• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 October, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

রাত্রি থাকিতে থাকিতে উঠিয়া পড়িলাম। দেখি যে, হৃদয় কাঁপিতেছে, বুক জোরে ধড্ ধড্ করিতেছে। আমার শরীরের এমন অবস্থা পূর্ব্বে কখনই ঘটে নাই।

রাত্রি থাকিতে থাকিতে উঠিয়া পড়িলাম। দেখি যে, হৃদয় কাঁপিতেছে, বুক জোরে ধড্ ধড্ করিতেছে। আমার শরীরের এমন অবস্থা পূর্ব্বে কখনই ঘটে নাই। ভয় হইল, কোনরূপ সাংঘাতিক পীড়াই বা আমার হইল? বেড়াইতে গেলে যদি ভাল হয়, এই মনে করিয়া বেড়াইতে বাহিল হইলাম। অনেকটা পথ বেড়াইয়া সূর্য্য উদয় হইলে বাসাতে আসিলাম; তাহাতেও আমার বুকের ধড়্ধড়ানি গেল না। তখন কিশোরীকে ডাকিলাম, এবং বলিলাম, ‘কিশোরী? আমার সিমলাতে থাকা হইবে না; ঝাপান ঠিক কর’ এই কথা বলিতে বলিতে দেখি যে, আমার হৃৎকম্প কমিয়া যাইতেছে। তবে এই কি আমার ঔষধ হইল? আমি সেই সমস্ত দিনই বাড়ী যাইবার জন্য স্বয়ং উদ্যোগী হইয়া উপযুক্ত ব্যবস্থা ও বন্দোবস্ত করিতে লাগিলাম; ইহাতেই আমি আরাম পাইলাম। দেখি যে, আমার হৃদয়ের সে ধরধরানি আর নাই, সব ভাল হইয়া গিয়াছে। ঈশ্বরের আদেশ, বাড়ীতে ফিরিয়া যাওয়া; সে আদেশের বিরুদ্ধে কি মানুষের ইচ্ছা টিকিতে পারে? সে আদেশের বাহিরে একটু ই্চছা করিতে গিয়া প্রকৃতিশুদ্ধ বিরুদ্ধে দাঁড়াইল, এমনি তাঁহার হুকুম! ‘হুকমেঁ অন্দর্ সব কোই, বাহর-হুকম্ ন কোই।’ আর কি আমি সিমলাতে থাকিতে পারি? প্রকৃতিরা তখন আমাকে বলিতেছে, ‘এই দুই বৎঞসর ধরিয়া আমাদিগকে কত কষ্ট দিলে। কত সাধ্য সাধনা করিলাম, আমাদের একটি নির্দ্দেষ প্রবৃত্তিকেও পরিতোষ করিলে না; এখন আমরা দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছি, আর তোমার শুশ্রূষা করিতে পারি না।’ প্রকৃতিরা দুর্ব্বল হউক, আর সবলই হউক, আর কি আমি সিমলাতে থাকিতে পারি? তাঁহার ইচ্ছাতেই আমার কার্য্য। তাঁহার ইচ্ছার সহিত আমার ইচ্ছা মিশায়িা বাড়ী আসিবার জন্য প্রস্তুত হইলাম। আমার মনে বল আইল। এখনো পথে অনেক ভয় আছে, স্থানে স্থানে এখনো অনেক বিদ্রোহী দল রহিয়াছে; কিন্তু আমি আর সে সকল ভাবনাকে মনে স্থান দিলাম না। নদী যেমন আপনার বেগমুখে প্রস্তরের বাধা মানে না, আমিও তেমনি আর কোন বাধা মানিলাম না।
১লা কার্ত্তিক বিজয়া দশমী, সিমলার বাজারে সদর রাস্তায় আমার ঝাঁপান দোলা ও ঘোড়া সকলই প্রস্তুত। আমার চারিদেক আমার স্বদেশীয় বন্ধুরা অতি দুঃখের সহিত আমাকে বিদায় দিলেন। আমি সকলের নিকট হইতে বিদায় লইয়া ঝাঁপানে চড়িয়া প্রস্থান করিলাম। বিজয়া দশমীতে আমার সিমলা হইতে বিসর্জ্জন হইল।
পাহাড়ের পথে নামিতে বড় সহজ। শীঘ্রই পর্ব্বতের পাদদেশ কালকাতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। রাত্রি যাপন করিয়া প্রভাতে শোভাময় সূর্য্যেদয় দেখিলাম, তাহার সঙ্গে আমার মনও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। কালকা ছাড়াইয়া পঞ্জৌরে আইলাম। এখানে একটা বাগানে বড় সমারোহ দেখিলাম। বাগানের শত শত ফোয়ারা সব খুলিয়া দিয়াছে, তাহারা আজ নবজীবন পাইয়া উল্লাসে জল উদগিরণ করিয়া অনবরত জলধারায় বর্ষা ঋতুর অনুকরণ করিতেছে। ফোয়ারার এমন শোভা পূর্ব্বে আমি কোথাও দেখি নাই। (ক্রমশ)