• facebook
  • twitter
Sunday, 22 December, 2024

দ্বিচারিতা

মোদী সরকার মুখে একথা বললেও হামাসের সাম্প্রতিক হামলার পর, অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে গত বছর অক্টোবরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব থেকে নিজেকে বিরত রাখে।

প্যালেস্তাইনের মানুষদের হত্যা করে, বিতাড়িত করে সমগ্র দেশটি দখল করাটাই ইজরায়েলের লক্ষ্য। তাই এখনও পর্যন্ত ইজরায়েল দ্বারা সংগঠিত গণহত্যার শিকার প্রায় ৪৩ হাজার মানুষ, যার অধিকাংশই মহিলা ও শিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন নৃশংস গণহত্যা এই পৃথিবী দেখেনি। ইজরায়েল সরকারের সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ কয়েকটি দেশ ছাড়া সমগ্র পৃথিবী এই গণহত্যার তীব্র বিরোধিতা করে চলেছে।

ইজরায়েল এতটাই বেপেরোয়া যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাসকে পর্যন্ত অস্বীকার করছে। ইজরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মিস্টার গুতেরাস ইজরায়েলের মাটিতে পা রাখার যোগ্য নন। এর তীব্র সমালোচনা করে লাতিন আমেরিকার দেশে চিলি একটি চিঠি রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলির কাছে পাঠায়। ১০৪ টি দেশে এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন, এর সাথে একমত হয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু এই নিন্দাসূচক চিঠি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার এখনও নিজেদের অবস্থান জানায়নি। অর্থাৎ রাষ্ট্রসঙ্ঘকে অস্বীকার করে ইজরায়েলের অবস্থানকেই সমর্থন করছে মোদীর সরকার।

ভারতের অতীত অবস্থান কিন্তু সব সময় প্যালেস্তাইনের পক্ষেই ছিল। এর বিপরীত অবস্থান এখন নিয়েছে মোদী সরকার। এর প্রথম কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নিজেদের বিশ্বস্ততা প্রমাণের চেষ্টা এবং দ্বিতীয় কারণ আদানির সঙ্গে মোদীর সম্পর্কের গভীরতা। এখন আদানির ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র ইজরায়েল। সেখানকার হাইফা পোর্ট মোদীর বদান্যতায় আদানিদের হাতে। সে দেশের টাওয়ার সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানির সঙ্গে জুড়ি বেঁধে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর কারখানা মহারাষ্ট্রে গড়ছে আদানি। হায়দরাবাদে ইজরায়েলের এলবিট সিস্টেমস ও আদানি গোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগে আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস, যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে ২০১৮ সালে। এখানে তৈরি ‘হার্মিস-৯০০’ ড্রোন ইজরায়েলে পাঠানো হচ্ছে। ৫০০ কেজি ওজন বহন করতে সক্ষম ইজরায়েলের এই ড্রোনেই এখন প্যালেস্তাইন ও লেবাননে নির্বিচার গণহত্যা চালাবার সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার।

এই হাতিয়ার সহ অন্যান্য অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিবাহিনীর উপরও। অতি সম্প্রতি, ইজরায়েল বাহিনী লেবাননে এই শান্তিরক্ষা বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে। এই বাহিনীতে ৫০টি দেশের ১০ হাজার সেনা শামিল আছে, যার মধ্যে ৯০৩ জন ভারতীয় সৈন্যও আছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সৈন্যদের জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মার্কিন সরকার ও আদানির প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রাখার জন্য মোদী সরকারের এই অবস্থান অত্যন্ত নিন্দনীয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিরুদ্ধে ইজরায়েলি পদক্ষেপের কোনও সমালোচনা না করে মোদী সরকার নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সূচনাকাল থেকেই এক গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় সদস্য হিসাবে ভারত শান্তির প্রশ্নে যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে এসেছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মোদী-শাহরা ইজরায়েলের পক্ষ নেওয়া শুরু করেছে।

প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল—দুই রাষ্ট্রেরই স্বতন্ত্র সার্বভৌম অস্তিত্বের পক্ষে বরাবর ভারত সরকার নিজেদের মত ব্যক্ত করে এসেছে। মোদী সরকার মুখে একথা বললেও হামাসের সাম্প্রতিক হামলার পর, অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে গত বছর অক্টোবরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব থেকে নিজেকে বিরত রাখে। অবশ্য এর দু’মাস পর ডিসেম্বরে গাজায় মৃতের সংখ্যা যখন ২০ হাজার পার হয়ে যায়, তখন অবস্থান পাল্টে ভারত যুদ্ধ বিরতির পক্ষে ভোট দেয়। একদিকে ভারত যুদ্ধ বিরতির পক্ষে ভোট দিচ্ছে, অন্যদিকে ভারতের মাটিতে তৈরি অস্ত্র ও ড্রোন ইজরায়েল ব্যবহার করছে প্যালেস্তাইন ও লেবাননে গণহত্যায়। এই দ্বিচারিতাই হল মোদী সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও বিদেশনীতি।