সৈয়দ হাসমত জালাল
কবি অনুপ মণ্ডল হয়ত খানিকটা দেরিতেই কবিতা লেখা শুরু করেছেন অথবা তাঁর কবিতা পাঠকসমক্ষে এসেছে কিছুটা দেরিতে। বিগত মধ্য-পঞ্চাশে তাঁর জন্ম হলেও কবিতা লিখছেন নব্বইয়ের দশক থেকে। যদিও দশক দিয়ে কোনও কবিকে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী নন অনেকেই। এর পেছনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিও আছে। অনুপের কবিতা পড়তে গিয়ে সে কথাই মনে হলো। তাঁর কবিতাকে কোনও বিশেষ দশকের চারিত্র্য-লক্ষণ দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না। সেই অর্থে অনুপের কবিতার জগৎ বিশেষ সময় বা কালের ঊর্ধ্বে নিজের মতো করে, কিছুটা অনুচ্চকিত উচ্চারণে এবং খণ্ড খণ্ড রূপকল্পের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়। তাঁর কবিতার বাস্তবতা নিছক বাস্তব হয়েই থেকে যায় না, তা সংবেদনশীল পাঠককে টেনে নিয়ে যায় পরাবাস্তব অথবা অধিবাস্তব জগতের মধ্যে।
এবছর কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতাগ্রন্থ ‘লোক-উৎসবের বেড়াল’। এই গ্রন্থের সব কবিতাই নাতিদীর্ঘ এবং চিত্রকল্পগুলিও যথেষ্ট নির্ভার। কিন্তু প্রতিটি কবিতাতেই কবি পাঠককে যেখানে পৌঁছে দেন, পাঠক সেখানে একধরনের নির্জনতার বোধে আক্রান্ত এবং মুগ্ধতাতেও আচ্ছন্ন হন।
গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘দুপুর’। কয়েকটি নির্ভার পঙ্ক্তিতে অনায়াসেই যেন ছবি এঁকেছেন কবি। একটি দুপুরের ছবি, যেখানে মরা রোদের মধ্যে ‘স্থির জলে প্রাণিত অবুঝ ছায়া’। মরা রোদের বিপ্রতীপে ‘প্রাণিত’ এবং ‘অবুঝ’ শব্দদুটির অসামান্য ব্যবহার পাঠকের মনোযোগ এড়ানোর নয়। সেই জলে আছে একটি পালতোলা নৌকো, ফিরফিরে হাওয়া আর ওপারে সেই বাড়ি, যেখানে ‘নীল পাড় সাদা শাড়ি/ আর দেয়ালে দেয়ালে সময়ের ছবি/ কার্নিশে কার্নিশে নাব্যতার মেঘ’। আর তারপরই কবিতাটি শেষ হয় এইভাবে– ‘বন্ধ জানালায় খড়খড়ি তোলা/ নৌকোটা বাঁক পেরিয়ে আজও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।’ বন্ধ জানালার ওপাশে দূরে একটি নৌকো যা আগে সমস্ত দৃশ্য পেরিয়ে চলে গিয়েছে, আজও তা বাঁক পেরিয়ে, চারপাশের সমস্ত বাস্তবতা পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অনুপের এই কবিতাগ্রন্থের এক-একটি কবিতা নির্দিষ্টভাবে কোথাও পৌঁছে দেয় না। কিন্তু ভেতরে কোনও চেতনাবিন্দুতে আলোর রেখা জেগে ওঠে। ‘ঘুম’ কবিতায় দেখি, ‘উঠে যাচ্ছে কাদায় গাঁথা দেয়াল/ একের পর এক/ চুড়োয় চেতনবিন্দু রাঙা হয়ে এল’। আর সবশেষে ‘দোরগোড়ায় পেখম মেলে পুড়ে যাচ্ছে মাটির ময়ূর’।
অনুপ মণ্ডলের কবিতার মধ্যে আছে এক গভীর চোরাস্রোত। তিনি যেমন অবলীলায় বলতে পারেন, ‘জন্মদিনে কোথাও আমি আমার ঈশ্বরকে খুঁজে পাইনি’। তেমনই ‘ভাঙন’ কবিতায় বলেন, ‘পরাজয়ের গোলপোস্ট থেকে/ তলে তলে সূর্য গড়িয়ে নেমে গেছে অনেকখানি দূর’। পরাজয়ের মুহূর্তকে এভাবে একধরনের নির্লিপ্ততায় ফুটিয়ে তোলেন কবি। আর শেষে এক ভয়ংকর ছবির সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন তিনি– ‘মুন্ডুহীন ও স্মৃতিহীন এক একক মাত্রার মানুষ/ ঘাড় বেয়ে মাথা, ভাঙাচোরা অঙ্কগুলো তখনও গড়িয়ে নামছে’। ‘মুন্ডুহীন ও স্মৃতিহীন’ মানুষ ও সময় কোথায় যেন একাকার হয়ে যায়।
‘জুতো’ কবিতায় দেখি, ‘জুতোর মধ্যে অনেক-অনেক কান্না জমা হয়ে আছে’। এই জুতো তো জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমণের সাক্ষী, যে পথ নিশ্চয়ই কুসুমকীর্ণ নয়। জীবনের, সময়ের অনেক খানাখন্দ পেরোতে হয়েছে। সেই অভিযাত্রার বিষাদ, পরাজয়ের ধুলো, জলকণা জমে আছে কান্না হয়ে। আর তাই কবি এরকম অভিজ্ঞতার কথা লিখতে পারেন– ‘আজ সকালে জুতো পরতে গিয়ে/ বহুদিনের পুরোনো একটা কান্না/ আমার পা দু’খানা জড়িয়ে ধরল’।
কবিতাগ্রন্থটির নাম-কবিতা ‘লোক-উৎসবের বেড়াল’ পড়ে নেওয়া যাক। ‘আমাদের এই রোদ হাওয়া ও জলের শহরে/ ফ্লাইওভারগুলো/ কেশর ফোলানো ঘোড়ার মতো ছুটছে’। অনুপের কবিতায় গ্রাম-মফস্বলের রূপকল্প যেমন এসেছে, এসেছে ঘরোয়া জীবনের মায়াজড়ানো ছবি (গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘রোদ্দুর’), তেমনই এই কবিতায় এসেছে নগরজীবনের বিপ্রতীপে লোকজীবনের ঈষৎ তীর্যক স্পর্শ। কবিতাটির পরের পঙ্ক্তিগুলিতে দেখি– ‘সূর্য দিগন্তে নেমে গেলে/ প্রত্যেকটা জানালায় ব্যক্তিগত রোদ/ লোকউৎসবে বিক্রী হতে আসা/ মেধাবী রঙ বেড়াল/ লাফ দেওয়ার আগে মিছিমিছি ঘুমিয়ে পড়ল’। কবিতার শুরুর পঙ্ক্তিগুলির সঙ্গে শেষের পঙ্ক্তি তিনটি স্পষ্টতই একটি বৈপরীত্যের ছবি তুলে ধরেছে।
আমরা জীবনানন্দ দাশের বিড়ালকে দেখেছিলাম, হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে। তারপর সে অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে এনে সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিয়েছিলো। সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুষঙ্গে হলেও অনুপের এই কবিতা স্মরণ করিয়ে দেয় জীবনানন্দের কবিতাটি। তার কারণ হয়ত কবিতাদুটির গভীর পরাবাস্তবতা। অনুপের ‘লোক-উৎসবের বেড়াল’ কবিতাগ্রন্থটি পাঠককে নিঃসন্দেহে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার স্বাদ দেবে। তাঁর কবিতার ভেতরে ছড়িয়ে আছে ‘মরা জ্যোৎস্নার মায়া’।
লোক-উৎসবের বেড়াল
অনুপ মণ্ডল, আলোপৃথিবী প্রকাশন
মূল্য : ১৬৫ টাকা।