মাধ্যমিক পাস করার পর সুমি একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হল নতুন স্কুলে। সে পাড়ার যে স্কুলে পড়ত সেখানেও ছিল একাদশ— দ্বাদশ। তার মায়ের ইচ্ছা ছিল সুমি এখানেই পড়ুক, কিন্তু তার বাবার এক কথা–বড় স্কুলে গেলে পাবে উৎকৃষ্ট পরিবেশ, শেখা জানা দেখার সুযোগ অনেক বেশি। মাধ্যমিকে ভাল নম্বর থাকায় তার ভর্তি হতে অসুবিধাও হয়নি ওই স্কুলে। কিছুদিন ক্লাস হবার পরই স্কুল থেকে ওদের বেড়াতে নিয়ে গেল সায়েন্স সিটিতে। ওদের স্কুল ড্রেস এক, কিন্তু এইদিন বন্ধুদের নানান সাজসজ্জা দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। কেউ কেউ আবার ইমিটেশনের রকমারি সাজে সজ্জিত। সুপর্ণার ইমিটেশনের হারটা সুমির চোখে লাগে। ও তখনই মনস্থ করে ওই রকম একটা হার কেনার। টিফিনের জমানো পয়সা থেকে সুপর্ণা মারফৎ ওইরকম একটা হার কিনে ফেলে কয়েকদিন পর। হারটা তার মাকে দেখাতেই তার মা বলে— ভালই করেছিস, যখন বাজার-টাজার যাবি অথবা গানের স্কুলে যাবি তখন পরে যাবি। কিন্তু হার কেনার কথাটা তার বাবার কানে যেতেই তিনি রেগে আগুন।
এমনিতেই সুমির বাবা সোজা কথার লোক, কোনও মেকি ব্যবহার তার নেই। এহেন মানুষের কাছে নকল জিনিস পরিতাজ্য। তাঁর বক্তব্য, নকল জিনিস ব্যবহার ভিন্ন রুচির পরিচায়ক। আবার যখন শুনলেন, মেয়ে তার সহপাঠিনীদের দেখে এই হার কিনেছে, তখন তো আরও রেগে গেলেন। তিনি মেয়েকে বললেন— তোমাকে কি এসব জিনিস দেখার জন্যই ওখানে ভর্তি করেছি। অন্যের জিনিস দেখে আকৃষ্ট হওয়া যে ঠিক নয় সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিলেন মেয়েকে। এভাবে বাবার কাছে বকা খাবে সুমি ভাবতে পারেনি, তার চোখ দিয়ে জল এসে গেল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও শুরু করে দিল। তার কান্না দেখে তার মা, বাবার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিলেন। বললেন, মেয়েটা করেছেটা কী! টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে না হয় একটা হারই কিনেছে, তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হল? ওর আছেটা কী, কেবল একজোড়া ছোটো কানের দুল ছাড়া! মেয়ে বড় হচ্ছে ওর তো ওসব পরতে মন চায়। দিয়েছ কি কিনে সোনার কিছু জিনিস! সুমির মায়ের বলার মধ্যে ছিল তীব্র ঝাঁজ, সুমির বাবা প্রচণ্ড রেগে গেলেন, তার সম্মানে ঘা দিয়ে কথা! কিন্তু চেঁচামেচি আর করলেন না। রাগ পুষে নিয়ে তিন দিন বাদে কো-অপারেটিভ থেকে লোন নিয়ে মেয়ের জন্য নিয়ে এলেন দেড় ভরির সোনার হার। সুমির আনন্দ আর ধরে না, মনে মনে ভাবল, একটু বকা খেয়েছি বটে, তবে নকল ইমিটেশনের হারটা না কিনলে কি আর আসলটা পাওয়া যেত!
হার কেনার কিছুদিন পর সুমি শুনল এলটিসি-র পয়সা নিয়ে এবার গ্রীষ্মে বাবা বদ্রী যাবার জন্য মনস্থির করেছে। সে আরও শুনল এবার তাদের সঙ্গে যাচ্ছে দাদু-ঠাকুন। সুতরাং ট্যুরটা যে জমবে সেই ভেবে সে উত্তেজনায় ছটফট করতে লাগল। অবশেষে এল সেই দিন। হাওড়া থেকে উপাসনা এক্সপ্রেস ধরে হরিদ্বার। হরিদ্বারে দু’দিন থেকে যাবে বদ্রী। সুমির বাবা একটা গাড়ি ভাড়া করেছে। সকালে গাড়ি ছেড়ে রাত্রে রুদ্রপ্রয়াগে তারা হল্ট করে। রুদ্রপ্রয়াগ জায়গাটা সুমির খুব ভালো লাগে। চারপাশ ঘিরে সমুন্নত পর্বতশ্রেণী, আর এরই মাঝে দুই নদী অলকানন্দা ও মন্দাকিনী, এই দুইয়ের সঙ্গমস্থল। সুমি ফলকগাত্র পড়ে জানতে পারে এই সঙ্গমে দেবর্ষি নারদ সঙ্গীত সাধনায় বসে বীণা বাজাতেন। পরের দিন সকাল দশটায় রুদ্রপ্রয়াগে স্নান ব্রেকফাস্ট করে তারা সন্ধেয় যোশীমঠে পৌঁছায়। এই যোশীমঠেই বদরীকে এনে শীতকালে পূজা হয়। ভরপুর শীতে বদ্রী সাদা বরফে ঢাকা থাকে। বদ্রীতে একরাত থেকে ফেরার পালা। ফেরার সময়ও তারা রুদ্রপ্রয়াগেই হল্ট করে। পরের দিন সকালে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে বেরিয়ে যখন চামেলির পথে তখন সুমির বাবার মোবাইল বেজে ওঠে। সুমির বাবা গোলকবাবু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফোন করেন না, সেই হিসেবে তাঁর ফোন আসেও কম। ফোনটা ধরতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তাঁর চোখ মুখের ভাব বদলে যায়, সুমির কাকার ফোন। সুমির বাবার মুখ থেকে শোনা যায়— কী বলছিস, দুপুুরে চুরি? সব লণ্ডভণ্ড! পুলিশে খবর দিয়েছিস?
পুলিশ এসেছিল! ফোন চলাকালীনই সবাই বুঝল ওদের না থাকার সুযোগে চোরেরা ওদের ঘরের তালা ভেঙে চুরি করে নিয়ে গেছে সব। ঘরে থাকার মধ্যে ছিল কেবলমাত্র সুমির কাকু, কিন্তু কাকু অফিস যাওয়ায় দুপুরে ঘর ফাঁকা, দেখাশোনার কেউ নেই, এই সুযোগটাই চোরেরা নিয়েছে। দাদু- ঠাকুন হায় হায় করতে লাগলেন। সুমির বাবা বললেন, ‘এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখার সময়, প্রথমে আমাদের রিজার্ভেশন ক্যান্সেল করতে হবে, তারপর দেখতে হবে টিকিট। কেননা আজ রাতের মধ্যেই রওনা দিতে হবে। হরিদ্বারে পৌঁছে সেই মতই ব্যবস্থা হয়। টিটই-কে বলে প্রতিবন্ধীর কামরায় চড়ে বসে রাতের ট্রেনে।
সুমির মায়ের যেটুকু সামান্য গহনা আছে তার সবটাই লকারে, শুধু হাতের দু’গাছা চুড়ি এবং কানেরটা ছাড়া। কিন্তু সংসারে আরও আছে কত কী! সদ্য কিনে দেওয়া সুমির হার, কিছু নগদ টাকা, ঠাকুরঘরের রুপোর জিনিস ইত্যাদি। কাকুর পকেটে ছিল ৮ হাজার টাকা, ছোটোকাকু ফোনে জানিয়েছে সেটা চোরেরা নিয়ে গেছে, আর কী কী নিয়ে গেছে সেটা ছোটো কাকুর জানার কথা নয়। কাজেই কী কী গেছে এই টেনশনে ট্রেনে কেটে গেল সময়। তবে সুমির হারটা যে চোরে নিয়ে গেছে এই নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই, কেননা আলমারিটা ভাঙা সেটা জেনেছে ফোনেই।
বাড়িতে পৌঁছেই সুমির মা দেখে বাসনপত্র প্রায় নেই, ঠাকুরঘরের জিনিসও ফাঁকা, সুমির ঘরে এসে বলে, হায় হায় সুমির হারটা নেই। তিনি নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন, কেননা সুমি ওটা পরে যেতে চেয়েছিল, তিনিই বারণ করেছিলেন। হারটা আলমারির মধ্যে গিফট বাক্সে ছিল, সঙ্গে ছিল বিল, বাক্সটা নিয়ে গেছে চোরেরা। সুমির বাবা বলল, চোর মনে হচ্ছে চেনা চোর, কেননা কোন জামা কাপড় নেয়নি। শুধু তাই নয়, সুমির বাবার বইয়ের মধ্যে টাকা রাখা স্বভাব, চোরেরা বইপত্র লণ্ডভণ্ড করে গেছে। সুমি এতক্ষণ বাথরুমে হাত মুখ ধুতে ব্যস্ত ছিল। হাত মুখ ধুয়ে ধীর পদক্ষেপে উঠে আসে ওর ঘরে।
তার পড়ার টেবিলের কাছে এসে আশ্বস্ত হয়, সুমির মনে হয় পেনের বাক্সটা যথাস্থানেই আছে। তার চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। দ্রুত পেনের বাক্সটা খোলে। পেন গুলো সরিয়ে দেখে যেভাবে রেখেছে ঠিক সেভাবেই জ্বলজ্বল করছে তার সোনার হার। হারটা নিমেষেই তুলে নিয়ে বলল, মা এই দেখো! সুমির মা তো অবাক, সে তো হারটা আলমারিতে রেখেছিল। সুমি বলল, যাওয়ার আগে আসল হারটা আমি ওখান থেকে সরিয়ে আমার পেনের বাক্সের তলায় রেখে দিই, প্রথমে হার, তারপরে সব পেনগুলো, হারটা চাপা পড়ে। পরে নকল হারটা নতুন বাক্সে রাখি। চোরেরা আলমারির মধ্যে রাখা নতুন বাক্সে চকচকে হারটা দেখে ওটাই আসল ভেবে নিয়ে গেছে। সুমির বাবা স্নেহের হাসি হেসে মেয়ের দিকে তাকালেন। নকল হার কেনার জন্য কী বকুনিটাই দিয়েছেন মেয়েকে। সেই নকলই বাঁচিয়েছে আসলকে, মনে মনে মেয়ের বুদ্ধির তারিফও করলেন। শুধু অনুকরণ নয়, তাঁর মেয়ের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশও ঘটেছে এটা অনুধাবন করে খুশি হলেন খুব। চুরির দুঃখ কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ল মেয়ের বুদ্ধিমত্তায়।