আপাতভাবে শান্ত মেয়েটি সেদিন কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছিল। তার ভিতরের এক অব্যক্ত যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটেছিল তার চোখের ভাষায়, তার শরীরের অবয়বে। দিনটা ১৪ আগস্ট। রাতের প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হয়েছিল সে, সামিল হয়েছিল তার প্রতিবেশী বন্ধুরাও। পাড়ার বড়দের মিছিলে পা মিলিয়েছিল ওরা। ওদের মিছিলে মিশে গিয়েছিল আরও কয়েকটি ছোট ছোট প্রতিবাদ মিছিল। এরপর যখন সেই একত্রিত মিছিল মূল জনস্রোতে মিশে সাগরের গর্জন তুলল, তখন সেই মেয়েটির চোখের ভাষায় ছিল ঘৃণার স্ফুলিঙ্গ, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ উচ্চারণে ছিল আগুনের উত্তাপ। একটানা উচ্চস্বরে আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচার চেয়েছিল ওরা।
মেয়েটির জীবনের প্রথম প্রতিবাদ মিছিল। এমন হাজারো বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছনো মেয়েদের জীবনেও এই প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেওয়া জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। সেই প্রতিবাদ এমন এক বিষয়কে ঘিরে যা এক ধাক্কায় অনেকটাই পরিণত করে তুলেছে ১০ বছর থেকে শুরু করে ১৯ বছরের কোমল মনগুলিকে। যে অভিজ্ঞতার স্বাদ তিক্ত, যে প্রতিবাদের ভাষায় ঝরে পড়ে ঘৃণা, বিরূপ মনোভাব। এই অস্থিরতার সময়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে সমাজব্যবস্থার এই ক্ষয়িষ্ণু রূপ কতটা আঘাত হানতে পারে বয়ঃসন্ধিক্ষণের মেয়েদের ভবিষ্যৎ জীবনে।
একটি সমাজের ভিত গড়ে ওঠে মূলত জনগণকে কেন্দ্র করে। এই ভিতের ওপর গড়ে ওঠে রাষ্ট্রকাঠামো। সেই কাঠামো বা প্রকৃতি নির্ভর করে মানুষের চিন্তা ভাবনা, ধ্যান-ধারণার ওপর। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেন তরুণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠরা। এই ভিত গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আরেক শ্রেণির ভূমিকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তারা হল কিশোর-কিশোরী। একটি দেশের তথা সমাজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেকাংশেই নির্ভর করে বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছনো কিশোর-কিশোরীদের ওপর। তাদের আচার-আচরণে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব দুই-ই খুব প্রকট। আরজি করের ঘটনার ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে তাদের উপরও।
চিকিৎসকদের মতে, কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবতই অন্যদের দ্বারা খুব সহজেই প্রভাবিত হয়। করণ তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিণত মানসিকতা থাকে না। ৯ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের আচরণে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটলে তা সমাজের জন্য এক বিপদসংকেত। আমরা কথা বলেছিলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৌভিক চক্রবর্তীর সঙ্গে। চিকিৎসকের মতে, আরজি করের ঘটনা এমন এক ঘটনা যে ঘটনার সঙ্গে আমাদের সমাজের সমস্ত স্তরের মেয়েরা কোনওভাবেই নিজেদের আলাদা করতে পারেনি। একজন সৎ চিকিৎসক যেভাবে তাঁর কর্মস্থলে যখন নৃশংস হত্যার বলি হন তা ভয়ংকরভাবে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মধ্যে। আর সেই নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে কিশোরীদের মধ্যেও।
চিকিৎসক বলেন, ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু কেন এই আরজি করের ঘটনা এমন ঢেউ তুলল? তিনি বলেন, খুব বাস্তব হলেও সত্যি যে এতদিন ধর্ষণের ঘটনায় আমরা নিজেদের ডিফেন্ড করেছি এই বলে যে, ‘আমরা এই রকম পোশাক পরি না, তাই আমরা নিরাপদ।’ কিংবা ‘আমাদের খারাপ সঙ্গ নেই, তাই আমরা নিরাপদ। যারা খারাপ সঙ্গে মেশে তাদের পরিণতি এই হয়।’ কিন্তু আরজি করে নিহত তরুণী চিকিৎসকের ঘটনা আমাদের সমাজের মেয়েদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তারা নিরাপদ নন কেউই। এক্ষেত্রে পোশাক, চরিত্র, কিংবা স্থান-কাল-পাত্র কারণ ছিল না। এই ঘটনা বেআব্রু করে দিয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের কদর্য রূপ ।
চিকিৎসক সৌভিক চক্রবর্তী জানান, বয়ঃসন্ধিক্ষণে যারা রয়েছে তাদের মনে এই ঘৃণা বা বিদ্বেষ অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাদের প্রতিবাদের ভাষা উগ্র হবেই। তবে তা ভবিষ্যতে চূড়ান্ত অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তার জন্ম দিতে পারে যা নির্মূল হওয়া দরকার পরিবারের মধ্যে থেকেই। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে বড়দের, যাঁরা বন্ধুমনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন এই পৃথিবীতে বহু ভালো, উদার, মহৎ মানুষও আছেন। চিকিৎসক জানান, এক্ষেত্রে বাবা-মা, শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সৌভিক জানালেন, আরজি করের ঘটনা এক ভয়ের ছাপ ফেলেছে কিশোরীদের মনে। কারণ দূরভাষ থেকে শুরু করে সংবাদপত্র, বাড়ি থেকে পথঘাট সর্বত্র গত দুই মাস ধরে এই একই আলোচনা, একই ছবি দেখে আসছে তারা। সর্বোপরি, ঘটনার কয়েকদিন পর থেকেই মোবাইলে ছেয়ে যায় মেয়েটির ছবি, তাকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বর্ণনা এবং অসংখ্য ভুয়ো ছবির রিল। সেই সব ছবি বা বর্ণনা এই বয়সের মেয়েদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। ছবির সত্যাসত্য বিচার করার ক্ষমতা এই মেয়েদের তো দূরের কথা, বড়দেরও নেই। চিকিৎসকের মতে, ফলে তাদের বোঝানোর প্রাথমিক দায়িত্ব বাবা-মায়েরই। আর এক্ষেত্রে শুধু মেয়েদের নয়, বোঝাতে হবে ছেলেদেরও। মেয়েদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শেখার ক্ষেত্রে বাড়ির পরিবেশও অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন সৌভিক। কারণ বাড়িতে মা, ঠাকুমা, কাকিমাকে বাড়ির বাবা, কাকা, দাদারা সম্মান করছে দেখলে শিশুর আপনিই শিক্ষা বা কর্তব্যের হাতেখড়ি হয়ে যায়।
তবে একে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে নারাজ শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা এখন এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এখন ভাঙনের সময়। রাষ্ট্র যে পুরুষশাসিত সমাজ তৈরি করে দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে আজ রুখে দাড়িয়েছে মেয়েরা। তাই তাদের চোখে প্রতিবাদের ভাষা, মনে আগুনের স্ফুলিঙ্গ।’ তিনি বলেন, ‘মেয়েদের মনের ধিকিধিকি আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। তারা যে আর নিয়ন্ত্রণ মানবে না তা তারা বুঝিয়ে দিয়েছে।’ আরজি করে তরুণী-চিকিৎসকের ওপর অত্যাচারের ঘটনাকে তাঁর ব্যক্তিগত বীক্ষণ দিয়ে বিচার করেছেন মীরাতুন নাহার। তাঁর মতে, নিহত তরুণীর চিকিৎসক সত্ত্বা তাকে দুর্নীতির বিরদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। চিকিৎসক থাকাকালীন যেসব দুর্নীতি তাঁর চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তাঁর মতে, একজন নারী হিসেবে তাঁর এই প্রতিবাদী সত্ত্বা মেনে নিতে পারেনি পুরুষশাসিত ব্যবস্থা। তাই আজ প্রতিটি প্রতিবাদে, মিছিলে, ঘরে-বাইরে মেয়েদের যে শাসন না মানার ভাষা আমরা শুনতে পাচ্ছি তা খুবই স্বাভাবিক। মেয়েরা যে আর জড়পিন্ডের মতো বাঁচতে চায় না তারই বহিঃপ্রকাশ এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ। যার আঁচ স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছে বয়ঃসন্ধিক্ষণে থাকা কিশোরীদের মনেও। তাই তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার স্পষ্টই বলেন, এই ভাঙনের মধ্যে দিয়েই একদিন নতুন সমাজ গড়ে উঠবে যার দখল নেবে মেয়েরাই। তাই এই প্রতিবাদ, কিশোরী মনের বিরুপতা, বিরুদ্ধাচরণ বা ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ যাই হোক না কেন তা স্বাভাবিক ও সদর্থক। তাঁর অন্তর্দর্শন, এই সন্ধিঃক্ষণে সামাজিক বা পারিবারিক জীবন ঘা খাবে, সমাজে ভাঙন আসবে, তার হাত ধরেই একদিন সুস্থ, সুন্দর সমাজ গড়ে উঠবে।
মীরাতুন নাহারের মতোই কিশোরীদের এই সোচ্চার প্রতিবাদকে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেছেন শিশু সুরক্ষা দপ্তরের উপদেষ্টা অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। গণতন্ত্রে প্রতিবাদ করার অধিকার সবার রয়েছে এবং আরজি করের ঘটনার পর সমাজের সব স্তরের মানুষের বিশেষত কিশোরীদের অংশগ্রহণকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে চান না অনন্যা। তাঁর ভাষায়, এই অংশগ্রহণ প্রমাণ করে তাদের মধ্যেও চেতনা রয়েছে এবং এই প্রতিবাদ, আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। অন্য কোনও রাজ্যে প্রতিবাদের এমন নজির নেই বলে তিনি জানান। তাঁর মতে, পুরুষদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ এটা সাময়িক। ঘটনা ঘটার পরপর যে গণ-উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল তা আজ অনেকটাই স্তিমিত বলে জানান তিনি। ফলে আগামিদিনে কিশোরী মনে স্থায়ী প্রভাব পড়বে না বলে তাঁর অভিমত।
গত ৮ বছর ধরে শিশু সুরক্ষা দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অনন্যা। ২০১৬-র সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী ৬ বছর তিনি ছিলেন এই দপ্তরের চেয়ারপার্সন। গত ২ বছর ধরে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন পকসো বিভাগে। সমাজে ঘটে চলা বহু নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর পরামর্শ. মেয়েদের নয়, ছেলেদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে এবং এক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সেই ছেলেটির অভিভাবকদের। পরিবারে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সমান কর্তব্যবোধ, মেয়েদের সম্মান করা, পারিবারিক কাজে সবার সমান অংশগ্রহণ, ছেলে এবং মেয়েকে একই দৃষ্টিতে দেখা— এই সব কিছুর উপরই নির্ভর করে একটি শিশু ও কিশোরের মানসিক গঠন। যেমনভাবে পরিবারে মেয়ে সন্তানকে নমনীয় হতে শেখানো হয়, তেমনভাবেই ছেলেকেও নমনীয় হতে শেখানো উচিত বলে মনে করেন অনন্যা। আবার পাশাপাশি ছেলেমেয়ে উভয়কেই শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে ক্যারাটে বা বক্সিং-এর মতো প্রশিক্ষণও দেওয়া দরকার বলে তাঁর মত। বিষয়টি নিয়ে মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও আদালতের বিচারাধীন বিষয় বলে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। প্রসঙ্গত, আরজি করের ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
সর্বোপরি একথা বলা যায় যে, এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হওয়া এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিকতা গড়ে উঠলে তবেই মনের সঠিক বিকাশ ঘটবে। রাষ্ট্র ও সমাজের ভিতও মজবুত হবে। শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহারের ভাষায় বলা যায় এই ‘সন্ধিক্ষণের মাধুর্য’ সেদিনই উপলব্ধ হবে যেদিন ভাঙন শেষে নতুন সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে।