• facebook
  • twitter
Wednesday, 6 November, 2024

‘আয়ুষ্মান ভারত’ বনাম ‘স্বাস্থ্যসাথী’— একটি অনপেক্ষ আলোচনা

সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে বা সরাসরি অর্থ সাহায্য করে বা কিছু সরকারি সুবিধা দিয়ে দারিদ্রসীমার উপরে তুলে এনে সমাজের মূল আর্থ-সামাজিক স্রোতে প্রবেশ করান। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে কেন্দ্র/রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিৎ সর্বপ্রথম গরিব মানুষের দারিদ্রমুক্তি। কেন্দ্র/রাজ্য সরকারের রাজকোষে অর্থসীমিত। সামাজিক খাতে সেই সীমিত অর্থের ব্যয় এমন ভাবে করতে হবে যাতে নির্বাচিত উপভোক্তারা গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষ হন।

প্রতীকী চিত্র

শ্যামল কুমার মিত্র

প্রথমেই বলি ২টি প্রকল্পই সরকারি অর্থে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধির কাজটা সাফল্যের সঙ্গেই করে থাকে। ২টি প্রকল্পে যে বিপুল সরকারি ব্যয় হয় তা সরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিকাঠামোয় কোন স্থায়ী/অস্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদী/স্বল্প মেয়াদী উপযোগ সৃষ্টি করে না। বস্তুত জনপ্রত্যাশিত মান, সন্তোষ ও গতিতে পরিষেবা দিতে সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোর চূড়ান্ত ব্যর্থতা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে এই ধরনের প্রকল্প আনে সরকার। প্রকল্প ২টিতে যে বিপুল সরকারি ব্যয় হয়, সেই অর্থ সরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার পরিকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে ব্যয় হলে, সরকারি ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষ দীর্ঘমেয়াদে উপকার পেতে পারতেন। বস্তুত যখন পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে সরকারি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিকাঠামোর প্রয়োজন ভিত্তিক উন্নয়ন করা যাচ্ছে না, ব্যাপক সংখ্যায় ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের শূন্যপদে নতুন নিয়োগ করতে পারছে না সরকার, অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি না করে পূর্বোক্ত প্রকল্প ২টির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থ বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের পকেটে পুরে দেওয়ার সরকারি নীতি সমর্থনযোগ্য নয়। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিকাঠামোকে সর্বোত্তম মানে উন্নীত করার বিকল্প কিছু হতে পারে না।

‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প চালু হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষ থেকে। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ চালু হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ থেকে ২টি প্রকল্পেই পরিবার ভিত্তিক কার্ডের মাধ্যমে বছরে কার্ডপ্রাপক পরিবারের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যয়ের চিকিৎসা সরকারি/নির্বাচিত ও তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালে করাতে পারেন। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে স্পষ্ট, উভয়প্রকল্পের উপভোক্তারা সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে বেসরকারি হাসপাতালে চিখিযসা করাতে বেশি পছন্দ করছেন যা সরকারি হাসপাতালগুলির উপর উপভোক্তাদের অনাস্থার প্রমাণ। সরকারকে ভাবতে হবে সরকারি হাসপাতালের উপর এই জন অনাস্থার কারণ কি। প.ব. সরকার স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে বছরে কম বেশি ২৫০০ কোটি টাকা খরচ করেন। আয়ুষ্মান ভারতে কেন্দ্র সর্বোচ্চ ৬০% অর্থ দেয়। বাকি ৪০% সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার বহন করে। সঙ্গত যুক্তিতেই বলা যেতে পারে রাজ্য সরকার যে প্রকল্পে ৪০% অর্থ দেন, সেই প্রকল্প শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় প্রকল্প নামে চলবে কেন? কেন এটি কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ প্রকল্প বলা হবে না? রাজ্য ৪০% অর্থব্যয় করবে, অথচ কেন্দ্র প্রকল্পের পুরো কৃতিত্ব নেবে, রাজ্য সরকারগুলির শাসক দল তা মানবে কেন? দিনের শেষে সকলকেই তো কাজের খতিয়ান দিয়ে নির্বাচনে লড়তে হয়। ‘জনকল্যাণের পূর্ণ কৃতিত্ব আমি নেব’—মূলতঃ এই রাজনৈতিক দৃষ্টি কোন থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এ রাজ্যে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ কার্যকর করতে দেয়নি। অন্যথায় ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ থেকে এ রাজ্যে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প বন্ধ করে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ চালু করাই যেত, সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বছরে ২৫০০ কোটি টাকার ৪০% অর্থাৎ ১,০০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করতেই পারতেন। রাজকোষের অর্থ শাসক দলের দলীয় তহবিল বা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিল নয়। শুধুমাত্র কৃতিত্ব কে নেবেন-নরেন্দ্র মোদী না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এই লড়াইয়ের কারণে বছেরে ১,০০০ কোটি টাকার ‘অযৌক্তিক দায়’ রাজ্য সরকার নেবে কেন? যে রাজ্য এতটাই ঋণগ্রস্ত যে রাজ্যের নিজস্ব আয়ের প্রায় সবটাই চলে যায় ঋণের সুদ মেটাতে, রাজ্য চলে মূলত কেন্দ্রীয় করের অংশ, কেন্দ্রীয় প্রকল্প ভিত্তিক বরাদ্দ ও অনুদানের টাকায়, সেই রাজ্য সরকারের পক্ষে বছরে ১,০০০ কোটি টাকার অপব্যায়ের বিলাসিত প্রদর্শন কোন্ জনস্বার্থে? তাছাড়া কেন্দ্র/রাজ্য কে দিচ্ছে-এ প্রশ্নটাই অবান্তর, কারণ টাকাটা আসছে জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকে বাধ্যতামূলক করের টাকায়, কারো ব্যক্তিগত দান থেকে নয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২৯ অক্টোবর বলেছেন, ‘এই ২ সরকার (পড়ুন দিল্লি পশ্চিমবঙ্গ সরকার) এতটাই অমানবিক যে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চারিতার্থ করতে সাধারণ মানুষের জন্য কেন্দ্রের এই-স্বাস্থ্যপ্রকল্প (পড়ুন আয়ুষ্মান ভারত) কার্যকর করেনি।’ মানলাম, রাজনৈতিক স্বার্থে পুর্বোক্ত ২ সরকার প্রকল্পটি তাদের ২ রাজ্যে কার্যকর করেনি, কিন্তু আপনিও তো সংশ্লিষ্ট রাজ্য থেকে ৪০% অথর্ নিয়ে প্রকল্প কার্যকর করছেন, অথচ আপনার দলের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে একটি কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ প্রকল্পকে কেন্দ্রীয় প্রকল্প বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। মানলাম, পূর্বোক্ত ২টি সরকার ‘অমানবিক’ (?)। প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, আপনার সরকার তো ‘মানবিক’। আপনি নিশ্চয় জানেন আপনার ‘এক দেশ-এক কর’ নীতিতে রাজ্য সরকারগুলির নিজস্ব আয়ের সুযোগ যথেষ্ট কমেছে। সেই প্রেক্ষিতে মানুষের স্বার্থে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের ১০০% আর্থিক দায় মাথায় নিয়ে এই প্রকল্প একাধিক রাজ্যে কার্যকর না হওয়ার মূল কারণটা দূর করতেই পারতেন আপনার ‘মানবিক সরকার’। করেননি কেন? শুধু এই প্রকল্প নয়, প্রায় প্রতিটা কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের আর্থিক দায় বৃদ্ধি করে চলেছেন মোদি সরকার, অথচ কৃতিত্ব দাবি করছেন ১০০%—এটি সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার বিষয় নয়? চালুনির পক্ষে সূচের ফুটো না খোঁজাই ভাল। ‘আয়ুষ্মান ভারত’ মোদি সরকারের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প।

আগস্ট-২০২৩ এর সি.এ.জি. অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে: (১) এই প্রকল্পে এমন সাড়ে ৭ লক্ষেরও বেশি এমন বেনি ফিশিয়ারি রয়েছেন যাঁদের প্রত্যেকের ফোন নম্বর ৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯। (২) এমন ১.৪ লক্ষ বেনিফিশিয়ারি রয়েছেন যাদের প্রত্যেকের ফোন নম্বর ৮৮৮৮৮৮৮৮৮৮। (৩) মধ্যপ্রদেশে ৪০৩ জন বেনিফিশিয়ারির চিকিৎসার জন্য ১.১ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন, অথচ প্রকল্পের ডেটা বেসে সেই ৪০৩ রোগি ‘মৃত’ বলে চিহ্নিত। (৪) একই আধার কার্ড ব্যবহার করে উপভোক্তা হিসাবে অসংখ্য রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। (৫) একই রোগিকে একই সময়ে রাজ্যের একাধিক হাসপাতালে ভর্তি দেখান হয়েছে। (৬) ২.২৫ লক্ষ রোগির ক্ষেত্রে অপারেশনের তারিখ হাসপাতাল থেকে রোগিকে ডিসচার্জ করার অনেক পরে। (৭) ৪৫ হাজার রোগিকে হাসপাতালে অ্যাডমিশন করার আগেই ডিস চার্জ করে দেওয়া হয়েছে। (৮) এই প্রকল্পে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮৯ হাজার রোগি মারা যাওয়ার পরও সেইসব মৃত মানুষকে চিকিৎসাধীন দেখিয়ে ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৯৩২টি ক্লেম পেন্ডিং দেখান হয়েছে। (৯) গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে, মেঘালয়ে ১১.৫ লক্ষ ভুয়া বেনিফিশিয়ারি আছে জানানোর পরও তদন্ত হয়েছে মাত্র ৭ লক্ষের ক্ষেত্রে। ৪.৫ লক্ষ ভুয়া বেনিফিশিয়ারি রয়েইে গেছেন। স্থানাভাবে আরো একাধিক বেনিয়মের উল্লেখ করা গেল না। এই অভিযোগগুলি কোন অবিজেপি রাজনৈতিক দলের নয়। নিরপেক্ষ, স্ব-শাসিত সাংবিধানিক সংস্থা সি.এ.জি.-র তথ্য প্রমাণ সহ অডিট রিপোর্ট। ‘মানবিক সরকার’ সাধারণ মানুষের ‘মসিহা’ প্রধানমন্ত্রী মহোদয় কি বলতে পারবেন, ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের এই পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি, রাজকোষের টাকার হরির লুঠ আটকাতে তাঁর সরকার কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি?’

‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করলাম না কারণ রাজ্যের মানুষ বিশ্বাস করেন তৃণমূল ক্ষমতায়, অথচ দুর্নীতি হবে না—এমনটা সম্ভব নয়। তাই অন্য বিষয়গুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেট বিবৃতির ৪১ পাতার ৩.১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ৩১.১২.২০২৩ পর্যন্ত রাজ্যের ২.৪৫ কোটি পরিবার অর্থাৎ ৯ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন সদস্য ধরে) স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় এসেছেন। অর্থাৎ রাজ্যের ৯৮% মানুষ স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে রয়েছেন। কেন্দ্র সরকারের নীতি আয়োগ প্রকাশিত এক সমীক্ষা রিপোর্ট অনুসারে (২০২২) পশ্চিমবঙ্গে মাল্টি ডাইমেনশনাল পোভার্টি ইনডেক্সের নিরিখে দারিদ্র সীমার নিচে ২১.৭% মানুষ (বি.পি.এল.) বসবাস করেন। সংবিধান অনুসারে বি.পি.এল. তালিকা তৈরির দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। অতিক্রান্ত ১৩ বছরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যে বি.পি.এল. তালিকা তৈরির কোনও উদ্যোগ নিয়েছেন এমন তথ্য নেই। কিন্তু বাজেট বিবৃতির ৯ নম্বর পাতায় রাজ্য সরকার দাবি করেছেন—(১) বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় আসার আগে রাজ্যে বি.পি.এল. জনসংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৫৭.৬০%। (২) বর্তমান সরকার ৪৯% বি.পি.এল. মানুষকে দারিদ্র সীমার উপরে তুলে এনেছেন। (৩) বর্তমানে রাজ্যের জনসংখ্যার ৮.৬% মানুষ বি.পি.এল. তালিকাভুক্ত। মাননীয় অর্থমন্ত্রী কোথা থেকে এ তথ্য পরিসংখ্যান পেয়েছেন জানি না। রাজ্যে বর্তমান সরকার বি.পি.এল. তালিকাই তৈরি করলেন না। অথচ কোন সমীক্ষা ছাড়াই বি.পি.এল. সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারি তথ্য হিসাবে বাজেট বিবৃতি পুস্তিকায় অন্তর্ভুক্ত করলেন—গোটা বিষয়টাই এ কলমচির কাছে অবোধ্য। কিন্তু রাজ্য বিধানসভায় অনুমোদিত বাজেট প্রস্তাবে দেয় তথ্য আদালত গ্রাহ্য প্রামান্য সরকারি তথ্য হিসাবে স্বীকৃত। তাই রাজ্যে বর্তমান জনসংখ্যার ৮.৬% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন, অর্থাৎ গরিব মানুষ। সামাজিক প্রকল্পে কেন বিনিয়োগ করেন সরকার? সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে বা সরাসরি অর্থ সাহায্য করে বা কিছু সরকারি সুবিধা দিয়ে দারিদ্রসীমার উপরে তুলে এনে সমাজের মূল আর্থ-সামাজিক স্রোতে প্রবেশ করান। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে কেন্দ্র/রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিৎ সর্বপ্রথম গরিব মানুষের দারিদ্রমুক্তি। কেন্দ্র/রাজ্য সরকারের রাজকোষে অর্থসীমিত। সামাজিক খাতে সেই সীমিত অর্থের ব্যয় এমন ভাবে করতে হবে যাতে নির্বাচিত উপভোক্তারা গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষ হন। শুধুমাত্র গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য প্রকল্প ভিত্তিক সরকারি ব্যয় ‘সামাজিক খাতে সরকারি বিনিয়োগে। ধনী-নির্ধন-সকলের জন্য প্রকল্প-ভিত্তিক সরকারি ব্যয়, শব্দচয়নে যথেষ্ট সতর্ক থেকেই বলছি, ‘সামাজিক অপরাধ’। ধরুন সরকার সামাজিক খাতের নামে ১০০ টাকা খরচ করছে।

এই টাকাটা যদি পুরোটা গরিব মানুষই পান, তবে তা তাদের দারিদ্র মুক্তিকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু ১০০ টাকা যদি ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সবার মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়, তবে গরিব মানুষের ভাগে যে ছিটেফোঁটা জুটবে তাতে গরিব মানুষ কোনও দিনই দারিদ্রমুক্তির সুযোগ পাবেন না। একটি উদাহরণ দিই। রাজ্য সরকারের তথ্য: ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্নযোজনা’ এবং ‘রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা’র আওতাভুক্ত রেশনগ্রাহকদের জন্য কেরন্দ্রীয় সরকারযে খরচ বহন করে (Economic Cost) তা হল প্রতিকেজি চালের জন্য ৩৭ টাকা ৪৬ পয়সা এবং প্রতিকেজি গম/আটার জন্য ২৭ টাকার ৯ পয়সা। প্রথম যোজনার জন্য ডিলার-ডিস্ট্রিবিউটরদের কমিশন এবং রাজ্যের মধ্যে চালগম বন্টনের জন্য পরিবহণ খরচের অর্ধেক, দ্বিতীয় যোজনার ক্ষেত্রে এই খরচের পুরোটা রাজ্য সরকার বহন করে। অর্থাৎ কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে বিনামূল্যে/২ টাকা কিলোপ্রতি মূল্যে রেশন গ্রাহকদের চাল, গম/আটা দিতে বিপুল খরচ করে সরকারি রাজকোষ। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউ.পি.এ. সরকার খাদ্য সুরক্ষার অধিকার নামে আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় কেন্দ্র সরকার রাজ্যের ৬ কোটি ৩ লক্ষ মানুষকে বিনামূল্যে/কিলোপ্রতি ৩ টাকা মূল্যে চাল, গম/আটা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের ৬০% মানুষ এই সুবিধা পান। রাজ্য সরকার ‘রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনা’ নাম দিয়ে অতিরিক্ত ৩ কোটি মানুষকে এই সুবিধা দিচ্ছেন এবং কিলোপ্রতি ১ টাকা ভর্তুকি দিয়ে দামকে কিলোপ্রতি ২টাকা করেছেন। অর্থাৎ কেন্দ্র-রাজ্য মিলিয়ে রাজ্যের ৯ কোটি মানুষ এই সুবিধা পাচ্ছেন।

কেন্দ্র রাজ্যে ৯০% মানুষকে সরকারি অর্থে এই সুবিধা দেবেন সরকার? তাহলে রাজ্য সরকার কি মনে করেন রাজ্যের ৯০% মানুষ এতটাই দরিদ্র যে তাদের চলতি বাজার দরে চাল/গম কেনার মত আর্থিক সামর্থ্য নেই? পরিস্থিতি যদি তেমনই হয় তাহলে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সরকারি ভাবে ঘোষণা করুন, ‘পশ্চিমবঙ্গ একটি ভিখিরির রাজ্য’ অথচ এই সরকারই বলছেন রাজ্যের জনসংখ্যার মাত্র ৮.৬% মানুষ দরিদ্র। এই সরকারি নীতি, যে নীতিতে গরিব মানুষদের প্রাপ্যতার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধনী, উচ্চবিত্তদের বিলিয়ে দেওয়া হয়, তা শুধু গরিব বিরোধিই নয়, ‘সামাজিক ন্যায়’ এর নিরিখে ‘অপরাধ’। রাজ্য সরকারের প্রায় প্রতিটি তথাকথিত সামাজিক প্রকল্পে -উপভোক্তা নির্বাচনে কঠোরভাবে কোনও আর্থিক মাপকাঠি না রেখে যেভাবে নির্বাচনী ভোট ব্যাঙ্ক তৈরির রাজনৈতিক লক্ষ্যে, ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলকে সরকারি অর্থ বিলিয়ে খুশি করতে চাইছেন তাকে ‘রাজকোষের হরির লুঠ’ বলাই যায়। একই কারণে রাজ্যের ৯৮% মানুষকে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ নামে সপরিবারে বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার সুযোগ দেওয়াও সরকারি অর্থের হরির লুঠ। রাজ্যে হিসাবে বি.পি.এল ৮.৬%, কেন্দ্রের হিসাবে ২১.৭%। কেন্দ্রের তথ্যে মান্যতা দিয়ে যদি রাজ্যে ২১.৭% মানুষকেই স্বাস্থ্যসাথী সহ যে কোন সামাজিক প্রকল্পে উপভোক্তা হিসাবে নির্বাচন করতে হবে। সামাজিক খাতে বিনিয়োগের নামে সরকারি অর্থের রাজনৈতিক হরির লুঠের কারণেই আজ সামাজিক উন্নয়নের সর্ব ভারতীয় সূচকে পশ্চিমবঙ্গ ২৫ নম্বরে। গত ৩১.১২.২০২৩ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসাথী খাতে রাজ্য ৮১৬৮,১১,৮৯,৭৮৯ টাকা ব্যয় করেছে সরকার যার ৯২.২১% গেছে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে। তাই বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের সরকারি অর্থে ব্যবসা ও মুনাফা পাইয়ে দিতে এই সরকারি প্রকল্প চূড়ান্ত সফল। এই বিপুল সরকারি অর্থ সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ হলে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর প্রভূত উন্নয়ন হত।