিমের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প একটি, ‘গ্লাসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, যা নিম্নধারার অঞ্চল এবং সম্প্রদায়ের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ৩ অক্টোবর, ২০২৩-এর আকস্মিক বন্যা চুংথাং-এ তিস্তা-৩ বাঁধ ধ্বংস করেছিল।
‘এনডিএমএ’-এর এক আধিকারিক জানান, এখন, সমস্ত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সংস্থাগুলো নিবিড়ভাবে কাজ করছে এবং ইতিমধ্যেই এই উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হ্রদের মধ্যে ১৫টিতে অভিযান সম্পন্ন করেছে। ছয়টি সিকিমে, ছয়টি লাদাখে, একটি হিমাচল প্রদেশে এবং দুটি জম্মু ও কাশ্মীরে। আরও সাতটি অভিযান চলছে । ৪,৫০০ মিটার এবং তার বেশি উচ্চতায় অস্বস্তিকর ভূখণ্ড এবং আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে, এই শক্তিশালী হ্রদের কাছে যাওয়ার জন্য শুধুমাত্র জুন থেকে সেপ্টেম্বরের একটি উইন্ডো আছে। হ্রদ-নিম্নকরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি পরিদর্শনের প্রয়োজন হবে। যার মধ্যে কিছু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োজন হতে পারে। এমনই একটি অভিযান অরুণাচল প্রদেশে চলছে। যেখানে ছয়টি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ হিমবাহের হ্রদ থেকে বিপদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এই যৌগিক অভিযানগুলো হিমবাহের হ্রদের কাঠামোগত স্থিতিশীলতা এবং সম্ভাব্য লঙ্ঘন পয়েন্টগুলো মূল্যায়ন করছে। প্রাসঙ্গিক হাইড্রোলজিক্যাল এবং ভূতাত্ত্বিক নমুনা এবং ডেটা সংগ্রহ করছে। জলের গুণমান এবং প্রবাহের হার পরিমাপ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করছে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষকে সচেতন করছে । অন্য একজন আধিকারিক, ব্যাখ্যা করে বলেন,
এই হিমবাহী হ্রদের ঝুঁকি বিবেচনা করে, ‘এনডিএমএ’ পরামর্শ দিয়েছে, যে ‘হিমবাহ লেক আউটবার্স্ট বন্যা’র প্রভাব প্রশমিত করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। যে ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা, স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন এবং অন্যান্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ন্যাশনাল গ্লাসিয়াল আউটব্রস্ট ফ্লাড রিস্ক মিটিগেশন প্রোগ্রাম (এনজিআরএমপি) গত ২৫ জুলাই সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল। এই বিষয়ে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশের রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের জন্য একই লাইনে একটি পৃথক কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রোগ্রামটির লক্ষ্য বিশদ প্রযুক্তিগত বিপত্তি মূল্যায়ন, এবং ‘স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া’ এবং ‘জল স্তর পর্যবেক্ষণ স্টেশন’ এবং হ্রদ এবং নিম্নধারার এলাকায় ‘প্রাথমিক সতর্কীকরণ সিস্টেম’ ইনস্টল করা। এনডিএমএ ইঙ্গিত দিয়েছে যে উত্তরাখণ্ড সরকারও হিমবাহ লেক আউটবার্স্ট বন্যার ঝুঁকির মূল্যায়ন করছে। ভারতের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তেরোটি হ্রদ উত্তরাখণ্ডে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তরাখণ্ডে যে সব হিমবাহ সৃষ্ট হ্রদ তৈরি হয়েছে তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হ্রদের বাঁধন খুবই আলগা। যেগুলো অতি সহজে ভেঙে গিয়ে হড়পা বানের সৃষ্টি করতে পারে। পর্বতশিখরে জমে থাকা তুষার উষ্ণায়ণের কারণে দ্রুত গলছে। হিমবাহগুলো গলে যাওয়ার কারণে পাহাড়ের কোলে থাকা হ্রদগুলোর জলস্তর বাড়ছে। হ্রদের আশপাশে জমে থাকা তুষার, পাথর এবং কাদার বাঁধন কোনও কারণে আলগা হয়ে গেলেই হ্রদের জলের চাপ ধরে রাখতে পারে না। ফলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে। আচমকা হরপা বান এনে ফেলে তিস্তার মতো নদীখাদে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি, বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প, গাছ কাটা এবং লাগামহীন পর্যটকদের আনাগোনার মতো বিষয়গুলো। আমেরিকার এক সংবাদ সংস্থা ‘সিএনএনএন’ তাঁদের এক রিপোর্টে বলেছে গত শতকের সাতের দশকে ‘চিপকো’ আন্দোলনের ধাত্রীভূমি বলে পরিচিত উত্তরাখণ্ডের ‘অলকানন্দা’ উপত্যকার ওই গ্রামের লোকজন আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, যথেচ্ছ গাছ কাটা, যেখানে-সেখানে সেতু তৈরি, বাঁধ দেওয়া অথবা পর্যটকদের আনাগোনায় রাশ টানা না হলে বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে উত্তরাখণ্ড। সে সময় এই গ্রামের বাসিন্দাদের আন্দোলেনর চাপেই মূলত ১৯৮০ সালে ‘বনআইন’ পাশ হয় সংসদে। তার পর থেকে এই গ্রামের বাসিন্দারা লাগাতার প্রকৃতি ধ্বংস করার বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। কিন্তু, তাঁদের কথায় কোনও হেলদোল হয়নি। ২০১৩ সালে উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যের পর ফের এক বার ওই সতর্কবার্তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন অনেকেই। এখন, হিমালয়ের ভারতীয় অংশে প্রায় ৭,৫০০টি হিমবাহী হ্রদের মধ্যে, এনডিএমএ ১৮৯টি “বিপজ্জনক হ্রদ”-এর একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে। যেখানে ঝুঁকির কারণ কমানো দরকার। অবশ্যই অবিলম্বে ।কেননা,ধ্বংসের প্রায় খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে বাস্তুতন্ত্র !