• facebook
  • twitter
Wednesday, 27 November, 2024

একটি ধূসর সময়ের গল্প

বিষ্টুর মা মন্ডলের বউকে বলে, মায়া বাড়তে দিস না। ছেলের ওপর পাগলির মায়া বেড়ে গেলে আর ছাড়াতে পারবি না। বুকের দুধ বন্ধ করে গরুর দুধ খাওয়ানো শুরু কর। লক্ষ্মী খড়ের গাদায় বসে বসে কুকুরের বাচ্চার দুধ খাওয়া দেখে। রাতের আঁধার ঘন হলে বন থেকে শেয়াল বেরিয়ে আসে। মা কুকুরটা বাচ্চাগুলোকে পেটের তলে লুকিয়ে রাখে আর ঘেউ ঘেউ করে ডাকে। তখন লক্ষ্মী লাঠি হাতে করে শেয়াল তাড়াতে থাকে।

স্বপন বিশ্বাস

তখন কুকুরের বাচ্চা বিয়ানোর সময়। মন্ডলদের খড়ের গাদার ভেতরে একসঙ্গে ছ’টা বাচ্চা হয়েছে। খেঁকি কুকুরটা হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে সেই ছ’টা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়।

মাঠের ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। দিন ছোট হয়ে আসছে। পশ্চিমের আকাশে সূর্যটা হেলতে না-হেলতেই টুপ করে ডুব দেয়। উত্তরের পাহাড় থেকে তখন শিরশির করে শীত নেমে আসে। কুকুরের বাচ্চাগুলো
কুঁই-কুঁই শব্দ করে খেঁকি কুকুরটার পেটের ভেতরে সেঁদিয়ে যেতে চায়। লক্ষ্মীর ছেঁড়া কাপড়ে তখন টান পড়ে। হাড়ে কাঁপন ওঠে। দাঁতের সঙ্গে দাঁত লেগে ঠকঠক আওয়াজ তোলে। কুকুরের বাচ্চার মতো লক্ষ্মীও তখন খিদের কথা ভুলে যায়। আস্তে করে ঢুকে পড়ে খড়ের গাদায়।

মন্ডলদের খোলানে ছোট বড় অনেকগুলো খড়ের গাদা। তার দুই গাদার মাঝখানে কুকুরের আঁতুড় ঘর। উল্টো দিকে লক্ষ্মীর শীতের আস্তানা। লক্ষ্মী বোবা-কালা ভবঘুরে পাগলি মানুষ। বিশ-বাইশ বছর বয়স। কোনো এক লক্ষ্মী পূজার রাতে সে এ গাঁয়ে এসে হাজির হয়েছিল, তাই সবাই লক্ষ্মী বলে ডাকে। লক্ষ্মী হলো সম্পদের দেবী। অথচ লক্ষ্মী পাগলির সম্পদ বলতে পরনের ছেঁড়া কাপড় আর কয়েকটা চটের বস্তা। মাথায় কিছু উকুন আছে সেটা তার বাড়তি সম্বল। অবসর সময়ে মাথা চুলকায় আর উকুন মারে। উকুন মেরে হি-হি করে হাসে। সেটা পাগলির বিনোদন। রাতে ঘুম পেলে বিষ্টুর মা-র ঘরের বারান্দায় ঘুমায়। গরমের রাতে বিষ্টুর মাও বারান্দার আরেক পাশে ঘুমায়। সেখানে নদী আর খোলা মাঠ পেরিয়ে হু-হু করে বাতাস আসে। রাতে গরম বাড়লে লক্ষ্মী বুকের কাপড় ফেলে দিয়ে ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়ায়। শীতের রাতে বিষ্টুর মা নাতির সঙ্গে ঘরের ভেতরে শোয়। তখন লক্ষ্মী ফিরে যায় তার খড়ের আস্তানায়।

বিষ্টুর মা বিধবা মানুষ। বয়স হয়েছে। এখন আর মাজা সোজা করে হাঁটতে পারে না। তবু বিবিসি রেডিওর মতো গ্রামের সব খবর তার কাছে পৌঁছে যায়। এমনিতে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। তবে বিপদে পড়লে বিষ্টুর মা-ই ভরসা। শ্বাশুড়ি-বেটার বউয়ের গণ্ডগোল কিংবা স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না-হওয়া থেকে শুরু করে গরু-ছাগলের বাচ্চা বিয়ানো পর্যন্ত বিষ্টুর মা ভরসা। লক্ষ্মীর বাচ্চাও হয়েছিল বিষ্টুর মার হাতে। গাঁয়ের লোকেরা তো সব ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কার না কার বাচ্চা তার ঠিক নেই। গাঁয়ে থাকতে দেয়াই উচিত হয়নি। শুধু মোড়লের কথায় অনিচ্ছা সত্বেও এই মহাপাপকে গাঁয়ের লোকেরা মেনে নিয়েছে। মোড়লের বড় দুই বউয়ের বাচ্চাকাচ্চা নেই। আঁটকুড়ে নাম ঘুচানোর জন্য মোড়লকে আরও একটা বিয়ে করতে হয়েছে। তিন নম্বর বউয়ের একটি পুত্র সন্তান জন্মেছে। তার জন্য মোড়ল খুশি হয়ে গাঁয়ের লোকদের একদিন পেট পুরে খাইয়েছে। তাতে যদিও মানুষের মুখ বন্ধ হয়নি। একটা চাপা গুঞ্জন আছে, মোড়লের ছেলের মুখের গড়নটা ঠিক মোড়লের মতো নয়। তবে কার মতো সে কথা প্রকাশ করতে কেউ সাহস পায় না। সবাই অপেক্ষা করে লক্ষ্মীর বাচ্চার মুখের গড়নটা কেমন হবে, সেইটা দেখার জন্য। লক্ষ্মী কীভাবে পোয়াতি হলো, তা নিয়ে নানান গল্প তৈরী হয়। গাঁয়ের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বিষ্টুর মা বলে, বোবা-কালা একটা পাগলি মেয়ের পোয়াতি হতে কি মরদ লাগে। চাঁদ-সূরুজের আলো আর জল-হাওয়া গায়ে লাগলেই পেট ফুলে ওঠে। বাইবেল মহাভারতে এমন গল্প কত আছে। বিষ্টুর মা তখন গল্প শোনায় লাঙলের ভাঁওর থেকে কীভাবে রামের বউ সীতার জন্ম হল। কুন্তির কান থেকে কীভাবে কর্ণের জন্ম হল। যিশুখ্রিস্টের পবিত্র আত্মার কথা বলে। বিষ্টুর মায়ের ধর্মকথা শুনতে শুনতে গাঁয়ের লোকদের মনে পড়ে সাধুবাবার কথা। বছরখানেক আগে এক সাধুবাবা এসে আস্তানা করেছিল গাঁয়ের বটতলায়। তখন লক্ষ্মীও থাকত বটতলায়। রাত বাড়লে সাধুর আস্তানায় ভিড় বাড়ে। ধুঁয়ার কুণ্ডলী ওঠে। লক্ষ্মী ধুঁয়ার গন্ধ পছন্দ করে না। তাই দূরে চট বিছিয়ে রাস্তার কুকুরগুলোর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে যায়। রাত নিশুতি হলে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখনও কেউ কেউ সাধু বাবার আস্তানায় আসে। গোপনে। তারা রাস্তার কুকুরগুলোকে খাবার দেয়। খাবার পেলে কুকুরের ডাক বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ্মী তখন বাতাসে বিপদের গন্ধ পায়। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে।

সকাল হতেই দূর গাঁও থেকে মানুষজন আসে। তাদের নানা জনের নানান রকমের বিপদ। তারা বিপদ থেকে মুক্তি চায়। কেউ আরো কিছু প্রাপ্তি আরো কিছু সৌভাগ্য চায়। সব কিছুর সমাধান দেয় সাধুবাবা। খুশি হয়ে সবাই টাকা-কড়ি দেয়। ফলমূল মিষ্টি প্রসাদ দেয়। সাধুবাবা আর তার ভক্ত অতিথিবৃন্দ সেই সুস্বাদু প্রসাদ খায়। খাওয়ার পরও কিছু উচ্ছিষ্ট থাকে। লক্ষ্মী সেই উচ্ছিষ্ট অংশ ভাগাভাগি করে রাস্তার কুকুরগুলোর সঙ্গে অথবা কুকুরগুলো ভাগাভাগি করে লক্ষ্মীর সঙ্গে। খাবার ফেলে দিলেই হয়তো ঘেউ ঘেউ করে কুকুরগুলো তার দখল নেয়। লক্ষ্মী তখন লাঠি হাতে তাড়া করে কুকুরগুলোকে। অথবা লক্ষ্মী খাবারের দখল নিলে কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করে তার চারিদিকে ঘিরে ধরে। তখন লক্ষ্মী একদিকে তাড়া দিলে অন্যদিকের কুকুরগুলো ছোঁ দিয়ে খাবার নিয়ে চলে যায়। তারপর দূরে গিয়ে নিজেদের ভেতরে ভাগাভাগি করে খায়। প্রতিদিনের এই মজার দৃশ্য কেউ একজন ভিডিও করে ছেড়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সেই মজার ভিডিও ভাইরাল হতে সময় লাগে না। শহর থেকে সাংবাদিক আসে। রাজনৈতিক দলের নেতারা আসে। খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়। সরকারি প্রশাসনের টনক নড়ে। তারা লক্ষ্মীকে তুলে নিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যায় তা কেউ জানে না। বটতলায় তখন নতুন নতুন আশঙ্কা আর গল্পের জন্ম হয়। কেউ বলে লক্ষ্মীকে এবার পাগলা গারদে নিয়ে চিকিৎসা করাবে। ইলেক্ট্রিক শক দেবে। কেউ বলে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেবে। কেউ বলে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে দেবে। তারপর কিডনি চোখ বিক্রি করে লক্ষ্মীকে কঙ্কাল বানিয়ে ফেলবে। কেউ আবার এই কথায় সায় দেয়। বলে, শহরের হাসপাতালে তারা এমন কঙ্কাল দেখেছে। যারা ডাক্তারি পড়ে তারা নাকি ঘরের ভেতরে কঙ্কাল ঝুলিয়ে রাখে।

এই সব গল্প যখন একটু থিতিয়ে পড়ে তখন একদিন ভোরে বটতলায় একটা ট্রাক এসে থামে। ট্রাকের শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙে। অজানা আশঙ্কা নিয়ে কেউ কেউ দূর থেকে নজর রাখে। কেউ কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। ধুপধাপ করে ট্রাক থেকে নামে আট-দশজন মানুষ। তারা সরকারি মানুষদের মত পোষাক পরা। পায়ে পুলিশের মত লম্বা লম্বা বুট জুতো। তারপর ট্রাক থেকে নামানো হয় বেশ কয়েকটা খাঁচা। লাঠির মাথায় বড় বড় জাল। আর লম্বা লম্বা লোহার সাঁড়াশি। তারা রাস্তার কুকুরগুলোকে খাবার দেয়। গাঁয়ের সব কুকুর লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে আসে সেই খাবার খেতে। এই মজার দৃশ্য দেখতে বটতলায় ভিড় বাড়তে থাকে। তাদের কারও কারও নজর ট্রাকের দিকে। গাঁয়ের মানুষদের জন্যও খাবার আছে কিনা তা খুঁজতে থাকে। ট্রাকে আসা লোকগুলোর ভেতর থেকে নেতা গোছের একজন ঘোষণা দেয়, কুকুরগুলো তারা নিয়ে যাবে। এগুলো গাঁয়ের পরিবেশ নষ্ট করছে। খবরের কাগজে ছবি ওঠায় দেশের দুর্নাম হচ্ছে। তাই গাঁয়ে কোনো বেওয়ারিশ কুকুর রাখা হবে না। তারা একটা একটা করে কুকুর জালে আটকে সাঁড়াশি দিয়ে ধরে ইঞ্জেকশন দেয়। তারপর খাঁচায় ভরে ট্রাকে তুলে নেয়। গাঁয়ের মানুষরা কেউ কেউ আহা-উহু করে। কেউ কেউ আপদ বিদায় হচ্ছে ভেবে খুশি হয়। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। তবে সরকারি কাজ ভেবে কেউ কোনো বাধা দেয় না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুকুর ধরার নতুন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওর ধারা বিবরণীতে গাঁয়ের নাম আর লক্ষ্মীর নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এমন সময় একদিন বটতলায় খবর আসে শহরের রেস্টুরেন্টে খাসির মাংস বলে কুকুরের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে। খবরের কাগজে সেই খবর ছাপা হয়। টেলিভিশনে দেখানো হয়। আবার সরকারি অফিসের গাড়ি আসে বটতলায়। ক্যামেরা নিয়ে শহর থেকে সাংবাদিক আসে। সবাই জানতে চায় কারা গ্রাম থেকে কুকুরগুলোকে তুলে নিয়ে গেল। ভিডিওতে কুকুর তুলে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ছবি আছে। ট্রাকের ছবি আছে। অথচ কেউ তাদেরকে চিনতে পারে না। সবাই ধারণা করে তাদের গাঁয়ের কুকুরগুলোকে শহরের রেস্টুরেন্টে বিক্রি করে দিয়েছে। এই প্রথম গাঁয়ের মানুষগুলোর বুকের ভেতরে কুকুরগুলোর জন্য একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। তাদের এই বুকভরা কষ্টের সামনে একমাত্র ভরসা হয়ে দেখা দিল একটা ল্যাংড়া খেঁকি কুকুর। কুকুর-ধরাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া গাঁয়ের একমাত্র কুকুর। ট্রাক যেদিন এসেছিল সেদিন ভাঙা ঠ্যাং নিয়ে সে আর বটতলা পর্যন্ত আসতে পারেনি। গাঁয়ের লোকেদের কাছে আরও একটা সুখের খবর হল, খেঁকি কুকুরটা পোয়াতি। কয়েকদিন পরেই গণ্ডাখানেক বাচ্চা দেবে।

বিষ্টুর মা সব কিছু শুনে বলল, কীসে ভালো কীসে মন্দ তা কি মানুষ বলতি পারে? দ্যাখো কাণ্ড, কোন হতভাগা খেঁকির ট্যাংটা ভেঙেছিল তাই বেঁচে গেছে। তা না হলে তো এতোদিন মানুষের পেটে চলে যেতো। কথাটা বলেই বিষ্টুর মা-র পেটের ভেতরে গুলিয়ে ওঠে। বলে, ছি ছি ছি! মানুষ এখন রাস্তার কুকুর ধরেও খাওয়া শুরু করেছে। কালে কালে আরও কত কী দেখব!

গাঁয়ের কেউ কেউ বিষ্টুর মাকেও সান্ত্বনা দিয়ে বলল, এই তো আর ক’টা দিন সবুর কর। খেঁকি বিয়ালেই আবার কত কুকুর হয়ে যাবে।

গাঁয়ের লোকেরা যখন এমন একটা পোয়াতি কুকুর নিয়ে বেশ খুশি খুশি মনে দিন কাটাচ্ছে, ঠিক সেই সময় আরেকজন পোয়াতি গাঁয়ে এসে হাজির হলো। ভূত দেখার মতো সবাই যেন চমকে উঠল। প্রথমত তারা খুশি হলো এই ভেবে যে, লক্ষ্মী এখনও বেঁচে আছে এবং আবার গাঁয়ে ফিরে এসেছে। পরক্ষণে সবার মুখ চুন হয়ে গেল। কোথা থেকে একটা পাপ পেটে করে নিয়ে এসেছে। কথা বলতে পারলে হয়তো জানা যেতো কীভাবে কী ঘটল। এখন এই পাপ গাঁয়ে রাখা হবে কিনা তাই নিয়ে সালিশি ডাকা হলো বটতলায়।

গাঁয়ের লোক বেশিরভাগই লক্ষ্মীকে গাঁ থেকে বের করে দেয়ার পক্ষে। তারা গাঁয়ে কোনো আপদ পুষে রাখতে চায় না। অনেকের ধারণা এতে গাঁয়ের অমঙ্গল হবে। অনেকে বলল, কত দূরগাঁ থেকে লোক আসে সাধুবাবার কাছে। তাদের মুখে মুখে এই কথা রটে যাবে অন্য গাঁয়ে। তখন গাঁয়ের দুর্নাম হবে। শুধু মোড়লের দুই বাঁজা বউ আর বিষ্টুর মা জেদ ধরল, লক্ষ্মী গাঁয়েই থাকবে। কোথাও যাবে না।

সালিশের দিন বটতলা এসে সবাই দেখল সাধুবাবা নেই। নেই মানে নেই। তল্পিতল্পা নিয়ে উধাও। কেউ কেউ বলল, হয়তো কোথাও গিয়েছে। আবার ফিরে আসবে। কেউ কেউ নানান যুক্তি দিয়ে বলল, সে আর ফিরে আসবে না। কেউ কেউ মনে মনে লক্ষ্মীর সালিশের সঙ্গে সাধুবাবার উধাও হওয়ার কোন সম্পর্ক আছে কিনা ভাবতে থাকল। তারা শুধু ভাবতেই থাকল। মুখে কিছু বলল না। সালিশে যা বলার তা বিষ্টুর মা বলল। সে বলল, লক্ষ্মীর দায়িত্ব আমি নিলাম। দেখি পাগলিকে কে গাঁ থেকে বের করে। দুই বাঁজা বউয়ের কথা মতো মোড়লও সমর্থন দিল বিষ্টুর মাকে। বলল, মেয়েটা ছোটবেলা থেকে এ গাঁয়ে আছে। কালা-বোবা মানুষ। সাত-আট মাস আগের ঘটনা। তখন হয়তো সে এই গাঁয়েই ছিল। সাধুবাবার কাছে কত মানুষের আনাগোনা ছিল। আবার সরকারি লোকেরা নিয়ে যাওয়ার পর এই ঘটনা ঘটেছে এমনও হতে পারে। ঘটনা যেভাবেই ঘটুক লক্ষ্মীর তো কোনো দোষ নেই। যে দোষ করেছে তাকে যখন আমরা খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে পারছি না, তখন লক্ষ্মীকে গাঁ থেকে বের করে দেয়াটা ঠিক হবে না। তাছাড়া পুলিশের কাছে গেলেও সে কিছু বলতে পারবে না। তখন তদন্তের নাম করে পুলিশ হয়তো গাঁয়ের লোকদের ঘাড়েই দোষ চাপাবে। উল্টো আমরাই বিপদে পড়বো।

মোড়লের কথার ওপরে আর কেউ কথা বলে না। কয়েক সপ্তাহ পরে মোড়লের বাড়িতে লক্ষ্মীর বাচ্চা হল। মোড়লের বড়বউ আদর করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। বড়বউ মেজোবউ দু’জন মিলে আদরে সোহাগে ভরিয়ে তোলে বাচ্চাটাকে। ছোটবউ দূর থেকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে। দুধ খাওয়ার সময় হলে লক্ষ্মীকে ডেকে দুধ খাওয়ায়। তারপর লক্ষ্মী গিয়ে বিষ্টুর মার বারান্দায় ঘুমায়। লক্ষ্মী দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বাচ্চাটাকে আদর করে। চুমু খায়। এই সবই বাচ্চার পেট ভরা পর্যন্ত। বাচ্চার দুধ খাওয়া শেষ হলেই মোড়লের বউরা বাচ্চাকে লক্ষ্মীর কোল থেকে কেড়ে নেয়। লক্ষ্মী কোনো কোনো সময় বিকট শব্দে চিৎকার করে। বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিতে চায়। কখনও কখনও চুপচাপ বসে ঘুমন্ত বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোড়লের বউরা তখন তাকে তাড়িয়ে দেয়। ইশারায় কাজ না হলে চোখ গরম করে ধমক দেয়। লাঠি হাতে নিয়ে মারের ভয় দেখায়।

বিষ্টুর মা মন্ডলের বউকে বলে, মায়া বাড়াতে দিস না। ছেলের ওপর পাগলির মায়া বেড়ে গেলে আর ছাড়াতে পারবি না। বুকের দুধ বন্ধ করে গরুর দুধ খাওয়ানো শুরু কর।

লক্ষ্মী খড়ের গাদায় বসে বসে কুকুরের বাচ্চার দুধ খাওয়া দেখে। রাতের আঁধার ঘন হলে বন থেকে শেয়াল বেরিয়ে আসে।

মা-কুকুরটা বাচ্চাগুলোকে পেটের তলে লুকিয়ে রাখে আর ঘেউ ঘেউ করে ডাকে। তখন লক্ষ্মী লাঠি হাতে করে শেয়াল তাড়াতে থাকে। শেয়াল তাড়াতে তাড়াতে খড়ের গাদায় ঘুমিয়ে যায়। আর প্রতিদিন বাচ্চার সংখ্যা কমতে থাকে। একদিন মা-কুকুরটাই উধাও হয়ে গেল। কেউ বলল, বন থেকে কোনো বড় জন্তু এসে কুকুরটাকে খেয়ে ফেলেছে। তবে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা কেউ কুকুরটাকে চুরি করে শহরের রেস্টুরেন্টে বিক্রি করে দিয়েছে। তারা এখন খাসির মাংস বলে বিক্রি করবে। তবে সবকিছুর পরেও একটা কুকুরের বাচ্চা বেঁচে গেছে। লক্ষ্মী সেই বাচ্চাটাকে কোলের ভেতরে নিয়ে ঘুমায়। কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ খাবার দিলে কুকুরের বাচ্চাটার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। কিছুদিনের ভেতরে আরও একটা খবর তৈরি হল। কুকুরের বাচ্চাটা লক্ষ্মীর বুকের দুধ খায়। দুধ খেয়ে বাচ্চাটা বেশ নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে। মোড়লের বউ একদিন নিজের চোখে সেই দুধ খাওয়া দেখে ফেলে। তারপর থেকে ছেলের দুধ খাওয়ানোর জন্য আর লক্ষীকে ডাকে না।

কুকুরের বাচ্চা মানুষের দুধ খায়। এই ভিডিও আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। কুকুর পাচারকারীদের নজরে আসে সেই ভিডিও। কুকুরের বাচ্চাটার দেহের গড়ন দেখেই তারা চিনে ফেলে সেটা সরাইলের গ্রে-হাউন্ড জাতের কুকুর। বিদেশে এই জাতের কুকুরের অনেক চাহিদা। অভিজাত লোকেরা বাড়িতে পোষে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ডগ স্কোয়াডে ব্যবহার করা হয় এই জাতের কুকুর।

পাচারকারী চক্রের লোকেরা রাতের অন্ধকারে কুকুরের বাচ্চাটাকে তুলে নিতে আসে। লক্ষ্মী এমনভাবে কুকুরটাকে আগলে রাখে যে, সেটা আলাদা করা যায় না। তাদের দেখে লক্ষ্মী ভয় পেয়ে অদ্ভুত রকমের শব্দ করতে থাকে। গ্রামের লোকদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তারা লক্ষ্মীকেও মুখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেয়।

পথের মাঝে এসে পাচারকারীদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তারা কুকুর পাচারকারী কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে? সামনে ফেরিতে নদী পার হতে হবে। তখন মেয়েটাকে মুখ বেঁধে গাড়িতে রাখা যাবে না। তাছাড়া তারা আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে জেনেছে মেয়েটা বোবা-কালা এবং মাথা খারাপ। ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যাবে না। অধিকাংশের মত মেয়েটাকে মেরে বনের ভেতরে ফেলে দেওয়া। একজন বলল, ফেলে দিলে হবে না। মাটি চাপা দিয়ে যেতে হবে। লাশ গুম করতে না পারলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। কুকুর চুরি করতে গিয়ে মানুষ খুনের আসামী হয়ে যেতে হবে। একজন পরামর্শ দিল ফেরিতে ওঠার আগে নদীর ধারে একটা নিষিদ্ধ পল্লী আছে। সেখানে মেয়েটাকে বিক্রি করে দেয়া যায়। তাতে কিছু টাকা আসবে। মেয়েটা যেহেতু কথা বলতে পারে না তাই কোনো কিছু ফাঁস হওয়ার ভয়ও থাকবে না। খুন করা, লাশ গুম করা, এইসব ঝামেলা থেকেও বাঁচা যাবে। কথাটা সবার পছন্দ হল। টেলিফোনে একজন দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। তারা গাড়ি ঘুরিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীর কাছাকাছি একটা জায়গায় মেয়েটাকে দালালের হাতে তুলে দিল।

দালাল লক্ষ্মীকে নিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীর দিকে রওনা দিতেই কুকুর পাচারকারীদের গাড়ি ফেরিঘাটের দিকে ছুটে চলল।
তখন রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। অদূরে নিষিদ্ধ পল্লীর ছোপ ছোপ অন্ধকারের ভেতর টিম টিম করে কিছু আলো জ্বলছে। যেন সারা রাত জ্বলে জ্বলে আলোগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দালাল লক্ষ্মীর হাত শক্ত করে ধরে হেঁটে চলেছে নদীর ধার দিয়ে। নদী থেকে ঘন কুয়াশা উঠে আসছে ডাঙায়। সেই কুয়াশার ভেতর থেকে দুয়েকজন করে মানুষ বেরিয়ে আসছে। তারা পল্লীতে রাত কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছে ফেরিঘাটে। দালাল লক্ষ্মীর মুখের বাঁধন খুলে দেয়। ঘাট থেকে একটা ফেরি সাইরেন বাজিয়ে তাদের পাশ দিয়ে ভেসে চলেছে। ফেরির একপাশে পাচারকারীদের গাড়িটা কুয়াশা ভেদ করে লক্ষ্মীর নজরে পড়ে। সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। দালাল শক্ত করে লক্ষ্মীর হাতটা চেপে ধরে। লক্ষ্মী একটা বিকট চিৎকার দিয়ে দালালের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। তারপর ফেরীর সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধার দিয়ে দৌড়াতে থাকে। পেছনে দালালও ছুটতে থাকে। তখন কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো উঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎ লক্ষ্মী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পল্লী থেকে ফেরত মানুষেরা মুখের কাপড় সরিয়ে মোবাইলে ভিডিও করার চেষ্টা করে। নদীর তীব্র স্রোতে ভেসে যেতে থাকে লক্ষ্মী। ঠিক সেই সময়ে ফেরি থেকে একটা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। তারপর স্রোতের টানে কুয়াশার আঁধারে হারিয়ে যায় দুটো প্রাণী। মোবাইলের ভিডিওতে আর সে দৃশ্য ধরা পড়ে না।

নদীর ভেতরে ট্রলারে যেসব জেলেরা মাছ ধরছিল তাদের জালে দুটো ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। সূর্যের আলোয় জালে আটকা পড়া রূপালী মাছ চিকচিক করে ওঠে। মোবাইলে ফোনের ভিডিওতে ধরা পড়ে সেই মনোরম দৃশ্য।