• facebook
  • twitter
Monday, 25 November, 2024

বউবাজার হালদার বাড়ির ঐতিহ্যময় কালীপুজো

হালদার পরিবারের আদি নিবাস ছিল হুগলি ও বর্ধমান জেলার মধ্যবর্তী বাদ্লা গ্রামে। পরে কলকাতায় আসেন লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার। লিখছেন সপ্তর্ষি ঘোষ।

আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো দিয়ে শুরু হয় বাঙালির উৎসব মরশুম। তারই অঙ্গ হিসাবে কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় কালীপুজো। কালীপুজো মানেই আলোর উৎসব। কালকে গ্রাস করেন বলেই তিনি কালী। দেবী কালিকা অশুভ শক্তিনাশিনী। একদিকে তিনি সমস্ত ধ্বংসলীলার কর্ত্রী, অন্যদিকে সৃষ্টির বীজও তাঁর মধ্যে প্রস্ফুটিত আছে। জগতের সৃষ্টি আর ধ্বংসের যে লীলা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, তাকেই দেবী কালিকা সংযুক্ত করে রেখেছেন।

কলকাতা শহরে বেশ কিছু বনেদি পরিবার আছে, যারা নিষ্ঠা, ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রেখে প্রতি বছর কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় নিজ গৃহে শক্তি আরাধনায় ব্রতী হন। মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে ১৫ নম্বর রমানাথ কবিরাজ লেনের হালদার বাড়িতে কালীপুজোর সূচনা হয় ইংরেজি ১৭৫০ সালে। সূত্রপাত করেন আদিপুরুষ লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার। এবার এঁদের পুজো ২৭৫তম বর্ষে পদার্পণ করল। শুরু থেকে একই ঠাকুরদালানে পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কালীপুজোর বর্ণনায় যাওয়ার আগে হালদার পরিবার সম্বন্ধে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

হালদার পরিবারের আদি নিবাস ছিল হুগলি ও বর্ধমান জেলার মধ্যবর্তী বাদ্লা গ্রামে। সতেরোশো শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় আসেন লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার। বাদ্লা গ্রামে ছিল তাদের জমিদারি। হালদাররা ছিলেন ব্যবসায়ী পরিবার। বাড়ির কেউ পরের গোলামি করতে পারবে না, এই ছিল পরিবারের রীতি। কলকাতাতেও বউবাজার, ওয়েলেসলি, গণেশচন্দ্র এভিনিউ প্রভৃতি অঞ্চলে হালদারদের প্রচুর জমিজমা ছিল। চা-বাগান, হার্ডওয়ারের ব্যবসা, জাহাজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ছিল হালদার পরিবারের মূল ব্যবসা। লক্ষ্মীনারায়ণের চতুর্থ অধস্তন পুরুষ রাখালদাস হালদারের সময় ব্যবসা আরও প্রসারিত হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে হালদাররা প্রথম সারিতে ছিলেন। সেই সময় কলকাতার অভিজাত ‘ক্যালকাটা ক্লাব’, ‘বেঙ্গল ক্লাব’ এবং ‘টালিগঞ্জ ক্লাব’-এর সদস্য ছিলেন রাখালদাস হালদার। ক্যালকাটা ক্লাবের প্রথম দশজন ভারতীয় সদস্যের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাখালদাসবাবু। হালদার পরিবারের পক্ষে নিঃসন্দেহে এটি শ্লাঘার বিষয়। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় প্রথম টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হয় যে পঞ্চাশটি, তার মধ্যে একটি ছিল হালদার পরিবারের। সেটি এখনও সযত্নে রক্ষিত আছে। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে হালদার পরিবারের সদস্যদের স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। ষাটের দশকে ভূ-দান যজ্ঞের সময়ে আচার্য বিনোবা ভাবে বেশ কিছুদিন হালদার বাড়ির দোতলায় অবস্থান করেছিলেন।

দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীতে প্রতিমার কাঠামো পুজো হয় এবং তার আগে প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠীর মধ্যে কাঠামোর কাঠ সংগ্রহ ও সূত্রধর দিয়ে কাঠামো তৈরি করে রাখা হয়। মহাষ্টমীতে কাঠামো পুজোর পর মৃৎশিল্পীকে বায়না দেওয়া হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো থেকে ঠাকুরদালানেই প্রতিমা তৈরি শুরু হয়। কুমোরটুলির একই পরিবারে শিল্পী তিনপুরুষ ধরে প্রতিমা তৈরি করছেন।

ডাকের সাজে সজ্জিতা দক্ষিণাকালী মূর্তি। কৃষ্ণনগর থেকে দুই জন শিল্পী (বিজয় ঘোষ ও বাবলু বোস) একে প্রতিমাকে সাজান, যে সাজ সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। শিল্পী বাবলু বোস ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। পিছনের চালচিত্রও দর্শনীয়। হালদার বাড়ির কালীপুজোয় কিছু প্রাচীন প্রথা আজও বজায় আছে। পুজো শুরুর মুহূর্তে বাড়ির সব বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে মণ্ডপ এবং সমস্ত বাড়িতে মোমবাতি জ্বেলে দেওয়া হয়। সে এক অভাবনীয় মায়াবী পরিবেশ, চাক্ষুষ না করলে অনুভব করা যায় না। আগে পশুবলির প্রথা থাকলেও ১৯৪৬ সাল থেকে বলি বন্ধ হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে হয় আখ, শশা ও চালকুমড়ো বলি। পুরনো রীতি মেনে মশালের আলোয় সম্পন্ন হয় বলিদান পর্ব। দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না। তার বদলে দেওয়া হয় লুচি, পঞ্চব্যঞ্জন ও মিষ্টি। সংকল্প হয় বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষের নামে।
শোনা যায়, আগে কালী প্রতিমার জিহ্বা সমান উচ্চতা পর্যন্ত দশ মণ চিনির নৈবেদ্য দেওয়া হতো। এখন দেওয়া হয় দুই মণ। তবে এক মণ দশ সের চালের নৈবেদ্য আজও দেবীকে নিবেদন করা হয়। কোনও দেবোত্তর সম্পত্তি নেই। যৌথ পরিবারে সবাই মিলে পুজোর দায়িত্ব পালন করেন।

বাহ্যিক আড়ম্বর না থাকলেও হালদার বাড়ির পুজোয় নিষ্ঠা, ভক্তি ও আন্তরিকতার অভাব নেই। হালদার বাড়ির ঐতিহ্যময় ‘দক্ষিণাকালী’ মাতাকে দর্শন করতে বহু মানুষের সমাগম হয়।

২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো নৌকায় করে মাঝগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে। বর্তমানে প্রশাসন থেকে অনুমতি না মেলায় হালদার পরিবার বিসর্জনের সেই রীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

এই প্রতিবেদককে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন হালদার পরিবারের অষ্টম প্রজন্মের সদস্য বরুণ হালদার।