সাফল্যের উচ্ছ্বাসে যেমন ব্যর্থতার মেঘ কেটে যায়,তেমনই তার কৃতিত্বের উদযাপনে গোপন ষড়যন্ত্র বেরিয়ে পড়ে। যা প্রমাণের অভাবে সংগোপনে থেকে যায়, তাই কৃতিত্বের জাহিরে গভীর সত্য প্রকাশে বিস্মিত করে। সেক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র অন্তর্ঘাতই কৃতিত্বের নামাবলিতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের তীব্র গণআন্দোলন থেকে ৫ আগস্ট আকস্মিক ভাবে হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার মধ্যে যেভাবে গণঅভ্যুত্থানের পরিচয় মেলে, তাতে বিরোধী দলের সংযোগ থেকে মৌলবাদীদের যোগসাজশ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলেও তা নিয়ে বিতর্কের পরিসর সেভাবে সোচ্চার লাভ করেনি। উল্টে দ্বিতীয় বার স্বাধীনতা লাভে গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের কথাই সোস্যাল মিডিয়ায় ভেসে ওঠে।
গণউন্মাদনায় শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি যেভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তার মধ্যেও সেই সন্দেহ অচিরেই আত্মগোপন করে। স্বাভাবিকভাবেই গণঅভ্যুত্থানের পরিচয় যখন জনমানসে বদ্ধমূল হয়ে উঠছে, সেই পরিসরে তার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হয়ে গেল সে দেশেরই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচ্ছ্বসিত কৌতূহলোদ্দীপক বক্তব্যের মাধ্যমে। আমেরিকা সরকারি সফরে গিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’-এর অনুষ্ঠানে সরাসরি শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করানোর নেপথ্যে যে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিল, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুহাম্মদ ইউনূস আবেগপ্রবণ হয়ে সোৎসাহে তা নাটকীয়ভাবে একের পর এক দৃশ্যের অবতারণা করে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন। এ দেশে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সংবাদে তাঁর কথায় গোটা আন্দোলনটিই আদতে ‘চমৎকারভাবে পূর্ব পরিকল্পিত’। বর্তমানে তাঁর বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত মাহফুজ আলমকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে সে দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘এই মাহফুজ গোটা আন্দোলনের ‘নেপথ্যের মস্তিষ্ক’, নিজে স্বীকার করে না।’ প্রসঙ্গত, মাহফুজ আলম নিষিদ্ধ ইসলামি জঙ্গি সংগঠন হিযবুতের নেতা হিসেবে পরিচিত। এছাড়া ইউনূস তাঁর সফরসঙ্গী দুজন সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে নিযুক্ত সুচিস্মিতা তিথি ও নাইম আলিকেও মঞ্চে তুলে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁরা দুজনেই ঢাকার দুটি সংবাদপত্রের সাংবাদিক ছিলেন। দুজনেই যে পরিকল্পনামাফিক অসত্য খবর ও গুজব ছড়িয়ে ছিলেন, সে কথাও ইউনূস পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই ইউনূসের কথায় যে বিস্কোরণ ঘটেছে, তার শব্দ যে নিউ ইয়র্ক থেকে দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে, তা বলাই বাহুল্য। সেই বিস্কোরণে সবচেয়ে আঘাত হানবে যে তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে তা নিয়ে আগের সন্দেহ সত্যের পথে ধাবিত হয়ে সে দেশের জনমানসে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, তা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, নেপথ্যের গভীর ষড়যন্ত্রের পরিচয়ে নানা যোগসূত্রের ঐক্যের প্রতি লক্ষ্যভেদী দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার এখন শুধু তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়।
বাংলাদেশের আকস্মিক পটপরিবর্তনে অনেকের চোখেমুখেই বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল। কেউ ভাবতেই পারেনি এভাবে এত দ্রুততার সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হবে। এর আগে এরকম দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ২০২২-এর জুলাই-এ শ্রীলঙ্কার তীব্র জনরোষে সে দেশের সরকার পড়ে যাওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বকে বিস্মিত করেছিল। সেই বিস্ময়ের মধ্যে গণশক্তির প্রকাশে দেশের সরকারের অসহায়তার ছবি জনমানসে তীব্র প্রভাব বিস্তার করে। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আক্রমণে স্বেচ্ছাচারী শাসকের অস্তিত্ব কীভাবে বিপন্ন হতে পারে তা জলজ্যান্ত প্রমাণে শ্রীলঙ্কার দৃষ্টান্ত সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলে। সে দেশের দ্রুত উন্নয়নের পটপরিবর্তনেও দেশের মানুষের সক্রিয় উদ্যোগও সেই দৃষ্টান্তে রোল মডেল হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, ২০২৪-এর জুলাই-এর মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের চাকরিতে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গণআন্দোলনে রূপান্তরের সময়েও সমাজমাধ্যমের শ্রীলঙ্কার মতো ঘটার চেতাবনি ছড়িয়ে পড়ে।
সেক্ষেত্রে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই অতিদ্রুততার সঙ্গে সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের রূপ লাভ করে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলা মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় চাকরির বিরোধিতা ২০১৮ থেকে শুরু হলেও সেভাবে দেশজুড়ে প্রতিবাদী আন্দোলনের ঝড় তুলতে পারেনি। অন্যদিকে সেই ঝড় যখন সারা দেশজুড়ে প্রলঙ্করী রূপে ছড়িয়ে পড়ল, তখন এদের বাঙালিরও সমর্থন পেয়েছিল। তা যে অতিদ্রুততায় বিধ্বংসী আকার ধারণ করে গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করে সরকার উৎখাতে মরীয়া হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে আকস্মিক পটপরিবর্তনে অনেকেই অঙ্ক মেলাতে না পেরে সরকারের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অপশাসনের ধারণাকে পুঁজি করে নিলেও, মনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে চাকরিতে কোটা বিরোধিতা সরকার যেমন মেনে নিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টের রায়েও তা প্রতিফলিত হয়েছিল।
তারপরেও তার অজুহাতে সারা দেশজুড়ে আন্দোলন চলে, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ থেকে জেল ভেঙে জঙ্গি ও অপরাধীদের মুক্তি প্রদান, বিপুল পরিমাণে নরহত্যার আয়োজন সবই চলতে থাকে। এককথায় সেই আন্দোলনটির গণআন্দোলনের কায়দায় শেখ হাসিনা সরকারের উৎখাতে সামিল হয়। শুধু তাই নয়, কালক্ষেপ না করে পূর্ব নির্ধারিত ৬ আগস্টের একদিন আগেই রাজধানী অভিমুখে সেই আন্দোলনের অভিযান সফলতা লাভ করে। সেদিক থেকে এতবড় সাফল্যকে পূর্ব পরিকল্পিত বলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান যেভাবে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গণআন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে অস্বীকার করেছেন, তা শুধু মাত্র বিস্কোরণ নয়, ভয়ঙ্কর সত্যের অবতারণা। তার আরও ভয়াবহ পরিণতি বর্তমান সে দেশের প্রতিশোধের রাজনীতির মধ্যেই প্রতীয়মান।
অন্যদিকে ড. ইউনূস ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। সেই প্রতিষ্ঠানে অনেক টাকা অনুদানও দিয়েছেন তিনি। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি হিলারি ক্লিনটনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার সঙ্গে ইউনূসের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ততা লাভ করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি-র দায়িত্ব থেকে তাঁকে পদত্যাগের চাপ দিলে তিনি তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি হিলারি ক্লিনটনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর আর্থিক ঋণ বন্ধ করার অভিযোগে সেই তিক্ততা বিষাক্ত হয়ে ওঠে। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পরিসরেও শেখ হাসিনার তাঁকে পদ্মায় দুবার চুবানোর কথাও স্বয়ং ইউনূস সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেদিক থেকে দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শত্রু মনোভাবের পরিচয় অত্যন্ত প্রকট। সেক্ষেত্রে শত্রু দমনের আনন্দ স্বাভাবিকভাবেই সাফল্যের উচ্ছ্বাস তীব্রতর হয়ে ওঠে। তখন বৈধ-অবৈধের চেয়ে দমনের আনন্দ কৃতিত্বের আস্ফালনে পরিণত হয়। তার সঙ্গে যদি কৃতজ্ঞতার সংযোগ আন্তরিক হয়ে ওঠে, তা হলে তো কথাই নেই। আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনেও সেই বিস্কোরক কথা প্রত্যাশিত মনে হয়। ইউনূসের কথার সত্যতায় আরও একটি রহস্যের যোগসূত্র মেলে। অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে ‘মৃতদের পাহাড়’-এর বেশিরভাগ মানুষই মারা গেছে এমন বুলেটের আঘাতে যা বাংলাদেশের পুলিশ কখনও ব্যবহার করে না। অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাক্তন সেনাকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেন সরেজমিনে তদন্ত করে সেকথা জানিয়েছেন। সেই বুলেটগুলি আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। বিপুল পরিমাণ বিদেশি বুলেটে প্রাণ হারানোর কথা আজ প্রকাশ্যে এলেও সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলি না চালানোর নির্দেশ না দেওয়ার কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি বা বিশ্বাস করেনি। শুধু তাই নয়, বিধ্বংসী আন্দোলনের নেপথ্যে আমেরিকার সংযোগের কথা বারবার বললেও কেউ সেভাবে শোনেনি তাঁর কথা। এখন সত্য সামনে এলেও দেশের জনগণকে ভুলের মাসুল গুনতে হচ্ছে অসহায়ভাবে। ক্ষমতা সক্ষমের অর্জন, অক্ষমের উপার্জন। সেই উপার্জনের সিংহভাগ লাভ হয় অবৈধ পথে। তার স্থায়িত্ব কখনওই দীর্ঘস্থায়ী ও ফলপ্রসূ হতে পারে না। অবৈধ পথের সাফল্য মিললেও তা যেমন স্থায়ী হতে পারে না,তেমনই বৈধতাও লাভ করে না। কেননা বৈধতার পথেই তার ভয়, তার হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক। সেই ভয় থেকেই অবৈধ পথে ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই যত আত্মঘাতী থেকে আত্মবিনাশী হয়ে ওঠে, ততই তা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। ড. ইউনূস গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারকেই প্রকারান্তরে ক্ষমতায় ফিরে আসার হাতছানি দিলেন। মুক্তিযোদ্ধার দেশ স্বাধীন বাংলাদেশ স্বতঃস্ফূর্ত গণতন্ত্রের পথেই বাঙালির মাতৃভাষা থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার শপথে চরৈবেতি মন্ত্র লাভ করেছে। তাকে ষড়যন্ত্র করে থামানো যায়, আটকে রাখা যায় না। এখন শুধুই সময়ের প্রতীক্ষা।