• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

ইস্টবেঙ্গলের কাছে আশিয়ান কাপ জয়ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার হাতছানি

এবছর থেকে এএফসির চ্যালেঞ্জ লিগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অংশগ্রহণের সুযোগ মিলেছে। এ এক অসাধারণ সাদৃশ্য বটে। ২০০৩ সালের আশিয়ান কাপ ১৫ দিনের টুর্নামেন্ট ছিল।

ইস্টবেঙ্গল এফসির কাছে ২০বছর আগের আসিয়ান কাপের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার সুযোগ এসেছে। এএফসির চ্যালেঞ্জ লিগ জয়ের মাধ্যমে সেই রেকর্ডকে স্পর্শ করার যায়। জাতীয় লিগ শুরুর হওয়ার পর আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসরে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরবময় অধ্যায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব রেখেছে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এই সাফল্য সেসময় ভারতীয় ফুটবলকে এশিয়া মহাদেশে অনেকটাই প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছিল। ২০০৩ সালের আশিয়ান কাপ, আশিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন ক্লাব চ্যাম্পিয়ান টিমগুলো নিয়ে হয়েছিল। আশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন তাদের অন্তর্ভুক্ত দেশের ক্লাব চ্যাম্পিয়ান দলগুলো ছাড়া ভারতের জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ান দল হিসেবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে আমন্ত্রণ জানায়। ১১টা দেশের ১২টা দল নিয়ে টুর্নামেন্টের সূচি তৈরি হয়। মায়ানমারের ফিনান্স রেভেনিউ ক্লাব টুর্নামেন্ট থেকে নাম তুলে নেয়। ১১টা ক্লাব টিমকে ৪টে গ্রুপে ভাগ করে খেলা হয়।

গ্রুপ-ডিতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সাথে থাইল্যান্ডের বেকতেরো সাসানা ও ফিলিপাইনের আর্মি দল ছিল। প্রথম ম্যাচেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাব থাইল্যান্ডের বেকতেরো ক্লাবের কাছে হেরে যায়। কিন্তু পরের ম্যাচেই ফিলিপাইন্স আর্মিকে ৬-০ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যায়। বাইচুং ভুটিয়া একাই ৫টা গোল করেন। টুর্নামেন্টে ৯টা গোল করে বাইচুং ভুটিয়া টুর্নামেন্টের সবোর্চ্চ গোলদাতা হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় লিগের রার্নাস পারসিতা ট্যাঙ্গরাম দলকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সেমিফাইনালে পৌঁছে যায়। সেমিফাইনালে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ান পেট্রোকিমিয়া পুত্রকে ট্রাইব্রেকারে ৭-৬ গোলে হারিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফাইনালে ওঠে। সেমিফাইনালের ট্রাইব্রেকারে সন্দীপ নন্দী অসাধারণ পারফরম্যান্স করে। টুর্নামেন্টে সন্দীপই সেরা গোলরক্ষকের সন্মান পায়। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ফাইনালে টুর্নামেন্টের শক্তিশালী টিম– থাইল্যান্ডের জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ান ও এশিয়ার ক্লাব টুর্নামেন্টের তৎকালীন নজরকাড়া টিম, বেকতেরো সাসানাকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ইতিহাস রচনা করে। কোচ সুভাষ ভৌমিকের প্রশিক্ষণে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব টুর্নামেন্টে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল উপহার দেয়। টুর্নামেন্ট জুড়ে সেসময়ের অনেক ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। খেলার মাঝে সংর্ঘষে ফুটবলার দেবজিৎ ঘোষের জীবনসংশয় হয়ে ওঠে। সেসময় মাঠে উপস্হিত, ক্লাব ডাক্তার শান্তিরঞ্জন দাসগুপ্তর চিকিৎসায় সে যাত্রায় দেবজিতের প্রাণরক্ষা হয়। কোচ সুভাষ ভৌমিকের কৌশলে ষষ্ঠী দুলে ও মাইক ওকারো নিজেদের ছাপিয়ে যায়। দলে ফিজিক্যাল ট্রেনার হিসেবে বিদেশি কেভিন জ্যাকসনকে নিযুক্ত করা হয়। টিমের ম্যানেজার হিসেবে প্রয়াত স্বপন বলের আগ্রাসী ভূমিকাও প্রশংসিত হয়েছিল।

প্রসঙ্গত বলা যায়, তার আগের মরশুমে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব জাতীয় লিগসহ ৫টা টুর্নামেন্টে জয়ী হয়েছিল। কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ, আইএফএ শিল্ড ও ইন্ডিপেন্ডস কাপ জয় উল্লেখযোগ্য ছিল। তারপর, আশিয়ান কাপ জয়কে আগের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলা যায়। ক্লাবের সকল পরিকল্পনাও এভাবে পরিপূর্ণতা পায়। আশিয়ান কাপ জয়ের পর ফেডারেশন কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে গোয়ার ভাস্কো ক্লাবের কাছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে পরাজিত হতে হয়। এছাড়া ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড কাপ ও সুপার কাপের ফাইনালেও উঠেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনটে টুর্নামেন্টেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে ট্রাইব্রেকারে হারতে হয়। তথাপি ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সেবছর আবার জাতীয় লিগে চ্যাম্পিয়ান হয়।

পরবর্তী ২০ বছরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কলকাতা লিগ জয় ছাড়া সেঅর্থে তেমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। গত মরশুমে সুপার কাপ জয়ের পর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব এবছর এএফসি চ্যাম্পিয়ান লিগ-২তে যোগ্যতাপর্বের ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়। যোগ্যতাপর্বের সেই ম্যাচে তুর্কমেনিস্হানের এফসি আলতান আসেরের কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় এবং এএফসির নতুন টুর্নামেন্ট সূচি অনুসারে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছে। এই টুর্নামেন্ট, আগের এএফসি প্রেসিডেন্ট কাপের নতুন সংস্করণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। এশিয়ার ইমার্জিং দেশগুলো নিয়ে আগে এই টুর্নামেন্ট হতো। এই মরশুম থেকে ভিন্নরূপে ডেভলপমেন্ট ও ইমার্জিং দেশগুলো নিয়ে যৌথভাবে এই টুর্নামেন্ট হচ্ছে। এই টুর্নামেন্ট এএফসির ক্লাব কম্পিটিশনের তৃতীয় পর্যায় হিসেবে গণ্য হয়। এই টুর্নামেন্টে জয়ী হলে পরের মরশুমে আবার এএফসি চ্যাম্পিয়ান লিগ-টুয়ে সরাসরি খেলার সুযোগ মিলবে। ফলে এই টুর্নামেন্টের গুরুত্ব ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কাছে অপরিসীম বলা যায়।

দ্বিতীয়ত, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের আইএসএলের শুরুটা এই মরশুমে ভালো হয়নি। লিগ চ্যাম্পিয়ান হয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এএফসির এলিট চ্যাম্পিয়ান লিগে খেলা নিয়ে সংশয় আছে। কার্যত, এএফসির চ্যাম্পিয়ান লিগ-টুয়ে খেলা নিশ্চিত করতে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কাছে এই টুর্নামেন্ট প্রধান হয়ে উঠেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, এএফসির এই টুর্নামেন্টে জয়ী হতে পারলে আবারও আশিয়ান কাপ জয়ের মত দেশকে আন্তর্জাতিক স্তরে গর্বিত করার সুযোগ মিলবে। এই টুর্নামেন্টর সাথে আশিয়ান কাপের ইতিহাস উসকে দেওয়ার যথেষ্ট উপাদান আছে। এই টুর্নামেন্ট এশিয়ার পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের দেশগুলোর বিন্যাসে সূচি তৈরি হয়েছে। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব পশ্চিম অঞ্চলের গ্রুপে পড়েছে। এই পশ্চিমের বিন্যাস থেকেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে ফাইনালে পৌঁছতে হবে। ফাইনালে পৌঁছতে পারলে, বিপক্ষে পূর্ব অঞ্চলের বিন্যাস থেকে জয়ী আশিয়ান অন্তর্ভুক্ত দেশের মুখোমুখি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। ফাইনালে পৌঁছে আশিয়ান অন্তর্ভুক্ত দেশের মুখোমুখি হওয়া গেলে, আশিয়ান কাপ জয়ের স্মৃতি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সুযোগ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গ্রহণ করতে পারবে?

ইতিমধ্যে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গ্রুপে তাদের প্রথম খেলায় ভূটানের পারো এফসির সাথে ড্র করেছে। ভূটানের থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব মাহি তালালের গোলে এগিয়ে গেলেও পারো এফসি পেনাল্টি থেকে গোল শোধ করে দেয়। উইলিয়াম ওকোপুর পেনাল্টি গোলে সমতা আনার পর প্রতি আক্রমনে ইভান্স আসান্তের গোলে পারো এফসি প্রথমার্ধে এগিয়ে থাকে। বিরতির পর ইস্টবেঙ্গল এফসি আক্রমণর ঝাঁজ বাড়ায় এবং দিমি মায়াকান্তোসের গোলে খেলায় ফিরে আসে। পরবর্তী সময়ে একাধিক গোলের সুযোগ তৈরি করে বটে, কিন্তু ভূটানের গোলকিপার কুপিকের দক্ষতায় পারো এফসির দূর্গ রক্ষা পায়। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ম্যাচ জিততে না পারলেও গুরুত্বপূর্ণ ১ পয়েন্ট সংগ্রহ করে। আশিয়ান কাপ জয়ের সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কিন্তু পরাজয় দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল।

কিন্তু টুর্নামেন্ট জয়ের শেষ হাসিটা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবই হেসেছিল। এবছর আশিয়ান কাপের খেলাও দীর্ঘ ২০ বছর পর নতুন ফরম্যাটে শুরু হচ্ছে। সেখানে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। কিন্তু এবছর থেকে এএফসির চ্যালেঞ্জ লিগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অংশগ্রহণের সুযোগ মিলেছে। এ এক অসাধারণ সাদৃশ্য বটে। ২০০৩ সালের আশিয়ান কাপ ১৫ দিনের টুর্নামেন্ট ছিল। এএফসির এই চ্যালেঞ্জ লিগের গ্রুপ পর্যায়ের খেলা ৭ দিনের হলেও, নকআউটের খেলা পরেরবছর মে মাসে শেষ হবে। অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব গ্রুপ পর্যায় থেকে নকআউটে পৌঁছতে পারলে, হাতে অনেক সময় পাবে। সেইসময় আইএসএল ও সুপার কাপের ম্যাচ খেলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব অনেক সুসংহত অবস্হায় থাকতে পারবে এবং নকআউটের খেলায় অনেক শক্তিশালী দল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ মিলবে। শক্তির বিচারে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পক্ষে এএফসি চ্যালেঞ্জ লিগে আশিয়ান দেশের ক্লাব দলকে পুনরায় হারিয়ে, আশিয়ান কাপের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হবে না।