• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

এক চিলতে রোদ

সম্ভ্রমবোধের যে এক চিলতে রোদ দেখেছিলাম, তার অসম্মান কিংবা অমর্যাদা আমি কি করে করি! জীবনের চলার পথে ও অনেক ঠোক্কর খাবে, কিন্তু হোঁচট খেতে খেতেই মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে।

সুপ্রিয় দেবরায়

মধ্যরাতে আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল। মাথা ঝিমঝিম, চোখ ঝাপসা। অভ্যাসবশত ডান হাতটা চলে যায় পাশে। বিছানা খালি। নিশ্চয়ই বাথরুমে গেছে মহুয়া। শরীরের ওপর থেকে পাতলা চাদরটা সরিয়ে তমসাচ্ছন্ন চোখে টলোমলো পায়ে বিছানা থেকে নেমে আলো জ্বালাই। অনুভব করি এক শীতলতার পরশ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর বেয়ে। পর্দা সরিয়ে দেখতে পাই জানলার কাঁচে আছড়ে পড়েছে বৃষ্টির দানা। শুনতে পাই ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। এত জোরে বৃষ্টি নেমেছে অথচ এতক্ষণ কেন শুনতে পাইনি বুঝতে না পেরে একটু অবাক হই। নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধের ফল। সেই মুহূর্তেই খেয়াল হয়, বিগত তিন-চার রাত ঠিক করে ঘুমটা হয়নি, দু’টো ট্যাবলেট খেয়েছিলাম গতকাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে। জানলার কাঁচের অপর পারে ধোঁয়াটে সাদা আস্তরণ ভেদ করে যতদূর দৃষ্টি যায়, স্ট্রিট লাইটে দেখতে পাই ঘুমন্ত শহর, ঝমঝম বৃষ্টি, গাছের পাতার নাচন আর মুক্তোর মতো বৃষ্টিদানা। এখানে পুকুর নেই, কচুপাতা নেই, ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ নেই, ধুপ করে নারকেল পড়ার আওয়াজ নেই, আম কুড়োতে যাওয়ার ধুম নেই। আরও কত কিছু নেই। তবে বৃষ্টিটা আছে। কখনও পড়ে রিনিঝিনি তালে, কখনও মুষলধারে। তবে আমাদের সেই মফস্বল শহরে খসখসে রোঁয়াওলা পাতার ফাঁকে ঘাপটি মেরে থাকা কুমড়োগুলির মাঝে রান্নাঘরের টিনের চালের অংশে কিংবা পুকুর পাড়ে কচু গাছের পাতায় বৃষ্টির জলের ফোঁটা পড়ে শব্দ উঠত টুপ-টাপ, টুপ-টাপ; শুনতে পেতাম নূপুরের আওয়াজ। নারকেল আর সুপারি গাছে ঘেরা পুকুরখানি, ঠিক যেন একটা ক্লান্ত চোখ বুজে আসা চোখের পাতার আড়ালে টিমটিম করে জেগে থেকে উপভোগ করত ফোঁটা ফোঁটা শীতল দানা। বৃষ্টির রিনিঝিনি ধারায় শীতল জলতল থেকে ধোঁয়ার মতো জলীয় বাষ্প যেন উপরে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যেত সেই কোথায়। বাগানের গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া বৃষ্টির জলে স্নাত হয়ে ঝলমল করত। আমাদের বাড়ির গেটের মুখে রাস্তার লাইট পোস্টের আলো সন্ধ্যা-রাতে কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠত। মনে হতো কত গল্পের ছায়া ঘুরে ফিরছে আমাদের চারপাশে। বিছানায় দাদুকে জড়িয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুনতাম তখন কত রূপকথা আর ভূতের গল্প।
অনেকক্ষণ হয়ে গেল, মহুয়া তো বাথরুম থেকে বেরোল না। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি বাথরুমের লাইট জ্বালানো নেই। ডাইনিং স্পেস পেরিয়ে বৈঠকখানাতে এসে দেখি ব্যালকনির দিকের দরজা খোলা, পর্দা সরানো একপাশে। অন্ধকারের মধ্যে মহুয়া বসে আছে একটি বেতের চেয়ারে। দমকা হাওয়ার ঝাপটায় বৃষ্টির জলে বারন্দাটা একদম ভিজে গেছে। বাইরে ঘোলাটে মেঘলা আকাশ, এলোমেলো বাতাস। খোলা দরজা দিয়ে বৃষ্টির হালকা ছাট এসে পড়ছে ঘরের মধ্যে, মহুয়ার পরনের শাড়িতে।

—তুমি এখানে বসে এইভাবে?
মুখে ধরা একটা আলগা হাসি মহুয়ার। —বাজের শব্দে হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল। অনেকক্ষণ জানলার পাশে পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বাজ পড়ছিল, সঙ্গে আকাশ চিড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি। একটু পরেই শুরু হল মোটা ধারায় বৃষ্টি। তোমার যদি ঘুম ভেঙে যায়, তাই এখানে এসে বসলাম। এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে।
—কিন্তু তোমার শাড়ি তো প্রায় ভিজে গেছে। ঠাণ্ডা লেগে যাবে। শাড়িটা চেঞ্জ করে ঘরে এসো।
—হ্যাঁ, যাচ্ছি। আর একটু সময় বসি এখানে।
—কী হয়েছে তোমার! তোমাকে ঠিক স্বাভাবিক লাগছে না।
—না, না, কিচ্ছু হয়নি।
ঘরের লাইট জ্বালাই। একটুক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থেকে, মহুয়ার কাঁধে হাত দিয়ে উঠতে বলি। ব্যালকনির দরজা যখন বন্ধ করছি, মহুয়া মৃদু কণ্ঠে বলে ওঠে, জানো, জবা কয়েকদিন ধরে আসছে না। অর্জুনও আসছে না। —একটু চমকে উঠি। জবার সঙ্গে পরিচয় থাকলেও, নিজের অজান্তেই বিহ্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করি, কে জবা?
— সেই যে। মনে নেই! তুমি আর আমি এক রবিবারে গিয়েছিলাম ওদের গ্রামের বাড়ি, তিলডাঙাতে।


আমি অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে মহুয়াই বাজারটা করে। শনি, রবি এবং ছুটির দিনগুলোতে আমি সঙ্গে থাকি। মহুয়ার কিছু বাঁধা দোকান আছে। সবজির জন্য অর্জুন আর বাবলু, আলু-পেঁয়াজ-আদা-রসুনের জন্য কানু, ফলের জন্য বিষ্ণু, মাংসের জন্য রহমত। মাছের কোনও বাঁধা দোকান নেই, প্রয়োজন মতো যার কাছে যেমন আমদানি থাকে, সেভাবে কেনে। অর্জুনের পাশে বসে জবা। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সী হবে। লম্বাটে মিষ্টি মুখ, টানা টানা চোখ। সবসময়ে হাসি লেগে থাকে তার মুখে। সেইসময় তার দু’টি চোখের মণিতে যেন আকাশপ্রদীপ জ্বলে ওঠে। রোগা লিকলিকে শ্যামাঙ্গী শরীরটিকে জড়িয়ে রাখে লাল-সাদা কিংবা সবুজ-সাদা ধনেখালি সুতির শাড়ি দিয়ে। পুরনো এবং এখানে-ওখানে ছিদ্র অংশ নজরে এলেও, পরনের শাড়ি সবসময় থাকে বেশ পরিষ্কার। কলমি, বেতো, পালং, মেথি— এই ধরনের কিছু শাক নিয়ে সে বাজারে আসে। মাঝেমধ্যে কয়েকটি পাতিলেবু কিংবা কাঁচকলা, মোচা নিয়ে আসতে দেখেছি। অর্জুন তাদের গ্রামেই থাকে। তার ভ্যানরিক্সাতে একসঙ্গে আসে। কিছু শাকের ফলন জবাদের বাড়ির উঠোনেই হয়, কিছুটা অর্জুনের ক্ষেতে। কলমি শাকের ফলন অর্জুনের পুকুরে, তাদের নিজস্ব ছোট্ট ডোবাতে। জবা অর্জুনকে কাকা বলে ডাকে। বাজারে লক্ষ্য করেছি, প্রত্যেকেই মহুয়াকে দিয়ে বউনি করাতে চায়। সবার বক্তব্য একই, মহুয়াকে দিয়ে বউনি করালে তাদের সব জিনিষ নিমেষের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। এটা আমিও লক্ষ্য করেছি, মহুয়া যখন এক্কেবারে মাছি তাড়ানো কোনও দোকানে ঢোকে, এক পলকের মধ্যে ভিড় উপচে পড়ে। অবশ্য এ ব্যাপারে মহুয়ার একটু পক্ষপাতিত্ব আছে জবা এবং অর্জুনের প্রতি। প্রথমে বাজারে ঢুকেই সে শাক আর সবজি কেনে। শাকের প্রয়োজন না থাকলেও, কেনে। বাড়িতে এসে কাজের মাসিকে দিয়ে দেয়। এক রবিবারে আমাদের বাজারে যেতে একটু দেরি হয়। বাজারে ঢুকেই দেখি জবার মুখ ভার। অভিযোগ করে— এত দেরি করে এলে কেন? সকাল সকাল এলে তোমাকে দিয়ে বউনি করতে পারি।

জবার এই মৃদু শাসনটা আমি বেশ উপভোগ করি সেদিন। কথাপ্রসঙ্গে মহুয়া জানিয়েছিল, জবার বাবা কোভিডের পর রাজস্থানের বালত্রা জিলার অন্তর্ভুক্ত পাছপাদ্রাতে একটি নির্মাণ সাইটে গিয়েছিল। প্রথম একবছর টাকা-পত্তর পাঠিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে সব বন্ধ হয়ে যায়। ফোন করলে মোবাইলে রিং হয় না। যাদের সঙ্গে গিয়েছিল, তাদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে সদুত্তর পায় না। এরপর অর্জুনের সাহায্যে লোকাল থানায় যোগাযোগ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনও খবর পাওয়া যায়নি। এরমধ্যে একদিন জবার মা অর্জুনের পুকুর থেকে কলমি শাক তুলতে গিয়ে কোমরে চোট পায়। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। এখন আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। তার উপর হাঁপানি রোগ আগে থেকেই ছিল। জবা তখন গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মায়ের বদলে জবার তখন শুরু হয় অর্জুনের সাথে শাকের আঁটি নিয়ে আসা। বাজার থেকে ফিরে, রান্না করে মায়ের জন্য খাবার রেখে, নিজে খেয়ে স্কুলে যায়। একটু দেরিই হয় যেতে। প্রথম ক্লাসটা বেশিরভাগ দিনই মিস করে। তাও কোনওরকমে পাশ করে এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। জবার শত আপত্তি সত্ত্বেও মা ওই ভাঙা কোমর এবং হাঁপানির টান নিয়েই বাগানে কাজ করার চেষ্টা করে। একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে, কিন্তু তাও জবা স্কুলে চলে গেলেই খুরপি কিংবা খন্তা নিয়ে বাগানে মাটি ঝুরঝুরে করতে বা আগাছা পরিষ্কার করতে লেগে যায়। ভাবে, এই এইটুকুন একরত্তি মেয়ে আর কতদিক সামলাবে!

এক রবিবার বিকেলে আমাদের আই-২০ নিয়ে তিলডাঙাতে যাই। পুরনো আধভাঙা সব মাটির বাড়ির গাঁ। এখন কিছুটা ভোল বদলে হাতে গোনা কয়েকটি দাঁত বের করা ইটের দেওয়াল গড়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মাজা ভাঙা দেহ এখনও প্রকট। অ্যাসবেষ্টসের চালা, ইটের দেওয়ালে সিমেন্টের প্রলেপ পড়েনি। জবাদের বাড়ির সামনে গিয়ে যখন পৌঁছই, নজরে আসে একচালা ঘরের বাইরে এক চিলতে জায়গা, সেখানেই ফলে আছে নধর পুঁই শাকের ডাটা, এককোনায় ছোট্ট একটি ডোবা, তার পাশে পাতি লেবুর গাছ আর কয়েকটি কাঁচকলার কাঁদি সহ কলাগাছ। একটিই ঘর, সেখানেই শোওয়া-রান্না। আমাদের শহর থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে যে এমন একটি হতদরিদ্র গাঁ আছে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না। কথায় কথায় জানতে পারি, খড়ের চাল প্রতিবার ঝড়ে উড়ে যায়। আমাদের দেখে জবার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে। ঘর থেকে একটি মাদুর এনে বিছিয়ে দেয় মাটির দাওয়ায়। বেঁকা কোমর নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে জবার মা। গালের চামড়ায় অজস্র আঁকিবুঁকি, বুঝতে পারি চিন্তায়-ভাবনায়; কিন্তু ছোট্ট গোলগাল মুখটির এক দর্শনেই বোঝা যায় তার এককালের সৌন্দর্য এখনও অস্তমিত হয়নি। কখন খবর দেওয়া হয়েছে জানি না, একটু পরেই অর্জুন হাজির তার বাগানের কয়েকটি পাকা আম নিয়ে। হাতে ধরা দু’টি কাঁচের গ্লাস, পুরনো তবে পরিষ্কার। পাতিলেবুর শরবত নিয়ে জবা আর পিছনে পিছনে তার মা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, আমি জিজ্ঞেস করি— সরকার থেকে প্রতিমাসে যে মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে মহিলাদের জন্য, সেটা ঠিকঠাক পান তো?
জবা তখন একটু ঝুঁকে শরবতের গ্লাস মহুয়ার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, আমার দিকে ঘুরে বলে ওঠে— কেন? মা মাসোহারা কেন নেবে? আমরা কি অক্ষম না অসমর্থ!

একটা ঝাঁকুনি খেয়ে নড়ে বসি, থতমত স্বরে বলি— গ্রামের বাকিরা?
একটা অসীম আত্মসম্মানবোধ জবার দু’চোখ থেকে বেরিয়ে আসা স্ফুলিঙ্গকণাতে দেখতে পাই। দু’কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে— অনেকেই নেয়। আমরা তো কাজ করি। মা কেন নেবে?
কথা ঘোরাবার জন্য এবার বলি— তুমি তো এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছ। তুমি কি জানো, তোমাদের মতন অবিবাহিতা মেয়েদের জন্য সরকার থেকে প্রতিবছর টাকা দেয়?
দু’পাটি সাদা দাতের হাসিতে এবার জবার মুখ উদ্ভাসিত— তুমি পারও বটে কাকা, তুমি কি সরকারের লোক! হ্যাঁ, স্কুল থেকে একটা ফর্ম দিয়েছিল, সই করে জমা দিয়েছি। দিদিমণি জানিয়েছেন, কিছুদিন পর সবার জন্য এক হাজার টাকা আসবে। পড়াশোনা করছি। এটা তো আমার হকের টাকা, তাই না কাকা?


আকাশ যদিও মেঘাচ্ছন্ন, কিন্তু বৃষ্টি উধাও। কয়েকদিনের গুমোট চাপা ভ্যাপসা গরমের থেকে একটু রেহাই। এক কাপ চা খেয়ে আমরা দু’জনে সকাল-সকালই বেরিয়ে পড়ি তিলডাঙার উদ্দেশে। গাঁয়ের কাছাকাছি পৌঁছে মাটির বুক থেকে যে সোঁদা গন্ধ পাই, তা বৃষ্টির নাকি মাটির, বুঝতে পারি না। কালো মাটির রাস্তার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে গাছের পাতা, ভাঙা ডালের টুকরো, কাগজ, পলিথিনের প্যাকেট। নজরে আসে বেশ কিছু বাড়ির টিনের চাল ভেঙে পড়েছে। কিছু লোক ব্যস্ত কোদাল, ইত্যাদি নিয়ে উঠোনে জমা কর্দমাক্ত জলকে মিলিয়ে দিতে রাস্তার পাশে নালার সঙ্গে। জবাদের বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে পারি না। একটা গাছের ডাল পথ আটকে। গলির মোড়ে গাড়ি পার্ক করে পিচ্ছিল রাস্তার উপর দিয়ে পা টিপেটিপে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পাই, খড়ের চাল অনেকটাই ভেঙে পড়েছে, ঘরের থেকে জলের ধারা বয়ে চলেছে উঠোন-পানে। দু’একবার আওয়াজ দিয়ে কারুর সাড়া পাই না। গলির মোড়ে ফিরে এসে, অর্জুনের বাড়ির খোঁজ পাই। গলির মোড়েই অর্জুনের বাড়ি। অর্জুনের বউ-ই হবে, জানায় জবা অর্জুনের সাথে শহরের বাজারে গেছে। আরও কিছু বলছিল হয়ত, না শুনেই গাড়িতে বসে স্টার্ট দিই।

মহুয়ার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন— তুমি এতদিন আসনি কেন?
—মায়ের এমন হাঁপানির টান উঠলো। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দু’জন হাতুড়ে ডাক্তার। অর্জুন কাকা বলল, চল শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাই। মা যেতে চাইলো না। তোমাদের শহরের ডাক্তার সপ্তাহে একদিন আসে। তিনদিন পর আসার কথা। কিন্তু মাকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, দু’রাত্তির পর। মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ মিটিয়ে তবেই আসতে পারলাম।

জবার টানা দু’টো চোখে পুকুরের যে গভীরতা, অশ্রুকণার রেশ কি সেখানে দেখতে পেলাম? গলার স্বর যতই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুক, চোখের কোণ যে নিজের অজান্তেই অশ্রুভারে চিকচিক করে।
মহুয়া স্তম্ভিত। কী অনায়াসে মায়ের মৃত্যুসংবাদ দিল! মহুয়ার মুখ দেখে জবা আবার বলে ওঠে— চিন্তা কোর না গো। আস্তে আস্তে সব সামলে নেব। মা কি চিরকাল থাকে! তবে একটু আগেই চলে গেল।
এবার একটু রাগত স্বরেই মহুয়া বলে— এত কিছু ঘটে গেল, আমাকে কিছু জানালে না! তোমাদের বাড়ি তো প্রায় ভগ্ন অবস্থা, সেখানে থাকবে কী করে?

—এ তো ফি-বছরই হয়। অর্জুনকাকা আছে না! অর্জুনকাকা ঘরামির কাজও করে। আজ একটু পরে রোদ উঠলেই, অর্জুনকাকা সারিয়ে দেবে।
—সে ঠিক আছে। এখন তুমি আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে। তুমি একা একা থাকবে কী করে? সোমত্ত মেয়ে। রাতে-বিরেতে যদি কিছু হয়ে যায়!

—তুমি আবার এসব নিয়ে ভাবছ! রোজ সকালেই তো তোমার সাথে দেখা হবে। এ’কদিন কাকি এসে থেকেছিল। এখন কিছুদিন অর্জুনকাকার বাড়িতেই থাকবো। এই দ্যাখো, আজকে তো তুমি ব্যাগও আননি। চারটে কাঁচকলা নিয়ে যাও। লেবু হাতেহাতে দেব না। মা বলতো, তাহলে নাকি ঝগড়া হয়। তোমার সাথে কি আমার ঝগড়ার সম্পর্ক! পুঁইশাকগুলো বেশ নধর হয়েছিল, বোধহয় জলে নষ্ট হয়ে গেছে।

কাঁচকলা চারটে আমার হাতে ধরিয়ে, মহুয়া ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে এগিয়ে দেয়।
—তুমি দেখি আবার আমাকে বিপদে ফেললে। আমার কাছে কি অত খুচরো আছে? অর্জুনকাকার কাছেও নেই। কুড়ি টাকা থাকলে দেও। নাহলে কালকে দিও।

আমি নিশ্চিত, মহুয়া বলতে যাচ্ছিল— ওটা তুমি রাখো। তার আগেই আমি বাঁ-হাত দিয়ে মহুয়ার ডান-হাত টিপে ধরি। বুকপকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে জবার দিকে এগিয়ে দেই।
সেদিন জবার বাড়িতে ওর চোখে

সম্ভ্রমবোধের যে এক চিলতে রোদ দেখেছিলাম, তার অসম্মান কিংবা অমর্যাদা আমি কি করে করি! জীবনের চলার পথে ও অনেক ঠোক্কর খাবে, কিন্তু হোঁচট খেতে খেতেই মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে। জবার অভিমানকে মনে মনে কুর্নিশ করে, একটা তৃপ্তি নিয়ে বাড়ির পথে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে চলি। দারিদ্র, অসহায়তাকে ছাপিয়ে গেছে তার আত্মসম্মান বোধ।