• facebook
  • twitter
Saturday, 2 November, 2024

গাজার যুদ্ধে হারিয়ে যাচ্ছে একটা প্রজন্ম

এক বিপুল সংখ্যক যুবক জীবিকা হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্যালেস্টাইনের এই অভূতপূর্ব বিপর্যয় সবচেয়ে বড় করে দেখিয়েছে শিশু প্রজন্মের মৃত্যুকে। এই মৃত্যু সংকেত দিচ্ছে আগামী যুব সম্প্রদায়ের বিপর্যয়ের।

মহম্মদ শাহাবুদ্দিন

সভ্যতার ইতিহাসে গাজার যুদ্ধে সে দেশের মানুষ নজীর বিহীনভাবে একটা প্রজন্মকে হারাতে চলেছে। ক্ষেপনাস্ত্রের অবিরাম আঘাতে গাজার মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে মানুষের বসত, বাজার, হাসপাতাল, স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাসের নিদর্শন। ধ্বংসস্তূপের তলায় শুধু শবের পাহাড়। নারী পুরুষ শিশুর নিথর দেহ গুনে শেষ করা যায় না। গাজার ইউনাইটেড নেশন অফিস ফর দ্য কো-অডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের প্রতিদিনের বুলেটিনে উঠে আসছে যুদ্ধের ধ্বংস চিত্র। গত এক বছরে নিহত হয়েছেন ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ, যার মধ্যে শিশুর মৃত্যু হয়েছে ১৪ হাজারের বেশি। গুরুতর আহত হয়েছেন এক লক্ষ মানুষ। অগণিত মানুষের শবদেহ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলছেন গাজা এখন পরিণত হয়েছে বর্জ্যভূমিতে। মানুষের কোথাও সেখানে বসবাসের স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষকে ঘিরে ধরছে দুর্ভিক্ষ এবং অপুষ্টির সম্ভাবনা। কিছুদিন পরেই নেমে আসবে ডিসেম্বরের ভয়াবহ শীত। এখন গাজার উত্তরাঞ্চলে জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার অভিযানে চলেছে ইসরায়েলী আক্রমণের এক ভয়ঙ্কর পর্ব। আক্রমণ চলেছে শরণার্থী শিবিরেও। শরণার্থীতে ভরা জাবালিয়াতে চলেছে ক্ষেপনাস্ত্রের নির্মম আঘাত। বিধ্বস্ত সড়ক ধরে কোন ত্রাণ সামগ্রী শরণার্থীদের কাছে পৌঁছতে পারছে না। পৌছানো যাচ্ছে না জল, খাদ্য, ওষুধ। শুধু ধ্বংস স্তূপ আর মৃত্যু উপত্যকা থেকে শবদেহের গন্ধ। এমন অমানবিকতা দেখা যায় না, যেখানে মাইলের পর মাইল ছড়ানো শবদেহ সরানোর মানবিক সহায়তার কাজেও মিশনগুলোকে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

আমরা ইতিহাসে পড়েছি যুদ্ধবাজদের দম্ভ একদিন চূর্ণ হয়। কিন্তু আর কত শবদেহ মাড়িয়ে এগোলে আমরা সেই দিন পাব। হাজারো মানুষের মৃত্যু আর দীর্ঘশ্বাসে এখনও ভরে যাচ্ছে পৃথিবী। খাদ্য ও ক্ষুধা এখন যুদ্ধাস্ত্র হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ আর ক্ষুধা এখন এক সূত্রে গাঁথা। যুদ্ধ বাধলেই ক্ষুধার্ত মানুষের সারি দেখা যায়। পৃথিবীর সব বড় যুদ্ধেই এই ছবি ফুটে উঠেছে। যুদ্ধ আক্রান্ত গাজা পালেস্টাইন লেবাননেও তাই। ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়। গাজায় শিশু থেকে সবাই মিশে যাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে। বিশ্বযুদ্ধ আমাদের দেখিয়েছিল যুদ্ধ এবং ক্ষুধা কিভাবে একসাথে মিশে যায়। ৬০-এর দশকে আমরা দেখেছিলাম ভিয়েৎনামের বুকে মার্কিনী ন্যাপাম বোমা শস্য ক্ষেত্রের ফসল পুড়িয়ে সে দেশের মানুষকে অন্নহীন করতে চেয়েছিল। এ যুগের যুদ্ধেও খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যুদ্ধবাজরা এমনভাবে এগোচ্ছে, যেন ক্ষুধা অস্ত্রের পরিবর্ত হয়ে ওঠে। কারণ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, দুর্ভিক্ষ যত তীব্র হবে অস্ত্রের খরচ তত কমবে। মারণাস্ত্রের বদলে ক্ষুধা তৈরি করা এখন যুদ্ধের অন্যতম কৌশল। যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ আক্রান্ত দেশে দুর্ভিক্ষের কালো ছায় ক্রমশ ছেয়ে যাচ্ছে। ইথিওপিয়া, জিবিুতি, সোমালিয়া মিলিয়ে ২০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২১ লক্ষ প্যালেস্টাইনবাসী চরম খাদ্যাভাবে দিন কাটাচ্ছে। এইভাবে শুধু গাজা কেন সমগ্র প্যালেস্টাইনের শিশু ও তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ হারিয়ে যাচ্ছে।

গত ৭০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে এই যুদ্ধ এখন সবচেয়ে প্রাণঘাতী রূপ নিয়েছে। এক বছরের বেশি সময়ে এই যুদ্ধ গাজার অর্থনীতি সমাজকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। ২০০৭ সালে ফিলিস্তানের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। এরপর গাজায় নেমে আসে মিশর ও ইসরায়েলের অবরোধ। এই অবস্থা গাজার অর্থনীতিকে অনেকটা বিধ্বস্ত করে। এখনকার ধ্বংসযজ্ঞ প্যালেস্টাইনের অবকাঠামোকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। গত ২১ আগস্ট জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে ৩৫০ বছরেরও বেশি সময় লেগে যাবে। গাজার আকাশে সূর্যোদয়ের আলোকিত ভোরে ছেয়ে থাকে যুদ্ধের ধোঁয়া। শরণার্থী শিবিরে বসে শুধু বিভীষিকার সময় গোনা। শিবির জুড়ে স্তব্ধবাক আতঙ্কিত শিশুর দল বুঝতে পারে না তাদের আজন্ম লালিত নিরাপদ গৃহাঙ্গন কেন হারিয়ে গেল।

যুদ্ধ ক্লান্ত প্যালেস্টাইনে এক ধাক্কায় কয়েক মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে পৌঁছে গেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো উন্নয়নের সূচকগুলো পিছিয়ে গেছে প্রায় ৭০ বছর। দেশের অগ্রগতি নামতে নামতে এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে, যার পুনর্নির্মাণ কয়েক শতাব্দীর কাজ। এক বিপুল সংখ্যক যুবক জীবিকা হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। প্যালেস্টাইনের এই অভূতপূর্ব বিপর্যয় সবচেয়ে বড় করে দেখিয়েছে শিশু প্রজন্মের মৃত্যুকে। এই মৃত্যু সংকেত দিচ্ছে আগামী যুব সম্প্রদায়ের বিপর্যয়ের। আর কয়েক দশক পরে আমরা খুঁজে পাব কি যুদ্ধের আবহে বড় হয়ে ওঠা যুব প্রজন্মকে। যে শিশু জন্মাতেই দেখছে যুদ্ধ, শৈশব পার করে সেই যুদ্ধই হয়তো তাকে নিয়ে যাবে আগামী দিনে। তাদের কাছে যুদ্ধ কখনও অতীত হয় না। যুদ্ধ সেখানে কালও ছিল আজও আছে। যুদ্ধ তো ধ্বংস দিয়ে শুরু হয়, যুদ্ধ স্থির হলে তার বীজ তখনও মেরে চলে মানুষকে। যুদ্ধের আকাশের তলায় মানুষের জীবনও থেকে যায় মৃত্যুকে সাথে করে। শিশুকাল থেকে যুদ্ধ দেখতে দেখতে একদিন যৌবন আসে। শৈশবের ভগ্ন শহর দেখলে তখনও মনে হয় বসন্ত আসেনি। গাজায় প্রতিদিন শিশু জন্ম নিচ্ছে। মায়ের কোলে সেও হাসে। কিন্তু কেমন আছে এখন সেই মায়ের কোল, সেই মায়ের কোলের শিশুরা যে শিশু বেঁচে থাকবে, তারা আবার হেসে উঠবে তো?