• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 October, 2024

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আত্মজীবনী’ থেকে

সেই চূড়ার উপরে একটি মাত্র বৃক্ষ ছিল, সে আমার নির্জ্জনের বন্ধু হইল। এই বৈশাখ মাসে মধ্যাহ্ন আহারের পর মনের আনন্দে আমি সকল খালি বাড়ীর বাগানে বাগানে বেড়াইয়া বড়াইতাম।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতের পর
তাহার পর দিন প্রাতঃকালে শতদ্রূ নদী-তীরে ভ্রমণে একাকী বহির্গত হইলাম। কৃষ্ণনগরের জলঙ্গী নদীর ন্যায় এখানে শতদ্রূ নদীর প্রশস্ততা। তাহার জল সমুদ্রজলের ন্যায় নীল, উজ্জ্বল, এবং পরিষ্কার। এখানকার শতদ্রূ নদীর জলের উপমা, বাল্মীকি কবির তমসা নদীর ন্যায়, ‘সজ্জানানাং যথা মনঃ’। আমি চর্ম্ম-মশকের ুপর চড়িয়া এই নদীর পারেও গিয়াছিলাম। তাহার জলমধ্যে বৃহৎ প্রস্তর নিমগ্ন থাকাতে কাঠের নৌকা চলিতে পারে না; মশক ভিন্ন পারে যাইবার আর অন্য উপায় নাই। পার হইয়া তাহার তীরের জল মুঙ্গেরের সীতাকুণ্ডের জলের ন্যায় উত্তপ্ত দেখিলাম। বিশেষ আশ্চর্য্য এই যে, বর্ষাকালে যেমন নদী ক্রমে বৃদ্ধি হইয়া তাহার আয়তন প্রশস্ত হইতে থাকে, এবং সেই উত্তপ্ত জলের স্থান অধিকার করিতে থাকে, সেই উত্তপ্ত জলও তাহার পার্শ্বে পার্শ্বে তত অগ্রসর হইতে থাকে; তীরে জল যেখানে থাকে সেইখানেই তাহা উত্তপ্ত হয়। দেখিলাম যে, সেখানে অনেক পীড়িত লোক স্নান করিতে আসিয়াছে। বলে যে, এখানে স্নান করিলে অনেক প্রকার ব্যাধির উপশম হয়।

এই পর্ব্বতবাসী ভূমাধিকারীদিগের মধ্যে প্রধান রাজা, পরে রাণা, পরে ঠাকুর, সর্ব্বশেষে জমিদার। এখানকার জমিদারেরাই কৃষক। হিন্দুস্থানের জমিদারদিগেরও এই দশা। পর্ব্বতে রাজা ও রাণাদিগের ক্ষমতা অধিক; ইহারাই প্রজাদিগের শাসনকর্ত্তা। রাজা ও রাণাদিগের বিবাহকালে সখীগণ সহিত কন্যার সম্প্রদান হয়। রাণীর গর্ভের পুত্র রাজা অথবা রাণা হয়। সখীর গর্ভের পুত্র রাজপরিবারে থাকিয়া যাবজ্জীবন অন্ন পায়। সখীর গর্ভে জাত কন্যা রাজকন্যার সখী রূপে পরিচিতা থাকে, এবং সেই রাজকন্যারই স্বামীর হস্তে তাহাদিগের জীবন ও যৌবন সমর্পণ করিতে হয়। কি অনর্থ, কি অনর্থ! রাজার এবং রাণার রাণীও অনেক, সুতরাং সখীও বিস্তর। এক স্বামীর মৃত্যু হইলে ইহারা, সকলে বন্দীর ন্যায় কারাগারে বদ্ধ থাকিয়া যাবজ্জীবন রোদন করিতে থাকে। ইহাদিগের পরিত্রাণের আর উপায় নাই।

আমি সপ্তাহ কাল সেখানে থাকিলাম। পরে রাণা ও রাজগুরুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া সিমলার অভিমুখে আরোহণ করিতে লাগিলাম। পথে আসিতে আসিতে একটা বনের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখি যে, মৃগয়াশীল রাজকুমার রত্ন-কুণ্ডল, হীরার কণ্ঠি, মুক্তার মালা, ও দিব্য বস্ত্র পরিধান করিয়া বন হইতে বনান্তরে বিচরণ করিতেছেন। সূর্য্যের আভাতে তাঁহার সেই নবীন মুখ-মণ্ডল দীপ্তি পাইয়া অতীব শোভা ধারণ করিয়াছে। তাঁহাকে আমার বোধ হইল, যেন একটি বনদেবতা। এই তাহাকে দেখিতেছি, এই সে বনের মধ্যে ডুবিয়া গেল, এই সে কাছে, এই সে দূরে; এই পর্ব্বতের উপরে। তাহার পরে আমি অতি কষ্টে একটা ভাঙ্গা সঙ্কীর্ণ পথ আরোহণ করিয়া নির্ব্বিঘ্নে সিমলাতে উপস্থিত হইলাম।

সিমলার উপরের পথে দেখি যে, সেই ফাল্গুন মাসেও তথায় বরফ পড়িয়া রহিয়াছে। বৃক্ষ লতাসকল শুষ্ক ও নীরস। বাঁশের অসার কঞ্চির মত বাতাসে তাহারা ঝন্ ঝন্ করিতেছে। চৈত্র মাসও শেষ হইল, ফুলে ফুলে সকল ভূমি একবারে মনোরম উদ্যানভূমি হইয়া উঠিল। নূতন বৎসর আবার দেখিলাম। গত বৎসর বৈশাখ মাসে প্রথম যে ঘরে উঠিয়াছিলাম, এক বৎসর সেই ঘরেই কাটিয়া গেল।

এখন বাজারের ঘর ছাড়িয়া পর্ব্বতের উপরে একটা সুরম্য নির্জ্জন স্থানে একটা বাঙ্গালা লইলাম। এই স্থানে আমার বড় ভাল লাগিল। সেই চূড়ার উপরে একটি মাত্র বৃক্ষ ছিল, সে আমার নির্জ্জনের বন্ধু হইল। এই বৈশাখ মাসে মধ্যাহ্ন আহারের পর মনের আনন্দে আমি সকল খালি বাড়ীর বাগানে বাগানে বেড়াইয়া বড়াইতাম। বৈশাখের দুই প্রহরের রেদ্রে পশমের চোগা গায়ে দিয়া বেড়াইতেছি, ইহার রহস্য আমার স্বদেশী বঙ্গবাসীরা কি বুঝিবেন?

আমি কখন কখন কোন নির্জ্জন পর্ব্বতের পার্শ্বস্থ শিলাতলে বসিয়া ধ্যানে মগ্ন হইয়া এক বেলা কাটাইতাম। এক দিন বেড়াইতে বেড়াইতে দেখি যে, একটা বনাকীর্ণ পর্ব্বতের মধ্য দিয়া একটা পথ চলিয়া গিয়াছে। আমি অমনি মনের সাধে সেই পথে চলিতে আরম্ভ করিলাম।
(ক্রমশ)