• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

উঠল বাই তো পাহাড় যাই

অপূর্ব সুন্দর চা বাগানে সাজানো রাস্তার দু’পাশ। ছোট ছোট গোল টিলাগুলো ঢাকা চা বাগিচার সবুজ কার্পেট দিয়ে। এমনই পথের প্রান্তে এক ছুটির ঠিকানা ওকায়টি টি এস্টেট। সন্ধান দিলেন গৌরী ঘোষ।

প্রতি মাসে অন্তত একবার পাহাড়ে যেতে না পারলে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে শরীর-মন। পাহাড়ের নেশা একবার যদি পেয়ে বসে তাহলে তাকে বাগে আনা কারোরই কম্ম নয়। তখন শরীর-মনের একমাত্র দাওয়াই পাহাড়। তাই শনি-রবি দেখে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। ঠিক হল শনিবারে গিয়ে রবিবারে ফিরব, তাই শিলিগুড়ি থেকে খুব বেশি দূরে না যাওয়াই শ্রেয়।

এক পর্যটনপ্রাণ দাদা খোঁজ দিলেন একটি নতুন জায়গার। থাকার ব্যবস্থাও উনিই করলেন। প্রতি মাসে যাদের ঘোরার নেশা তাদের উপার্জন বিপুল না হলে পকেটের দিকেও একটু নজর রাখতে হয়। তাই বাজেট ভ্রমণের জন্য আমার ‘লাইন গাড়ি’-ই বেশি পছন্দের।

এই শাটল গাড়িগুলির কতকগুলি সুবিধাও রয়েছে। গাড়িতে একবার চড়ে বসলেই হল, আর চিন্তা নেই। দক্ষ চালক চোখ বন্ধ করে আপনাকে গন্তব্যে পৌছে দেবেন, যেহেতু একই পথে এঁদের নিত্য আসা যাওয়া। দ্বিতীয়ত, গাড়ি রাখার জায়গা, চালকের থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি কোনও জটিলতা নেই। তৃতীয়ত, নিজের গাড়ি নিয়ে গেলে সর্বক্ষণ গাড়ির চিন্তাও কাহিল করে মালিককে, সঙ্গে খাটুনি তো আছেই।

যাই হোক, নির্ধারিত দিনে সকাল সকাল প্রাতঃরাশ সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। শিলিগুড়ি জংশন থেকে গাড়ি ছাড়তে দেরি থাকায়, টোটো করে চলে গেলাম দার্জিলিং মোড়। হাতে সময় অকুলান। দিনটাকে যাতে পুরোপুরি উপভোগ করা যায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। দু’জনের জন্য তিনটি সিটের ভাড়া দিয়ে (জনপ্রতি ২০০ টাকা) গাড়িতে উঠে বসলাম। শেষের সিট, তবুও মন্দ নয়। খুব আরামদায়ক না হলেও কষ্টকর তো একেবারেই নয়। শুধু জানা আছে মিরিক পার করে ফটকে নামতে হবে, গন্তব্য ওকায়টি টি এস্টেট।

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ গাড়ি ছাড়ল। শুকনার জঙ্গল পার করে গাড়িধুরা হয়ে রোহিণী ওঠার রাস্তাকে ডানহাতে ফেলে রেখে, গাড়ি এগিয়ে চলল মিরিকের দিকে। অপূর্ব সুন্দর চা বাগানে সাজানো রাস্তার দু’পাশ। ছোট ছোট গোল টিলাগুলো ঢাকা চা বাগিচার সবুজ কার্পেট দিয়ে। চোখ জুড়িয়ে যায় প্রতিটি বাঁকের অপরূপ সৌন্দর্যে। সৃষ্টিকর্তার এ যেন হাতে সময় নিয়ে আঁকা এক নিখুঁত চিত্রপট।মন ভরে ওঠে অনাবিল আনন্দ এবং শান্তিতে। মুহূর্তে মিলিয়ে যায় জীবনের ক্লান্তি। অসহ্য গরমের শেষে পাহাড়ের ফুরফুরে বাতাসে নিমেষে চাঙ্গা হয়ে ওঠে শরীর-মন।

কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি পার করল চিরপরিচিত মিরিক লেক আর তার কিছুটা পরেই আমরা এসে দাঁড়ালাম ওকায়টি টি এস্টেট–এর ফটকে। সুদৃশ্য ফটক এবং পাশেই বাগানের নিজস্ব আউটলেট। বেলা তখন একটা। যিনি খোঁজ দিয়েছিলেন এই অফবিট জায়গার সেই দাদা আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। পিঠে ব্যাগ নিয়ে দুই বন্ধু তাঁকেই অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম আমাদের পাহাড়ি আস্তানার দিকে।

মূল রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে তিনশো মিটারের মতো যেতে হয়। নিরিবিলি গ্রাম্য পথ,তবে এই রাস্তাটুকু চাইলে কেউ গাড়িতেও আসতে পারেন। এই পথ সোজা চলে গেছে মেচি নদী পর্যন্ত, নদী পেরোলেই নেপাল। রাস্তার বাঁহাতে একটি নির্মীয়মান দোতলা বাড়ি পার করে উঠোনের শেষে পাহাড়ের একেবারে ধারে ছোট্টো কটেজটি দেখিয়ে দাদা জিজ্ঞাসা করলেন, দেখুন তো পছন্দ হয় কি না!

আমরা ঘরে ঢুকে সমস্ত দেখে শুনে উচ্ছ্বসিত হলাম। প্রয়োজনীয় আসবাবে গোছানো বেশ বড় ঘরটি, সঙ্গে একটা বিশাল বাথরুম,পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। হোম-স্টের মালকিন ছোটো ছোটো গাছে উঠোন সাজাচ্ছিলেন, উঠে এসে কথা বললেন। বাড়ির মেয়েরা চা নিয়ে এলেন আমাদের জন্যে। চা-বিস্কুট খেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম দুই বন্ধু।

দীর্ঘ ৩০ বছরের বন্ধুত্বে এটাই আমাদের প্রথম এক সঙ্গে বেড়াতে আসা তাই গল্পও বিস্তর। দুটো নাগাদ খাবারের ডাক পড়ল। উঠোনের অপর প্রান্তে নির্মীয়মান বাড়ির দোতলায় রান্না ঘর এবং চারদিক খোলা খাবার জায়গা। দোতলায় উঠে দাঁড়াতেই মন ভরে গেল, অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে তার বিস্তার। সামনে নেপালের অংশের হিমালয় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘেরা খেলে বেড়াচ্ছে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। ছবি তোলা চলল কিছুক্ষণ।
এরপর এল দুপুরের খাবার। থালায় সুন্দর করে পরিবেশন করা ভাত। কিন্তু সাদা ভাতের মধ্যে হলুদ হলুদ এগুলো কী! তবে কি চালের সঙ্গে ডালও সেদ্ধ করেছে? বাড়ির মেয়েরা বললেন, এ হল অথেন্টিক নেপালি খানা। ডাল নয়, চাল আর ভাঙা মকাই(ভুট্টা) দিয়ে তৈরি এই বিশেষ রকমের ভাত। সঙ্গে ছিল ডাল, পাঁপড়, লাল শাক ভাজা আর ডিমের ঝোল— সবই পাহাড়ি কায়াদায় রান্না করা। সুস্বাদু তো বটেই।

খাওয়া দাওয়া শেষ করতে প্রায় তিনটে বাজল। আমার ইচ্ছে ছিল ঘরে গিয়ে গা এলিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বন্ধু চাইছে আশপাশটা ঘুরে দেখতে, তাই বেরিয়ে পড়লাম। পথ প্রদর্শক সেই দাদা। গ্রামের পথ ধরে মূল রাস্তায় এসে সোজা হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। ছবির মতো জায়গাটা। রাস্তার পাশে মাঝে মাঝেই সুন্দর করে সাজানো ছোট ছোট চায়ের দোকান।
হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম গোপালধারা টি এস্টেট পর্যন্ত। এই জায়গাটা বেশ জমজমাট। রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় হোম-স্টে, তবে ভিড় তেমন বেশি নয়। যেদিকে তাকাই শুধু ক্যামেরাবন্দী করতে ইচ্ছে করে সেসব দৃশ্য। ক্রমে বিকেল নেমে আসে। আকাশে মেঘ ছিল সকাল থেকেই। মনে হল বৃষ্টি নামবে। পা চালিয়ে নীচের দিকে নামা শুরু করতেই বৃষ্টি শুরু হল। ব্যাগে ছাতা থাকলেও কেউই সঙ্গে নিয়ে বেরোইনি। অগত্যা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম।

এই ওকায়টি বাগিচার চা পরিবেশন করা হল আমাদের। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় এই চা। দেড়শো বছরেরও পুরনো এই চা বাগান। এদের নিজস্ব বাংলো আছে তবে সেসব আমাদের সাধ এবং সাধ্যের বাইরে। এদিকে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই, শিরশিরে বাতাসে ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করল। চা চলল পর পর কয়েক কাপ ।

বৃষ্টি একটু ধরতেই পা চালিয়ে হোম-স্টে তে ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে পাহাড়ে সন্ধে নেমে গেছে। বৃষ্টির পরে শীতটাও হঠাৎ জাঁকিয়ে পড়েছে। ঘরে ফিরে গরম কাপড় গায়ে চড়িয়ে, গিয়ে বসলাম দোতলার খোলা খাবার জায়গায়। আবার বৃষ্টি শুরু হল। উল্টোদিকের পাহাড়ে কখনও আলো জ্বলে উঠছে আবার কখনও লোডশেডিং হয়ে গোটা পাহাড় অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মুহুর্মুহু।

গরম গরম তেলেভাজা আর শরীর গরম রাখার এক রকম বিশেষ তিব্বতি ঘি মিশ্রিত মশলা চা (ঘোলে চা) সহযোগে সন্ধেটা জমে ক্ষীর। বাড়তি পাওনা হল পাহাড়ি মানুষদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডা। বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল বলে মেয়েরাই রান্না ঘরে ডেকে নিলেন আমাদের। খেতে দিলেন নিজেদের জন্যে তৈরি করা ভাজাভুজি যা আমাদের মোটেও পাওনা নয়। জানতে পারলাম এখানকার বেশির ভাগ মানুষই এই চা বাগান এবং পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।
গল্পে কথায় বন্ধুত্ব হয়ে গেল সকলের সঙ্গে। জানলাম, এখানে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্যে সবাইকে শিলিগুড়িতেই আসতে হয়। আরও জানলাম সমতলের মিষ্টি এদের বিশেষ পছন্দের যা পাহাড়ে অমিল। কথা দিলাম,পরের বার মিষ্টি নিয়ে যাব।

আড্ডা শেষ করে ছাতা মাথায় ফিরে গেলাম ঘরে। ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। সারাদিনের ধকলে ঘুম এসে গেল দুজনেরই। রাত দশটায় খাবারের ডাক পড়লে ঘুম ভাঙল। লেপের ওম ভেঙে বের হওয়া দায় কিন্তু খিদে যে বড় বালাই। অগত্যা খেতে গেলাম। রুটি আর মুরগির মাংস পেট ভরে খেয়ে আবার ঘুম ।

পরের দিন ঘুম ভাঙল বেশ সকাল সকাল। চা খেয়ে দুই বন্ধু একটু নদীর দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটায় হেঁটে এলাম। অপূর্ব সুন্দর চারিদিক, শান্ত, নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে নাম না জানা পাখির ডাক। ফিরে আসতেই দেখলাম প্রাতঃরাশ তৈরি হয়ে গেছে। গরম রুটি তরকারি আর ডিমের ওমলেট। প্রাতরাশ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিজেরাও তৈরি হয়ে নিলাম। বেলা সাড়ে বারোটায় ফটক থেকে আমাদের গাড়ি। বাকি সময়টা গানে গল্পেই কেটে গেল। নির্দিষ্ট সময় গাড়ি এল। এবারে এক রাশ স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফেরার পালা। পাহাড় কখনও পুরনো হয় না। তাই পাহাড়ের ডাকে ফিরে আসতে হয় বারবার। আবার আসব ফিরে, জায়গাটিকে মনে মনে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে, আমরা এগিয়ে চললাম সমতলের পথে।