• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

আগেকার কলকাতার কালীপুজো ও সম্বন্ধ

শবদেহ রূপে আসতে হবে মায়ের কাছে, নামাতে হবে, এরপর ‘বল হরি বলে চিতাতে বা চুল্লিতে চাপাতে হবে’। আগুনরূপে মা-কালী ওই শবদেহকে পঞ্চভূতে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম) লীন করে করে মার চারণে আশ্রয় দেন।

শ্রীধর মিত্র

‘কাল’ শুধু ইহকাল নয়, পরকালেও তিনি ঠাঁই দেন ভক্তদের। আর কলকাতা, কথায় আছে— ‘বোমকালী কলক্কাতাওয়ালী’। আর কে না জানে, কালীক্ষেত্র বা কালীশেষ্ঠা থেকেই কলকাতা নামের উৎপত্তি। যদিও এর সত্যতা নিয়ে নানান মতামত প্রচলিত আছে।
সেকালের কলকাতার কালীপুজো কীরকম ছিল? তার একচিলতে দেখা যাক।

বর্তমান সার্বজনীন বা বারোয়ারি পুজোর ব্যাপক প্রচলন চোখে পড়ছে। সেকালে কিন্তু মহল্লায়-পাড়ায় দু’পা অন্তর কালীপুজোর রেওয়াজ ছিল না। ১৫৫৭ সালে কলকাতার সুতানুটি গ্রামে রাজা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। কলকাতার কালীঘাটে মহানিশা উৎসবের প্রাধান্য ছিল বেশি।
ওই সময়ের বিত্তবান ব্যক্তিরা মহা ধুমধাম সহকারে এখানে পুজো দিতেন। ১৭৩০ সালে ‘কালো জমিদার’ নামে স্বনামধন্য গোবিন্দ মিত্র তাঁর কালীমূর্তি ‘সিদ্ধেশ্বরী’ দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কথিত আছে ওই মন্দিরের উচ্চতা ছিল বর্তমানে ধর্মতলার শহিদ মিনারে মনুমেন্টের চেয়ে উঁচু। ১৮২০ সালে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে চূড়ার বেশ খানিকটা অংশ বিশেষভাবে ভেঙে গিয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন দেওয়ান ছিলেন এই গোবিন্দ মিত্র মহাশয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরটিকে জনসাধারণ বলত— গোবিন্দ মিত্রের ‘প্যাগোডা’।

ওই সময় কালীপুজো-দেওয়ালির সময় রাতে আকাশে রঙবেরঙের রকমারি ফানুস ওড়ানোর রেওয়াজ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় আতসবাজির প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল। বিশেষত বসন তুবড়ির প্রতিযোগিতা হত। সে এক এলাহি ব্যাপার। তা চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করার জন্য হাজার হাজার মানুষের সমাগম হত।

দক্ষিণা কালীর প্রভাব-বৈচিত্র্য—কালী নিয়ে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, জাহ্নবী চক্রবর্তী প্রমুখ পণ্ডিতজনরা এ বিষয়ে নানান আলোকপাত করেছেন। তবে সম্প্রতি ড. দেবীপ্রসাদ গোস্বামী সহজ-সরল ভাষায়, যা ব্যাপ্ত করেছেন, তা প্রাণিধানযোগ্য। এখানে তার সংক্ষিপ্ত সারবত্তার অংশবিশেষ তুলে ধরার চেষ্টা করছি— মা কালীই আদি মহাশক্তি। তিনিই সৃষ্টি রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ও নামে আমাদের সম্মুখে দেখা দেন এবং দুষ্টের দমন ও সাধুদের রক্ষা করেন। তাঁর হাজার আর্ট না তো সকলের জানা আছে। এছাড়া মা তাঁর ভক্তদের যে স্থানে দেখা দিয়েছেন, সেই স্থানের নামেও প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন। যথা— ঘটকালী, ঝুপোকালী ইত্যাদি। এই রকম বহুনামে বহু ধামে মায়ের পুজো হয়ে আসছে। এছাড়াও নিত্যকালী, রটন্তীকালী, ফলহারিণী কালীর পুজো হয়ে আসছে। তবে সব পুজোই দক্ষিণাকালীর ধ্যানে। এছাড়াও ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, নিশাকালী নামেও তিনি পূজিত হন।

মায়ের দক্ষিণ পা শিবের বুকে থাকে, তাঁর ডান পা কিছুটা পেছনে। তিনি বামাকালী নামে প্রসিদ্ধ। স্থান-কাল-পাত্র বা রূপ অনুসারে তিনি আলাদা আলাদা ফল দেন। যথা রক্ষাকালী রূপে ভক্তদের রক্ষা করে থাকেন। বিশেষত মহামারী, কলেরা প্রভৃতি অসুখে। রটন্তী কালীরূপে তিনি পুজো নেন ও সর্বত্র তিনি রটিয়ে দেন, এই ব্যক্তি আমার ভক্ত আমাকে মা বলে ডেকেছে, ডাকছেন। অতএব এর ওপর আর কারও খবরদারি করার কোনও অধিকার থাকে না। ওই ভক্তই মৃত্যুর পর মায়ের পদতলে ঠাঁই পাবে। ফলহারিণী কালীরূপে তিনি ভক্তদের পুজো নেন। ভক্তদের কুফল তিনি হরণ করে, সুফল ভক্তদের উপহার দেন আশীর্বাদ রূপে। গুহ্য মানে গোপন। যে সমস্ত সাধক একান্তভাবে নিজে খুব গোপনে মায়ের পুজো করেন, তাকে গুহ্যকালী বলা হয়। নিশিকালী ও অনেকটা গুহকোলীর মতন। আর শ্মশান কালীর ব্যাপারটাই পৃথক। মা ওখানে ভূতনাথের সঙ্গে আছেন। ভক্তই হোক বা অভক্তই হোন, সবাইকে শ্মশানে একবার না একবার আসতেই হবে, তা আগে অথবা পরে।

শবদেহ রূপে আসতে হবে মায়ের কাছে, নামাতে হবে, এরপর ‘বল হরি বলে চিতাতে বা চুল্লিতে চাপাতে হবে’। আগুনরূপে মা-কালী ওই শবদেহকে পঞ্চভূতে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম) লীন করে করে মার চারণে আশ্রয় দেন। সে সাধনা করুক বা না করুক। পঞ্চভূতে দেহলীন করেন বলেই শিব এখানে ভূতনাথ। যাঁরা দাহ করতে যান, তাঁদের মধ্যে কারও কারও বৈরাগ্যভাব আসে— মনে হয় কে কার? সন্তান-পিতা-মাতা-স্ত্রী— সবই মায়া। প্রত্যেককেই শ্মশানে আসতে হবে। কাজেই মায়া বাড়িয়ে লাভটা কী? ইত্যাদি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দাহ করে গঙ্গায় স্নান সেরে, মুখে নিমাতা চিবিয়ে, আগুনকে স্পর্শ করে, লোহা স্পর্শ করে ডাল-মিষ্টি খেয়ে বাড়িতে ঢুকলেও আবার যে কে সেই বৈরাগ্যভাব তখন উধাও হয়ে যায়। শ্মশানে থাকা অবস্থায় ওই বৈরাগ্য বলেই শ্মশান বৈরাগ্য বলা হয়।

কোনও বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পরিশ্রম (পূজা-পাঠ-বিবাহ-অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ-উপনয়ন ইত্যাদি) অনুষ্ঠান করলে যে পারিশ্রমিক বা দক্ষিণা পান তাঁকে দক্ষিণা বলা হয়। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির, শ্রেষ্ঠ কাজের প্রাপ্তি ‘দক্ষিণা’ মা যে রূপে পুজো পাওয়ার পর দক্ষিণা দেন, তিনিই দক্ষিণাকালী। দাক্ষিণ্যের অপর নাম দয়া। একসঙ্গে বলা হয়— দয়াদক্ষিণা।

পণ্ডিত মশাইরা যেমন করেই পূজা করেন, সব ঠিক বা ভুল, দক্ষিণা তাঁরা পাবেনই— তা কমই হোক বা বেশিই হোক, সেইরকম ‘কালী মা’কে যেমন করেই পূজার্চনা করা হোন তিনি দয়া-দাক্ষিণ্য করবেনই। তাই তো তিনি রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভবতারিণী হোক বা ফরাসডাঙার কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গীর কালীই হোন, সবই দক্ষিণা কালী। আমাদের ভক্তিগীততলি ‘মা’র আরাধনার অঙ্গ বিশেষ। সে জন্য ভক্তবৃন্দ মা’র কাছ নিজের সুখ-দুঃখের কথা একান্তভাবে আকুতি জানায়— ‘আমার সাধ না মিটিল, / আশা না পুরিল / সকলি ফুরায়ে যায় মা।’