• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

হেমন্তের হাতছানিতে গড়পঞ্চকোট

পাঞ্চেত রাজাদের পুরাতন প্রাসাদ এবং দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপরে প্রাচীন মন্দির অবস্থিত। কোথাও উঁচু আবার কোথাও বা নিচু। তারই মাঝখানে পলাশ, শাল, সেগুন, মহুয়া প্রভৃতি বিবিধ গাছের সমাহার। গড়পঞ্চকোটের সেই ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখ​লেন মধুবন চক্রবর্তী৷

রাঢ় বাংলার রুক্ষ রাঙামাটির প্রান্তর ভাদু গান, টুসু গান, ঝুমুর গান আর ছৌ নাচের, সাবেক তীর্থস্থান পুরুলিয়া। পুরুলিয়া মানেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রাচীন ইতিহাসের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি লোকগান, লোককথা নিয়ে যে-জীবনযাপনের ইতিহাস গড়ে উঠেছে, সেই ইতিহাসের মধ্যমণি হল গড়পঞ্চকোট। পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত রহস্যাবৃত ধ্বংসপ্রাপ্ত এই দুর্গটি যেন আজও জ্বলন্ত ইতিহাস। ‘গড়’ শব্দের অর্থ দুর্গ। পঞ্চ শব্দের অর্থ ‘পাঁচ’। আর কোট কথাটি এসেছে গোষ্ঠী থেকে।

কথিত আছে রাজা দামোদর শেখর, ৯০ খ্রিস্টাব্দে পুরুলিয়া জেলার ঝালদা অঞ্চলের পাঁচজন আদিবাসী সর্দারের সাহায্যে এই স্থানে রাজত্ব গড়ে তোলেন। সেই থেকেই এই জায়গাটির নাম হয়ে ওঠে গড়পঞ্চকোট। পরবর্তীকালে রাজবংশের উত্তরসূরিরা পঞ্চকোটে ছোট-বড় মোট চল্লিশটি পাথর এবং পোড়ামাটির মন্দির তৈরি করে। অনুমান করা হয় প্রায় ৫ মাইল বিস্তৃত এই দুর্গটির বারো বর্গমাইল জুড়ে মিশ্রিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। দুর্গের পিছনে ছিল পঞ্চকোট পাহাড়। আর বাকি তিন দিকে গভীর পরিখা। মূল দুর্গ ঘেরা ছিল পাথরের দেওয়াল দিয়ে। তাই গড়পঞ্চকোট বেশ সুরক্ষিত বলেই মনে করা হতো।

যদিও তা এখন সবটাই ইতিহাস। এই দীর্ঘ দুর্গ প্রায় ধ্বংসের পথে। পড়ে রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি ভগ্নপ্রায় মন্দির। সেই রাজদুর্গ যার অবস্থাও প্রায় জরাজীর্ণ। পঞ্চকোটের নামকরণ সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত থাকলেও, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও গবেষক জোসেফ ডেভিড বেগলারের মতে, পাহাড়ের উপর সর্বমোট পাঁচটি দুর্গ নির্মাণের ফলে, এই নামের সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, ছোটনাগপুর মালভূমির এই পঞ্চকোট পাহাড় অধুনা পুরুলিয়া জেলার নিতুরিয়া ব্লকের অন্তর্গত এবং পাহাড়ের পাদদেশ স্থানটির নাম গড়পঞ্চকোট। প্রত্নতত্ত্ববিদ জোসেফ ডেভিড বেগলারের ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিষয়ে বিবরণীতে অষ্টম খণ্ডে পরিত্যক্ত পঞ্চগড় দুর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। নানাবিধ ইটের সমন্বয়ে তৈরি প্রশস্ত পরিখা বেষ্টিত দুর্গটির মোট আয়তন ছিল বারো বর্গমাইল। বেগলারের বিবরণীতে পরিত্যক্ত পঞ্চকোট দুর্গে সর্বমোট পাঁচটি মূল প্রবেশদ্বারের নাম পাওয়া যায়। যেমন আখ দুয়ার, রাজার মহল দুয়ার, দেশবাঁধ দুয়ার, খড়িবাড়ি দুয়ার এবং দুয়ারবাঁধ। দুয়ারবাড়ি এবং খড়িবাড়ি দুয়ারের গায়ে উৎকীর্ণ লিপিতে মল্লরাজ বীর হাম্বীরের নামের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন তিনি— যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে পঞ্চকোট রাজ্য মল্লভূমের অধীনস্থ ছিল।

আবার বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক এইচ ক্যুপল্যান্ড তাঁর বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ারস মানভূম গ্রন্থটিতে, এই জায়গা সম্পর্কে বলেছেন— ‘পঞ্চকোট বা পাঞ্চেত জেলার উত্তর পূর্বে পুরুলিয়ার প্রায় ৩৫ মাইল উত্তরে সর্বাধিক স্পষ্টতম এই ভূমি আকারে দীর্ঘ অর্ধচন্দ্রের মতো, যা পূর্বের সীমানায় সর্বোচ্চ পয়েন্টে উঠেছে। পূর্বমুখের পাদদেশে পাঞ্চেত রাজাদের পুরাতন প্রাসাদ এবং দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপরে প্রাচীন মন্দির অবস্থিত। কোথাও উঁচু আবার কোথাও বা নিচু। তারই মাঝখানে পলাশ, শাল, সেগুন, মহুয়া প্রভৃতি বিবিধ গাছের সমাহার। একদিকে পাঞ্চেত জলাধার অন্যদিকে পঞ্চকোট পাহাড়, সমগ্র অঞ্চলটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশে আবিষ্ট।’

পূর্বে পঞ্চকোট রাজাদের রাজত্বকালে এখানে পরিখার সংখ্যা ছিল পাঁচটি থেকে একশ দশটি। ছোট বড় পুকুর তো আছেই, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বাঁশ ও কাটা জঙ্গল দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। আর তারই মাঝখানে গড়ে উঠেছিল পরিখা। সপ্তদশ শতাব্দীর রঘুনাথ জিউর মন্দির, কংকালী মাতার মন্দির রানীমহলের ধ্বংসাবশেষ, সায়র, রাজপ্রাসাদের স্মৃতিচিহ্ন, এছাড়াও কিছু মন্দির এবং স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এই অঞ্চলে। সেগুলি কালের নিয়মে প্রায় ভূগর্ভে স্থান পেয়েছে। মন্দিরগুলিতে রয়েছে টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজ। পাশাপাশি এই কাজ দেখেই অনুমান করা যায় বৈষ্ণব ধর্মের সাক্ষ্য বহন করে আসছে মন্দিরগুলি।

এখানে রয়েছে পঞ্চরত্ন মন্দির যা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই মন্দিরটি হল টেরাকোটা নির্মিত। এই মন্দিরের গায়ে ফুল ও আলপনার নকশা আঁকা ছাড়াও, ঢোল-করতাল ও বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের ছবি এবং নৃত্যরত মানব-মানবীর অসাধারণ নজরকাড়া স্থাপত্য দেখে আপনারা মোহিত হয়ে যাবেন। পঞ্চকোট রাজ বংশের কুলদেবী ছিলেন দেবী কঙ্কালীমাতা। তবে পুরনো নাটমন্দিরে এখন কোনও বিগ্রহের অস্তিত্ব নেই। মন্দিরের পেছনের অংশটিও সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত।
গড়ের অন্যদিকে প্রস্তর নির্মিত কল্যাণেশ্বরী দেবীর মন্দিরের ভগ্নাবশেষ জানান দিচ্ছে তার প্রাচীনত্ব। একদিকে রয়েছে জোড়বাংলো ইমারতের ভগ্নাংশ। মন্দিরের প্রবেশ পথের ওপরেও কোনোও লিপি বা মূর্তি খোদাই করা ছিল, যা বর্তমানে বিনষ্ট হয়ে গেছে। যতই ভগ্নদশা হোক না কেন, এখানে আসলে ইতিহাস আপনাকে ছুঁয়ে দেখবে।

আপনিও এই গড়পঞ্চকোটের ইতিহাসকে বৃষ্টির ফোটার মতন ছুঁয়ে দেখতে পারেন। পুরুলিয়ার সবচেয়ে আকৃষ্ট করার মতো পর্যটন স্থান হল এই গড় পঞ্চকোট। কারণ আগেই বলা হয়েছে, এখানেই রয়েছে, ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নির্মিত এই দুর্গ যেন এক জ্বলন্ত ইতিহাস। প্রকৃতির পাঠশালাতে যারা নিজের মতন করে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে চান, এই গড়পঞ্চকোটে ক্যামেরাবন্দী করার মতো রয়েছে অনেক উপকরণ। স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেন এখানকার দেউল, দুর্গ, সৌধ, মন্দির, খিলান, কিংবা খাসমহলহীন স্থাপত্য ভাস্কর্যকে। ছোট্ট ছুটির আদর্শ ঠিকানা।
বর্ষায় গড়পঞ্চকোটের আবার ভিন্ন রূপ। মেঘগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে জমে থাকে পঞ্চকোট পাহাড়ের গায়ে। আবার হেমন্তে রাঙামাটির পথ যেন আরও বেশি রাঙা হয়ে ওঠে। অনতিদূরেই পুরুলিয়ার পঞ্চকোট পাহাড় হেমন্তের ছোঁয়ায় আরও সজীব হয়ে ওঠে। প্রচ্ছন্ন শীতের আবহে সেই অপরূপ সৌন্দর্য যেন বেশি করে প্রকাশ পায়। সদ্য বর্ষা পেরোনো পাহাড় যেন হেসে ওঠে উন্মুক্ত আকাশের মতো।

প্রকৃতির বিস্তৃত ক্যানভাস নিয়ে লাবণ্য প্রভায় গড়পঞ্চকোট শীতের সময় এক অপরূপ সৌন্দর্য বহন করে। আবার বসন্ত আসলে, পলাশ ফুলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের মতো। পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গড়পঞ্চকোট জুড়ে রয়েছে আশেপাশের গ্রামাঞ্চলের অত্যাশ্চর্য সব মনোরম দৃশ্য। কম দূরত্বের মধ্যে মনোরম সব দৃশ্য উপভোগ করতে হলে, আপনাকে যেতেই হবে গড় পঞ্চকোট। না, শুধু যে মন্দিরের ভগ্নাংশ বা মন্দিরের কারুকাজ আপনাকে আকর্ষণ করবে তা নয়, রয়েছে প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগও।

হ্যাঁ, এটা ঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই ইতিহাস প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। পঞ্চকোট গড়ের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা ধ্বংসের খতিয়ান সত্যি কথা বলতে কি, পর্যটকদের চোখ এবং মনকে পীড়া দেয়। যে পঞ্চরত্ন মন্দিরের কথা আপনাদের বললাম, অদূরে ভগ্নপ্রায়, অরক্ষিত সেই মন্দিরে চারিদিকে ছত্রাকার হয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙা প্রাসাদ। অবশ্য খনন করে পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে গোপন কুঠুরি ও সুড়ঙ্গের হদিশ মিলেছে।

তবে অধিকাংশ স্থাপত্যই বর্তমানে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। বহু বছরের সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের অবহেলায় আজ সেসব মন্দির প্রায় নিশ্চিহ্ন বলা যায়। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে মন্দিরগুলি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চকোটের পাদদেশে বর্তমানে পঞ্চকোট প্রাসাদ এবং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত। এখানে প্রায় ৫ মাইল বিস্তৃত একটি দুর্গ ছিল। এই ঐতিহাসিক দুর্গই বাংলায় বর্গী আক্রমণের প্রমাণ বহন করছে।

কলকাতা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গড়পঞ্চকোট, ৫ ঘন্টা ড্রাইভ করেই আপনি চলে আসতে পারেন সড়কপথে আসতে পারেন ভলভো বাসেও। পুরুলিয়ার উত্তর দিকে পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে শাল, পিয়াল, আর ঘন মহুয়ার জঙ্গলে ঘেরা এই গড়পঞ্চকোট সপ্তাহান্তে দারুণ টুরিস্ট স্পট হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়ানোর জন্য আদর্শ জায়গা গড়পঞ্চকোট। সহজ সরল গ্রাম্য জীবনের এক অপূর্ব নির্যাস পেতে পাবেন এখানে এসে। থাকার জন্য জঙ্গলে ঘেরা বনদপ্তরের বাংলো আছে এখানে। থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা ভালোই। নিরাপদ এই বাংলোয় নিশ্চিন্তে দুটি রাত যাপন করতে পারেন।

প্রকৃতির অমোঘ হাতছানি উপেক্ষা না করে, এই আসন্ন শীতের উত্তাপ নিতে চলে আসতে পারেন প্রাচীন দুর্গে। শরতের পর, শীতের নীল খামে মোড়া পঞ্চকোট এক অপূর্ব দৃশ্যের মায়াজাল বুনে দেবে।

কীভাবে যাবেন
গড় পঞ্চকোট যেতে গেলে আপনাকে হাওড়া থেকে ট্রেন করে প্রথমে বরাকর অথবা কুমারডুবি যেতে হবে। কিংবা আদ্রা স্টেশনে পৌঁছোতে হবে। আদ্রা স্টেশন থেকে গাড়ি পেয়ে যাবেন। আর যদি গাড়ি ঠিক করে রাখেন তাহলে সেই ঠিক করে রাখা গাড়িতে বা অটোতে করে পৌঁছে যেতে পারেন গড় পঞ্চকোটে। আসানসোল পৌঁছেও আপনি যেতে পারেন। তারপর আসানসোল থেকে সড়ক পথের দিশেরগড় হয়ে চিরকুন্দার রাস্তা ধরে সোজা গড় পঞ্চকোট।