• facebook
  • twitter
Friday, 1 November, 2024

মেঘ আর একজন বাতিল মানুষের গল্প

এ একজন মানুষের ‘এই আছি’ থেকে ‘হঠাৎ নেই’ হয়ে যাওয়ার গল্প, যার জন্য সমাজের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। তবু কী যেন এক মূক অনুভবকে উস্কে দিয়ে যায় ‘মানিকবাবুর মেঘ’। লিখছেন অবন্তী সিনহা।

‘মানিকবাবুর মেঘ’ সিনেমার একটি বিশেষ দৃশ্য।

নিছকই ছাপোষা তাঁর জীবনযাপন, এতটাই সাধারণ যে, প্রতিটি দিন যেন আগের দিনের রেপ্লিকা। আলাদা করে চোখে পড়ার মতো কিছুই নেই ‘মানিকবাবু’র জীবনে। শুধু ছাদে পরিত্যক্ত টেলিভশন সেটের মধ্যে লালিত চারাগাছগুলি ছাড়া। তাঁর প্রায় ধূষর হয়ে যাওয়া জীবনের একমাত্র সজীব ‘সবুজ’, ওই গাছগুলো। অবশ্য চারাগাছেরই শুধু নয়, তাঁর হাতে নিত্য খাবার পায় পাড়ার নেড়িকুকুর। পত্রশূন্য হয়ে যাওয়া একটি মৃতপ্রায় গাছেকেও তিনি জল দেন প্রাণ সঞ্চারের আশায়। আবার একই রকম মমতায় শুশ্রূষা করেন তাঁর জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ বাবার।

মধ্যবয়সে পৌঁছেও যাঁর সঞ্চয় বলতে কেবল কিছু পরিত্যক্ত জিনিস,বাবার মৃত্যু আলাদা করে আর কী শূন্যতা আনবে সেই রিক্ত মানুষটির জীবনে! যে-জিনিস কারও কাজে লাগে না, তিনিও যেন সেগুলিরই মতো বাতিলের দলে। কিন্তু সেই নির্বান্ধব মানিকবাবুর এ কী মতিভ্রম! তাঁর জীবনে আচানক এসে পড়ে এক টুকরো মেঘ। আর সেই মেঘের সঙ্গেই এরপর তৈরি হয় তাঁর ভেসে বেড়ানোর অলিখিত চুক্তি। কিছুই আঁকড়ানোর নেই- তাই শেষ অবধি সব পিছুটান, সমস্ত মায়া, কাটিয়ে ফেলতে থাকে মানুষটি। এভাবেই যেন গড়ে ওঠে মাটি আর আকাশের সখ্যতা, বাস্তব আর পরাবাস্তবের মিতালি।

এমনই একটা গল্প নিয়ে, প্রায় নিঃশব্দেই প্রেক্ষাগৃহে ১০০ দিন পার করে ফেলল অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘মানিকবাবুর মেঘ’। এডিনবার্গ চলচ্চিত্র উৎসব এবং কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-সহ, ৩৮টি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছে, ১৪টি পুরস্কার ও মনোনয়ন পেয়েছে এবং পাঁচটি মহাদেশে প্রিমিয়ার হয়েছে এই ছবির।

ছবির প্রয়োজক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘অভিনন্দনের জন্যই আমার বিজ্ঞাপনের জগৎ থেকে ফিল্মমেকার হওয়ার সূত্রপাত। সেটা ২০১৩-২০১৪ সালের কথা। আমার প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘তিনকাহন’ অভিনন্দন লেখে আমার সঙ্গে। সেই গ্র্যটিটিউড থেকেই আমার ওকে কথা দেওয়া ছিল, ও যদি কোনওদিন ফিচার বানায়, তাহলে আমরা সেটা প্রযোজনা করব। এই গল্পটা প্রথম শোনার পর মনে হয়েছিল, ছবিটা এতটাই অন্যরকম যে, আমরা ছাড়া আর কেউ এটা প্রোডিউস করবে না।’

এরকম একটা সাদা-কালো ছবি, সে অর্থে বিনোদনের কোনও উপাদান যাতে নেই, এমন আর্ট হাউস, স্লো ফিল্ম দর্শকদের ভালো লেগে গেল কেন? বৌদ্ধায়নের মতে, ‘বিভিন্ন মানুষ এই ছবির সঙ্গে কিছু না কিছু রিলেট করতে পেরেছেন এবং সেটা বিভিন্ন লেভেল-এ। কেউ নিজের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে, কেউ আবার বৃদ্ধ মা-বাবার কেয়ারগিভার হিসেবে, কেউ প্রকৃতিপ্রেমিক হিসেবে রিলেট করেছেন। অনেকে বলেছেন বাংলায় আন্তর্জাতিক সিনেমা হয় না, সেই দুঃখটা ভুলিয়ে দিল মানিকবাবুর মেঘ।’

বহুদিন পর এমন একটা চরিত্রে কেউ ব্যবহার করলেন অভিনেতা চন্দন সেনকে। এব্যাপারে চন্দনের বক্তব্য, ‘একজন অভিনেতার প্রাথমিক কাজ হল চরিত্র নির্মাণ। ‘মানিকবাবু’ ছবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি চ্যলেঞ্জ ছিল অনুচ্চারিত সংলাপের উচ্চারণ। বেশ একটা পরীক্ষা দেওয়ার অনুভূতি হল অনেকদিন বাদে! অবশ্য ‘মানিকবাবু’ হয়ে উঠতে আমায় সাহায্য করেছিল আমার এত দিনের অভিনয়ের শিক্ষা, বহু বিদগ্ধ মানুষের সংস্পর্শে আসা আর অবশ্যই ব্যক্তিগত জীবনে আমার প্রকৃতিপ্রেম।’

যে-নীরব মুহুর্তগুলোকে পর্দায় বাঙ্ময় করে তুলেছেন চন্দন, তার নেপথ্যে অভিনেতা হিসেবে কিছু সংযোজন তাঁরও ছিল। ‘মেঘের সঙ্গে সঙ্গমের দৃশ্যটা ছিল আমার ইমপ্রোভাইজেশন। এছাড়াও ছবিতে আমার নিজের কিছু পছন্দের মুহূর্তও আছে, যেমন মরা গাছটায় জল দেওয়ার পরে উপরে তাকিয়ে দেখা যে, কিছু পরিবর্তন হল কিনা। কিংবা ওই শেষের অংশটা, যখন সে অপেক্ষা করে আছে কখন মেঘের ডাক আসবে এবং অবশেষে সেই ডাক এল- এই মোমেন্টগুলো আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল,’ বললেন অভিনেতা।

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অসামান্য।  আসলে এ হল একটি মানুষের ‘এই আছি’ থেকে ‘হঠাৎ নেই’ হয়ে যাওয়ার গল্প, যার জন্য সমাজের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। আপনার, আমার, সবার জীবনেই হয়তো এমন একজন নজর এড়িয়ে যাওয়া ‘মানিকবাবু’ আছেন, যিনি কখন মানুষের পোশাক ছেড়ে মেঘের সঙ্গী হয়ে গেছেন- সে খবর সবার অগোচরেই থেকে যায়। শুধু ছবির ‘মানিকবাবু’ বেবাক হারিয়ে যাওয়ার আগে, বজ্রপাতের আলোয় শেষবারের মতো, বুকের বাঁদিকটায় কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা রেখে যান। সেই ব্যথা কিছুতেই যেন মিলিয়ে যেতে চায় না।