• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

তিনি সৃজনী শক্তি, মহামায়া, মহাকালী

'কালী' সংহারমূর্তি। কিন্তু এই সংহার, নিষ্ঠুর ধ্বংস নয়। এই সংহার, সংহরণ অর্থাৎ আপনার মধ্যে আকর্ষণ। সমুদ্রের তরঙ্গমালার উদ্ভব সমুদ্র থেকেই। আবার সেই তরঙ্গমালার লয়ও হয় সমুদ্র বক্ষে। সংহার তেমনই একটি ব্যাপার। এটি হলো তার নাশিনী শক্তি। আবার আদ্যাশক্তি বিশ্বপ্রসবকারিণী মায়ের উদর থেকেই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি।

হীরক কর

তন্ত্র শাস্ত্র অনুসারে ‘কালী’ দশমহাবিদ্যার প্রথম দেবী। কেরালা ব্যতীত সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে কালীকে ভগবান শিবের স্ত্রী পার্বতীর রূপ হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। কেরালার লোকবিশ্বাস অনুসারে,— ভগবান শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে রাক্ষসদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আবির্ভূতা হন। তাই কেরালায় তাঁকে ভৈরবোপত্নী ‘মহাকালী’ বলা হয়।
‘কালী’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘কাল’ থেকে এসেছে। যা একই সাথে সময় এবং কালোতাকে বোঝায়। সম্মিলিত তাৎপর্য তাকে গভীর ধারণার মূর্ত প্রতীক হিসেবে নির্দেশ করে। এর মধ্যে রয়েছে জীবনের অ্যানিমিস্টিক নৃত্য এবং সময়ের অসীম চক্র যা মহাজাগতিক শূন্যতার গর্ভে বিস্তৃত। প্রাক-বৈদিক এবং অ-বৈদিক আদিবাসী দেবতাদের সাথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কারণে মূলধারার হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মতত্ত্বগুলোতে কালীর উৎপত্তি চিত্রিত। ‘কালী’ নামটি আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত ‘মুন্ডক উপনিষদে’ অগ্নি দেবতা। কালীর অন্যান্য নমুনাগুলো ঋগ্বেদে ‘রাত্রি দেবী’, অথবা ‘নিশাচর দেবী’। এবং ঋগ্বেদ এবং অথর্ববেদে ‘নিরীতি’ বা ‘দানব’ রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
পরবর্তীকালে, আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দে মহাভারতের তিনটি মূল অনুচ্ছেদে ‘কালী’র উল্লেখ রয়েছে। সৌপ্তিক পর্ব অষ্টম, বিরাট পর্ব ষষ্ঠ এবং ভীষ্ম পর্বে। যে পাঠ্যক্রমে কালী হিন্দু ধর্মাবলম্বীতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রামাণিক মর্যাদা অর্জন করেছিলেন তা হল দেবী মাহাত্ম্য (৫০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ)। এটি মার্কন্ডেয় পুরাণে যুক্ত করা হয়েছিল; যা ৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে লেখা হয়েছিল।
দেবী মাহাত্ম্য হিন্দুধর্মের ‘মহান ঐতিহ্য’-এ দেবীকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এর তৃতীয় পর্বে, কালী কপাল থেকে দুর্গার রূপ রূপে আবির্ভূত হন এবং চামুণ্ডার আধিপত্য অর্জন করে চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ, শুম্ভ ও নিশুম্ভ রাক্ষসদের বধ করেন।
এই মারাত্মক ধ্বংসাত্মক রূপটি অর্জন করে, কালী বা চামুন্ডা একটি ভয়ঙ্কর বিজয় নৃত্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এটি শিবের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে শেষ হয়। শিবের সহধর্মিণী। শিব, যিনি তাঁর পথে শুয়ে আছেন, তাকে তাঁর বুকে পা রাখার জন্য টানছেন, যেখানে তিনি একটি বিব্রত ভঙ্গিতে থামেন, তার জিহ্বা প্রসারিত করে দুঃখের চিহ্ন হিসাবে। এই রূপটি পরবর্তীকালে কালীর মূর্তিতত্ত্বে সর্বাধিক বিখ্যাত হয়ে ওঠে। তাঁর আদিম চেহারা, — যার ভক্তিতে রামপ্রসাদের হৃদয় শ্মশানে পরিণত হয়েছিল, কমলাকান্ত আরামে পাগল বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছিল, এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসকে ঐশ্বরিক নেশায় পেয়েছিল।
পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী ,গ্রহ কালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে মা কালীর আবার নব রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কাল কালী, কঙ্কাল কালী, চিকা কালী এমন সব রূপের পরিচয়ও পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী, আনন্দময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা করতে দেখা যায়।
শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক কারণ।পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই দৈত্য পৃথিবীজুড়ে তাদের ভয়ংকর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন, তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন। সেই দেবীই হচ্ছেন ‘কালী’।
কালীর উন্মাদ নৃত্যে স্বর্গে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। দেবতারা আবার গেলেন মহাদেবের কাছে। কারণ, কালীর নৃত্যে সৃষ্টি–স্থিতি ধ্বংস হওয়ার মুখে। মহাদেব নিজেই ছুটলেন কালীর নৃত্য বন্ধ করতে। কিন্তু মহাদেবের হাজারো কথাও শুনতে পেলেন না উন্মাদিনী ‘কালী’। উপায়ান্তর না দেখে মহাদেব এবার কালীর পায়ের তলায় নিজেকে ছুড়ে ফেলে দেন। পায়ের নিচে স্বামীকে পড়ে থাকতে দেখে লজ্জিত হন কালী। লজ্জায় জিব কাটেন তিনি। পৌরাণিক এই কাহিনি অবলম্বনে পূজিত হয়ে আসছেন কালী। তাই কালী রূপ মানেই তাঁর নগ্ন রূপ, আর অসুরদের ধরহীন মুণ্ডর কোমরবন্ধনী ও মালার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের তলায় শিব।
ভারতে কালীপুজোর উত্‍পত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানান তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সকল তথ্য কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা কিন্তু বলা খুব মুশকিল। অতীত ঘাঁটলে তার উত্‍পত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। কালী মায়ের রূপের বর্ণনা আমরা সাধারণত কালীর যে রূপের দর্শন পাই, তিনি চতুর্ভূজা অর্থাৎ তার চারটি হাতযুক্ত মূর্তি। খড়গ, অন্যটিতে অসুর মুণ্ড অন্য হাতগুলোতে তিনি বর এবং অভয় প্রদান করেন। গলায় নরমুণ্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং রক্তবর্ণ জিভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে। এছাড়াও তিনি এলোকেশি।
বিভিন্ন পুরাণ থেকে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ হল কালী। প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘কালী’ একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে কালীর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করেন যিনি, সেই তিনিই কাল রাত্রি ‘কালী’ নামে পরিচিত।
সপ্তদশ শতকে নদীয়ার নবদ্বীপে সম্ভবত ১৬০০ থেকে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দ কালীন সময়ে একজন মহান সাধকের জন্ম হয় যার নাম ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগম বাগীশ । বাংলা তথা ভারতের তখনো দেবী কালীকে অতি উগ্র স্বভাবা দেবী হিসেবে কোন গৃহে তাকে পূজা করা হতো না। তাঁর কোন সাকার রূপ তৈরি হয়নি, দেবীর পূজা হতো যন্ত্রমে, শিলা খন্ডে, গহর অরণ্যে, গ্রামের মোড়ে, কিংবা কোন নদী উপকূলে। তখনো দেবী কালী ঘরের মেয়ে হয়ে উঠতে পারেনি বাংলার। এই কাহিনীটা তন্ত্রের সেই উগ্র দেবীকালী থেকে বাংলার ঘরের মেয়ে হয়ে ওঠার কাহিনী।
মহা সাধক কৃষ্ণানন্দ চেয়েছিলেন, দেবীকে নিরাকার থেকে আকার দিতে। কিন্তু উনি বুঝে উঠতে পারছিলেন মাতৃমূর্তির রূপ কিরকম হতে পারে, যতদিন গড়াচ্ছিল সাধক শুধুমাত্র মায়ের রূপ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠছিল। সারাদিন রাত ধরে শুধু মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা মা আমি তোমাকে সাকারে চাই। তোমার রূপ দর্শন করতে চাই।
সন্তানের আকুতি মা ফেলতে পারলেন না। কোন এক রাতে অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় দৈব বাণী হলো, মহানিশা। কৃষ্ণানন্দ বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন। তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে সাধনা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, কৃষ্ণানন্দ বাবু কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের কারণে কালীপূজা বাঙালিদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়েছে।
দুর্গাপূজার পরবর্তী অমাবস্যাতে ‘দীপান্বিতা কালী পূজা’ করা হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে ‘রটন্তি কালীপূজা’ এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ‘ফলহারিণী কালীপূজা’ ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত করা হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায়, এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ পিঠে প্রতিদিন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মা কালী পূজার প্রচলন দেখা যায়।
মা কালীর উত্পত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন । তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা ‘কৌশিকী’ নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। দেবী কৌশিকী মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত হলে কালো বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়। কালী পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি। তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রে অর্থাৎ অমাবস্যার রাত্রে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পূজা করা হয়। আগেকার দিনে, দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উত্সর্গ করা হয়। এছাড়াও প্রসাদ হিসেবে লুচি এবং নানা ফল ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পুজা দেখা যায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগ বা মহিষ ছাগল বা মহিষ বলি দেওয়া হত এবং বর্তমানেও অনেক জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পূজার প্রচলন দেখা যায়। পুরাকালে বা প্রাচীন সময়ে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালী পূজা করত বলে শোনা যায়।
শক্তির দেবী হিসেবে শ্যামা বা কালীমূর্তির আরাধনা করেন শাক্ত বাঙালিরা। হিন্দু শাস্ত্রে বলা রয়েছে, তন্ত্র মতে যে সব দেব-দেবীদের পূজো করা হয়, তাঁদের মধ্যে কালী পুজো অন্যতম। বলা হয়, যাঁরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান, তাঁরা তন্ত্র-মন্ত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী। মানুষরূপী ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলে নিষ্ঠা সহকারে কালী পুজো করে থাকেন । শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক কারণ। ভারতে কালীপুজোর উত্‍পত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানান তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সকল তথ্য কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা কিন্তু বলা খুব মুশকিল। অতীত ঘাঁটলে তার উত্‍পত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য আমরা পেয়ে থাকি।
আসলে তিনি যেকোনো বর্ণের অতীত। আর কালো রং সব বর্ণের অনুপস্থিতির প্রতীক। কখনো দেবীকে গাঢ় নীল বর্ণেও কল্পনা করা হয়। তিনি গাঢ় নীল আকাশের মতোই অসীম। তাঁর নীল গাত্রবর্ণ সেই গগণসম অসীমতার ইঙ্গিতবাহী।
কালীর তিনটি নয়ন বা চোখ। এই ত্রিনয়ন চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নির মতো অন্ধকার বিনাশকারী। এই ত্রিনয়নের মাধ্যমে দেবী যেমন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দর্শন করে থাকেন, তেমনই প্রত্যক্ষ করেন সত্য, শিব ও সুন্দরকে; অর্থাৎ বৃহত্তর অর্থে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়কে। তিনি বিশ্বব্যাপী শক্তির প্রতীক। তিনি অসীম। এই চিরশক্তিকে আবৃত করে এমন সাধ্য কোন বস্ত্রের রয়েছে! দেবী তাই দিগম্বরী।
কালীপূজার সঙ্গে পাঁঠা বলির কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এক শ্রেণির মত অনুযায়ী, তমোগুণসম্পন্ন (তমো শব্দের অর্থ হলো অন্ধকার এবং তম থেকেই তামসিক শব্দের উৎপত্তি) মানুষদের জন্য বলি প্রথা, যার বিধান হলো অমাবস্যার গভীর রাতে মহামায়ার উগ্ররূপা কালী প্রতিমার সামনে পাঁঠা বলি দিয়ে তার মাংস ভক্ষণ করা হয়। শাস্ত্রের এই বিধান মাংসাহার নিয়ন্ত্রণের জন্যই। তবে কালীপূজার সঙ্গে পাঁঠা বলি, পটকা ফোটানো আর সুরা পানের কোনো শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নেই। ভোজনবিলাসী, আওয়াজসর্বস্ব সুরা পিয়াসীরা নিজ গরজে এমন প্রথা চালু করেছেন বলে মনে হয়।
লাল রং শক্তি ও শৌর্যের প্রতীক। মা কালী স্বয়ং শক্তির রূপ, তাই তাঁকে শক্তিরূপিণী দেবীও বলা হয়ে থাকে। তাই কালীপূজা জবা ফুল ছাড়া হয় না। সারা পৃথিবীই এই শক্তির উপাসনা করে ‘শক্তপ্রাপ্ত’ হয়েছে!
ভারতীয় উপমহাদেশে পূজিত, কালী তার হিংস্রতা এবং ভয়ঙ্করতার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে স্বীকৃত হয়। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে পূজা করা হয়; — বাংলা, আসাম, নেপাল, ওড়িশা, দক্ষিণ ভারত, উত্তর প্রদেশ এবং রাজস্থান; — কালী হিন্দু সমাজের সমস্ত স্তরে এবং তার বাইরেও তার বহুত্বের জন্য বিখ্যাত। এমনকি মুসলিম সুফি সাধকদের সাথে যুক্ত কালীকে উত্সর্গীকৃত পবিত্র স্থানগুলো রয়েছে, যেমন পাভাগড়ে সাদন শাহ এবং ইটাওয়াতে সৈয়দ বাবার মাজার। যদিও শাক্ত উপাসনার পুরানো ঐতিহ্যের জায়গায় কালী উপাসনা বোধগম্য। দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু অংশ-সাধারণত শৈব চর্চার প্রতি বেশি অনুগত বলে মনে করা হয়। তাঁদের প্যান্থিয়নেও কালীর মূর্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেরালার ‘ভগবতী’ এবং কর্ণাটকের ‘ইয়েল্লাম্মা’ তাঁদের কিছু বৈশিষ্ট্যে কালীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
নগ্ন তামিল যুদ্ধের দেবী, কোরাভাই এবং শ্মশানের দেবী
চামুন্ডা, কালীর সাথে অনেকগুলো দিকও ভাগ করে নেন। কেরালার শাক্ত ঐতিহ্যে আছে যে কালী বা ভদ্রকালী শিবের তৃতীয় নয়ন থেকে আবির্ভূত হয়েছিল রাক্ষস, দারিকাকে বধ করার জন্য। এছাড়াও, আদ্য কালী, মাতঙ্গী কালী (চন্ডালিনী), ছিন্নমস্তা (প্রচণ্ড চন্ডিকা), শ্মশান কালী, বগালা কালী, দক্ষিণা কালী, ভৈরবী কালী, তারা কালী, (মহাযান বৌদ্ধধর্মেও পূজিত) কমলা কালী, এবং ধূমাবতী কালী। সহ সারা ভারতে দশটি প্রধান রূপে কালীর পূজা করা হয়। ধূমাবতী কালী, যিনি একমাত্র বিধবা হিন্দু দেবতা।
দীপাবলির রাতে পালিত কালী পূজা, ‘দীপান্নিতা কালী পূজা’ নামেও পরিচিত। বলা যেতে পারে এই সময়কালেই এর উদ্ভব হয়েছিল। আগমবগীশ এবং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময়কালের মধ্যে, কালী উপাসনা ডাকাতির সাথেও যুক্ত ছিল, যা গোঁড়া হিন্দুধর্মের শিকড়কে বহিরাগত সম্প্রদায় এবং রহস্যময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনুশীলনের সাথে যুক্ত করে।
মধ্যযুগের শেষের দিক থেকে বাংলার বেশ কিছু পুরানো কালী মন্দির ডাকাতদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। এই সত্যের সাথে কালীর গভীরতা আরও তীব্র হয়। কখনও কখনও দাবি করা হয় যে এই ডাকাত মন্দির বা কালী উপাসনার ঐতিহ্যগুলো ১৬৯০ সালে কলকাতার নির্মাণের পূর্বে । ১৭৫৭ সালে
পলাশীর যুদ্ধের সময় কলকাতার চিত্রেশ্বর ডাকাতের চিত্রেশ্বরীর পূজা। একটি তান্ত্রিক দেবতা যা তিনি নিজের নামে নামকরণ করেছিলেন। উনিশ শতকে মনোহর ডাকাতের কালী পূজা সর্বজনবিদিত। আছে রঘু ডাকাত-এর উপাখ্যান, যিনি হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় কালী পূজার পাঁচশত বছরের পুরনো ঐতিহ্য শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু সেই একই উপাখ্যান রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি রামপ্রসাদকে ঘিরে। যিনি রঘুর হাতে ধরা পড়েছিলেন। ডাকাতদের দল তাঁকে মায়ের সামনে বলির জন্য উপস্থিত করেছিল। কথিত আছে যে রামপ্রসাদ রঘুকে মায়ের উদ্দেশ্যে একটি শেষ স্তোত্র গাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। যা শুনে ডাকাত আত্মসমর্পণ করেছিল। গানটির পরে, রঘু মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন, যা তাকে রামপ্রসাদের একজন শিষ্য হিসাবে রূপান্তরিত করেছিল। রঘুর ধর্মান্তরের গল্পটি স্বামী বিবেকানন্দের ‘কালী মাদার’ কবিতার পটভূমিতে পড়ার প্রস্তাব দেয়। ‘কারণ আতঙ্ক তোমার নাম/মৃত্যু তোমার নিঃশ্বাসে/ তুমি “সময়”, সর্বনাশকারী!/ এসো, হে মা, এসো! যিনি দুঃখকে ভালবাসার সাহস করেন/ এবং মৃত্যুর রূপকে আলিঙ্গন করেন/ তাঁর কাছে মা আসেন,’ লিখেছেন স্বামীজি। রামকৃষ্ণ পরমহংস যখন একজন যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্তকে দক্ষিণেশ্বরে তার সমস্ত রহস্যময় গৌরব অনুভব করতে সাহায্য করেছিলেন তখন স্বামীজি যে আতঙ্কের কথা স্মরণ করেছিলেন তা অবশ্যই সেই মহৎ ‘সন্ত্রাসের’ অনুরূপ ছিল।
আশ্চর্যজনকভাবে, কালী হলেন ভগবদ গীতার নীতিগুলোর একটি তান্ত্রিক মূর্তি। তিনি একজনের অভ্যন্তরীণ রাক্ষস এবং বাহ্যিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিভাবক দেবতা যা তাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এটি ধর্মতাত্ত্বিকদের প্রতিবাদের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যেহেতু হিন্দু ধর্মাবলম্বীতে কালীর আবির্ভাব বিলম্বিত, এবং গীতার লেখকত্বের পরে তার প্রত্নতত্ত্বের বিকাশ উল্লেখযোগ্যভাবে ঘটে। রামকৃষ্ণ যিনি প্রায়শই রামপ্রসাদ এবং কমলকান্তের গান গাইতেন। কালীর প্রতি তাঁর ভক্তিতে কার্যত বলিদান জীবন যাপন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গল্পের বিভিন্ন অংশে, বলা হয়েছে যে রামকৃষ্ণ মনে করতেন যে ‘গীতার’ অর্থ সেই শব্দের বিপরীতে রয়েছে –
‘ত্যা-গী’, অর্থ উৎসর্গ বা বলিদানকারী। রামকৃষ্ণের কালী উপাসনার রূপে কৃষ্ণ বা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পরিচয় দক্ষিণেশ্বর বৃত্তে কুখ্যাত হয়ে ওঠে। যা তাঁকে স্থানীয় বৈষ্ণব ও শৈবদের ক্রোধ এবং পরে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনে সাহায্য করে।
বিবেকানন্দের শিষ্য, ভগিনী নিবেদিতা, ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে কালীর মূর্তি উন্নত করতে সাহায্য করেছিলেন। ঔপনিবেশিক বিপ্লবীদের দ্বারা বাংলায় কালী পূজার প্রথম দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে একটি ১৯০০ সালের দিকে জানা যায়। যখন নদীয়ায়, বোম্বেটে বা জলদস্যু নামে একটি দল শহরের প্রথম সর্বজনীন বা সম্প্রদায় কালী পূজা শুরু করেছিল।
১৯০৫ সালের মহালয়ার দিন, ভাইসরয় লর্ড কার্জন যে বছর বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেছিলেন, হাজার হাজার কালী ভক্ত কলকাতার কালীঘাটে মন্দিরে ভিড় করেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের জন্য অবিরাম শপথ নিয়েছিলেন। দুই বছর পরে, কালীর ছবি স্বদেশী কালী সিগারেটের একটি বিজ্ঞাপনে কলকাতা আর্টস স্টুডিও দ্বারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা ব্রিটিশ সরকারকে ক্ষুব্ধ করেছিল। নকশাল আন্দোলনের সময়ও কালী উপাসনা অব্যাহত থাকে।
এমনকি এটা বলা যায় যে ‘কালী’ একটি অত্যন্ত পরিশীলিত প্রতীকী বাগধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। যার অর্থ আমাদের মৌলিক, অহংকারী এবং বস্তুবাদী কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা। যেমন স্যার জন উড্রফ দ্বারা অনুবাদিত অষ্টাদশ শতাব্দীর মহানির্বাণ তন্ত্র ঘোষণা করেছে: ‘যেমন সমস্ত রঙ কালোতে অদৃশ্য হয়ে যায়, তেমনি তার মধ্যে সমস্ত নাম ও রূপ অদৃশ্য হয়ে যায়।’
‘কালী’ সংহারমূর্তি। কিন্তু এই সংহার, নিষ্ঠুর ধ্বংস নয়। এই সংহার, সংহরণ অর্থাৎ আপনার মধ্যে আকর্ষণ। সমুদ্রের তরঙ্গমালার উদ্ভব সমুদ্র থেকেই। আবার সেই তরঙ্গমালার লয়ও হয় সমুদ্র বক্ষে। সংহার তেমনই একটি ব্যাপার। এটি হলো তার নাশিনী শক্তি। আবার আদ্যাশক্তি বিশ্বপ্রসবকারিণী মায়ের উদর থেকেই জগৎ প্রপঞ্চের সৃষ্টি। তখন তিনি সৃজনী শক্তি। মহামায়া। মহাকালী।